শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের দায়িত্বহীন ভূমিকা

| প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কয়েক মাসের বিরতির পর মিয়ানমার সরকার আবারো রাখাইনের মংডু, রাথিডং, বুথিডংসহ মুসলমান অধ্যুসিত এলাকাগুলোতে সেনা মোতায়েন করেছে বলে জানা গেছে। এরই ফলে গত কয়েকদিনে নতুন করে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার নতুন করে সেনা মোতায়েন ও সীমান্তরক্ষির সংখ্যাবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিজিবিও শক্তিবৃদ্ধি করে অবস্থান নিয়েছে। পত্রিকান্তরে উল্লেখ করা হয়েছে, রাখাইনে নতুন করে সেনা মোতোয়েনে আতঙ্কিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা পুশব্যাকের মাধ্যমে প্রতিহত করার পরও গত মঙ্গলবার কক্সবাজারে অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশে নতুন করে অন্তত ৫০০ রোহিঙ্গার আগমন ঘটেছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাখাইনে রোহিঙ্গারা আবারো জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হতে যাচ্ছে, যদিও মিয়ানমার সরকার বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। গত বছরের অক্টোবরে রাখাইনে সীমান্ত রক্ষিদের উপর কথিত হামলায় ৯জন সীমান্ত পুলিশ নিহত হওয়ার পর সেখানে যে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মিডিয়ায় তার সচিত্র প্রচারনায় শেষ পর্যন্ত তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সচকিত করে তোলে। ইতিমধ্যে ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা(ওআইসি), জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কিছু দেশ ও সংস্থা মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষার তাগিদ দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে মিয়ানমার কিছুটা নমনীয়তার কৌশল গ্রহন করলেও তারা রাখাইন থেকে জাতিগত রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়ার নীতি থেকে সরে আসেনি। এ ছাড়া রোহিঙ্গা গণহত্যা, ধর্ষন-নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে অপকর্মের দায় থেকে সংশ্লিষ্টদের অব্যাহতি দেয়ার নীতি গ্রহন করেছে।
দীর্ঘদিনের সামরিক শাসকরা এমনিতেই মিয়ানমারকে মুক্ত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। গণতন্ত্র ও মুক্ত গণমাধ্যমের অবাধ প্রবেশাধিকার না থাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর অনেক কিছুই অজ্ঞাত ও অনালোচিত রয়ে গেছে। মিয়ানমারের সর্বশেষ নাগরিকত্ব আইনে অন্তত ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির স্বীকৃতি দেয়া হলেও শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সুপরিকল্পিতভাবে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকে এই বঞ্চনার শুরু হলেও ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার জন্যই একটি বৈষম্যমূলক কালো আইন পাশ করে সেনাশাসক নে-উইন। এই আইনে মিয়ানমারের নাগরিকদের নাগরিকত্ব নির্ধারণে একটি ‘কাউন্সিল অব স্টেট’ গঠন করা হয়। কাউন্সিল অব স্টেট মিয়ানমারের নাগরিকদের শ্রেনীভেদে সিটিজেন, অ্যাসোসিয়েট এবং ন্যাচারালাইজড নামে স্তরবিন্যাস করলেও রোহিঙ্গাদের কোন শ্রেনীতেই স্থান দেয়া হয়নি। শত শত বছর ধরে রাখাইনে বসবাসকারি রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারি হিসেবে গণ্য করে রাষ্ট্রীয়ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ঘৃণ্য উদাহরণ তৈরী করেছে। সরকারী বাহিনীসমুহের নির্যাতন থেকে বাঁচতে গত অর্ধশত বছরে বিভিন্ন সময়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। গণতন্ত্রপন্থী নেত্রি অং সান সুচির নেতৃত্বে অংশগ্রহনমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে মিয়ানমার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দেয়ার শুরুতেই বিশ্বসম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় তাগিদ ছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া এবং ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক সাম্য নিশ্চিত করা। বলাবাহুল্য, অং সান সুচি রোহিঙ্গা এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রত্যাশা পুরণে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। উপরন্তু তার সময়েই সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে নৃশংস জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হয়েছে রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের চাবি মূলত: মিয়ানমার সরকারের হাতে। তবে এ সমস্যায় বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে অনিদ্দির্ষ্টকাল পর্যন্ত লাখ লাখ রোহিঙ্গার অভিবাসনের দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। এ কারণে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা বিধানের আহŸান জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার তরফ থেকে এ বিষয়ে তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হলেও মিয়ানমার আন্তর্জাতিক তদন্তকারি দলকে সে দেশে প্রবেশ করতে দিতেই অনিচ্ছুক। এর আগে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত রোহিঙ্গা বিষয়ক পরামর্শক কমিশনকেও মিয়ানমার সরকার এবং বৌদ্ধ উগ্রবাদিদের অসহযোগিতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। জাতিসংঘ তদন্ত কমিশনের বদলে তারা নিজস্ব তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলেছিল। কথিত সেই তদন্ত কমিটি রাখাইনে রোহিঙ্গারা কোন গণহত্যা বা জাতিগত দমনের শিকার হয়নি বলে রিপোর্ট দিয়েছে। এই রিপোর্ট যে মিথ্যা তা সকলেই জানেন। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নিশ্চিহ্নকরণের সিদ্ধান্ত মিয়ানমার সরকারের একটি বর্ণবাদি জাতিগত এজেন্ডা। এর মধ্য দিয়ে রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গামুক্ত করতে চায়। সভ্য দুনিয়ায় এটা চলতে দেয়া যায়না। বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। ওআইসি, মালয়েশিয়, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশসহ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষার তাগিদ দেয়া হলেও মিয়ানমারের জন্য এসব আহŸান যথেষ্ট নয়। রোহিঙ্গাদের কারনে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নানা ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি ভারত রোহিঙ্গা মুসলমানদের সে দেশ থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তার কোন ভ’মিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছেনা। মিয়ানমারের টেকসই উন্নয়ন, জাতিগত সহাবস্থান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করতে হলে রোহিঙ্গা সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান জরুরী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন