মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : বাংলাদেশের জনগণ এতটা নৈতিকতাহীন পূর্বে কখনো ছিল না, যতটা আজ দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আগমন দেশের যুবসমাজের জন্য আর্শীবাদ না হয়ে সর্বনাশ ডেকে আনছে। আজকাল পারিবারিক জীবনে সে অপরাসমূহ দেখা যাচ্ছে, যেগুলোর অনেকাংশের পিছনে ব্যক্তির নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবকে বিশেষজ্ঞগণ দায়ী করেছেন। কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতীর প্রেম, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। বলা বাহুল্য, যথাযথ নীতি-নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ছায়ায় গড়ে ওঠা কোন ব্যক্তি এরূপ অপরাধ ঘটাতে পারে না। তাই পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধসমূহের পিছনে নীতি-নৈকিতার অনুপস্থিতি ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় অনেকাংশেই অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধসমূহের পিছনের কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, অনেক ক্ষেত্রেই যৌতুকের কারণে স্বামী বা স্বামীর বাড়ির লোকজন স্ত্রীকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। নির্যতনের মাত্রাগত ভিন্নতা থাকলেও প্রায়শই দেখা যায়, স্ত্রীকে আঘাত করা হয়। তাতে তার কোন না কোন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদ হতে প্রকাশিত এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু ২০১৬ সালের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৪৬৫৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হন ৪৩১ জন। যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৩৬ জনকে। এ সংখ্যা শুধু জনসমক্ষে বা পত্রিকায় আসা নির্যাতনের একটি চিত্র। তাই যৌতুককে পারিবারিক অপরাধের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
পারিবারিক জীবনে যেসব সংঘটিত হয় সেগুলো মৌলিকভাবে সাধারণ অপরাধ থেকে ভিন্ন নয়। তবে কারণগত ও পদ্ধতিগত দিক থেকে কিছুটা ভিন্ন। পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাবলি পর্যালোচনা করে দেখা যায় এর সংখ্যা খুব বেশি নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, হত্যাকান্ড কিংবা শারীরিকভাবে আহত করার মধ্যেই এর অপরাধগুলো সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়, যা কারো কারো ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও বেশি প্রভাব বিস্তার করে। এগুলো ছাড়াও গুম করা, ভয়ভীতি দেখানো ইত্যাদি অপরাধও সংঘটিত হয়। পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো খুন, খুনের হুমকি বা চেষ্টা, লাঞ্ছিতকরণ, অ্যাসিড নিক্ষেপ, শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও ধর্ষণ-চেষ্টা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা, যৌনবৃত্তিতে বাধ্য করা, যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা, অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, যৌন নির্যাতন, মনস্তাত্তিক/ আবেগজনিত বা মানসিক নির্যাতন, অযৌক্তিক লিঙ্গ বৈষম্য, খোটা দেয়া, অপবাদ দেয়া, যৌতুক আদায়, কম খেতে দেয়া, অকথ্য গালিগালাজ, মাত্রাতিরিক্ত ঘাটানো, গায়ে অগুন ধরিয়ে দেয়া, অন্যায়ভাবে তালাক দেয়া, আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক রাখতে না দেয়া, ভরণ-পোষণের খরচ না দেয়া, যিনা ব্যভিচার লিপ্ত হওয়া, অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া, হিল্লা বিয়েতে বাধ্য করা, বৈষম্যমূলক গর্ভপাত, বাধ্যতামূলক গর্ভপাত ইত্যাদি।
এছাড়াও বহু ধরনের অপরাধ পারিবারিক জীবনে সংঘটিত হয় যেগুলো দন্ডবিধিতে বা অন্য কোন আইনে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তাই এই অপরাধগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই মামলাযোগ্য বা আদালতে বিচারযোগ্য নয়। অপরাধ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দোষ-ত্রুটি, আইন-বিরুদ্ধ কাজ, দন্ডনীয় কর্ম, পাপ, অর্ধম ইত্যাদি। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ঈৎরসব, ঙভভবহপব, ঋধঁষঃ, উবভবপঃ, ঝরহ, এঁরষঃ ইত্যাদি। অপরাধ বুঝাতে আরবীতে যানবুন, জারীমাহ, জিনায়াহ, খাতীআহ, ইছমুন, ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়। পরিভাষায় সাধারণতভাবে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ বা কোন সমাজে প্রচলিত লিখিত আইন বা প্রথাকে অমান্য বা লঙ্ঘন করাকে অপরাধ বলা হয়। সাধারণ অর্থে আইনত দন্ডনীয় বা নিষিদ্ধ কাজই অপরাধ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মবিরোধী কোন কথা বা কাজই অপরাধ।
যে কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনার পিছনে কোন না কোন কারণ অবশ্যই থাকে। সেসব কারণ উদঘাটন ব্যতীত সমাধানের পথে হাঁটা প্রায় অসম্ভব। তাই স¤প্রতি দ্রুত ক্রমবর্ধমান পারিবারিক জীবনে অপরাধ দমনের উপায় বের করার পূর্বে এর কারনগুলো কি কি তা জানা আবশ্যক। সাধারণ যে কোন অপরাধের কারণ এবং পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধের কারণ সবসময় এক হয় না। যদিও অপরাধের ধরন ও পদ্ধতি প্রায় একই হয়। বর্তমান গবেষণার উদ্দেশ্য যেহেতু পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধ দমনে ইসলামের নির্দেশনা ও আইনসমূহের ভূমিকা জানা, সেহেতু সর্বপ্রথম পারিবারিক পরিমন্ডলে সংঘটিত অপরাধগুলো কেন ঘটছে, এর পিছনে কি কি করণ রয়েছে তা জানা জরুরি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পারিবারিক অপরাধের মধ্যে হত্যাকান্ড, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইত্যাদির পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক। পরকীয়া প্রেম বলতে সাধারণত নিজের স্বামী বা স্ত্রী বাদে অন্যের স্বামী বা স্ত্রীর কিংবা অন্য কারো সাথ অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করা। এক্ষেত্রে দুইপক্ষই বিবাহিত হতে পারে কিংবা এক পক্ষ বিবাহিত আর অপরপক্ষ অবিবাহিত হতে পারে। পরকীয়া প্রেমকে দেশীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ ও অনৈতিক মনে করা হলেও এটি এখন আর গোপন কিছু নয়। বিভিন্ন কারণে পরকীয়া সম্পর্কের হার ক্রমশ বর্ধমান। আগে শুধু শহরে এ উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও এখন তা প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। পরকীয়া প্রেমের কারণে কোন এক পক্ষ কর্তৃক তার অবৈধ কর্মের বাধা হিসেবে আবির্ভূত ব্যক্তিকে হত্যা করা বা করানোর প্রবণতা দৃশ্যমান। কখনো স্বামী তার স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী তার স্বামীকে হত্যা করে। সাথে সন্তান থাকলেও তারাও হত্যাকান্ড থেকে রেহাই পায় না। পরকীয়া প্রেম এতো শক্তিশালী যে, এর সামনে যেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে সেই হত্যাকান্ড কিংবা অন্য কোন অপরাধের শিকার হতে পারে।
পশুর সাথে মানুষের যে কয়টি বিষয়ে পার্থক্য দৃশ্যমান সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা। পশুর জীবনাচারে নৈতিকতার বালাই নেই বলে তাদের মূল্যবোধও নেই। তা নিয়ে কেউ প্রশ্নও তোলে না। কারণ তাদের নৈতিকতাহীন জীবনাচার সমাজজীবনে কোন প্রভাব ফেলে না। কিন্তু মানুষের নীতি নৈতিকতাহীনতা ও মূল্যবোধহীনতা মানবসমাজকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে জোর গলায় নৈকিতা ও মূল্যবোধের কথা বলা হলেও তার চর্চা ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত অনুপস্থিত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এখন শুধু পাঠ্যপুস্তুকে সীমাবদ্ধ। ব্যক্তির পরিবার বা সমাজের দায়িত্বকে অস্বীকার না করেই বলা যায়, রাষ্ট্র যেভাবে তার নাগরিকদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে সংরক্ষণ করতে পারে অন্য কেউ তা সেভাবে পারে না। ওয়ারিছ সূত্রে প্রাপ্ত জমির ভাগ-বণ্টনকেন্দ্রিক ঝগড়া পারিবারিক অপরাধের একটি বড় কারণ। সাধারণত দেখা যায়, পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তির বণ্টন ও দখল পাওয়াকে কেন্দ্র করে ভাই-ভাই কিংবা চাচা-ভাতিজা অথবা পরিবারের অন্য কারো মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি হয়। যা পর্যায়ক্রমে মারামারি থেকে খুনোখুনি পর্যন্ত পৌঁছায়। প্রায়শই পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, জমি বণ্টনকে কেন্দ্র করে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন। পার্থিব সম্পদের প্রতি অতিমাত্রার মোহ আপন ভাইকে হত্যা করতেও বাধা দেয় না। দেশের নিম্ন আদলতে এবং উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলার একটি বড় অংশই হচ্ছে জমি-জামা কেন্দ্রিক মামলা। পরবর্তীতে মামলাকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্ধ আরো প্রকট আকার ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বংশানুক্রমিকভাবে এসব মামলা চলতে থাকে। ফলে জমিতো কেউ ভোগ করতে পারেই না, উপরন্তু মামলার পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়।
পরিবার হচ্ছে শান্তির আধার। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই শান্তিনিবাসে অশান্তির দাবানল জ্বলছে। আজকাল পরিবারের এক সদস্য অপর সদস্যের হাতে নিরাপদ নয়। শারীরিক ও মানসিক ভাবে পারস্পরিক নির্যাতন হয় না এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আলোচনায় উঠে এসেছে পারিবারিক জীবনে ঘটমান অপরাধসমূহের তালিকা, এর সাথে উঠে এসেছে পারিবারিক জীবনে সংঘটিত অপরাধসমূহের কারণ ও এগুলো প্রতিরোধের উপায়। ইসলাম যেহেতু অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই তা সংঘটনের পথ রুদ্ধ করতে চায় সেহেতু ইসলামী বিধি-বিধানসমূহ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বাস্তবায়ন করা গেলে পারিবারিক জীবনে অপরাধের হার শূণ্যের কোঠায় নেমে আসবে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুতিই পারিবারিক জীবনে অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই অপরাধের ক্রমবার্ধমান এই নবতর প্রবণতা রুদ্ধ করা না গেলে সার্বিক অর্থে পারিবার ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন