শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বেসরকারি শিক্ষকদের বঞ্চনা-বৈষম্য দূর করতে হবে

অধ্যাপক আজিজুর রহমান আযম | প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শিক্ষকতা একটা মহান পেশা। দুনিয়াতে আর এমন একটি পেশা নেই যা সম্মানের দিক থেকে শিক্ষকতা পেশার সমান। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর। একটি দেশ, জাতি ও সমাজ তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, দক্ষতা ও নৈতিকতাবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে চায় সেই কাজটা সম্পন্ন করেন সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার ও জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। শিক্ষার গুণগত উন্নয়ন ব্যতিরেকে জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষার অধিকার পরিপূর্ণভাবে অর্জিত হলে জনসাধারণের অন্যান্য অধিকার আদায়ের পথ সুগম হবে। অথচ স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও আমাদের সংবিধানে শিক্ষা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষাকে মৌলিক নীতিমালা হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এগুলো সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনার দিক নির্দেশনা দেয়। শিক্ষা মৌলিক অধিকার না হওয়ার কারণে মৌলিক নীতিমালা লংঘনের দায়ে রাষ্ট্র বা সরকারকে আইনত বাধ্য করা যায় না বা তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ অর্থাৎ হেফাজত করার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের, যা সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে এবং এই মৌলিক অধিকার ক্ষুণœ হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ১০২(১) বিধান মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে মামলা করতে পারবে। আইনগত অধিকার না থাকায় বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য বার্ষিক ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট, পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মতো পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বৈশাখী ভাতা, শিক্ষা ভাতা, পাহাড়ি অঞ্চলে চাকরিরত শিক্ষকদের জন্য পাহাড়ি ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এটি একেবারেই অনভিপ্রেত।
বেসরকারি শিক্ষকদের অধিকার নিশ্চত করতে সরকারি উদ্যোগ এবং পর্যাপ্ত সমর্থন না থাকায় তারা সর্বদাই বঞ্চিত হয়। দেখা যায়, বেসরকারি শিক্ষকরা বাড়িভাড়া পান ১০০০ টাকা। এতে বাড়িভাড়াতো দূরের কথা বাড়ির বারান্দাও ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। তা নিন্তাতই অপ্রতুল এবং উৎসব ভাতা পান স্ব স্ব স্কেলের ২৫ ভাগ। পুরো চাকরি জীবনে মাত্র একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়ে থাকেন যা বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পদোন্নতির কোন সুবিধা নেই। যেমন, বেসরকারি কলেজে এমন অনেক মেধাবী শিক্ষক আছেন যাদের এসএসসি থেকে অনার্স ও মাস্টার্স পর্যন্ত অনেক বিষয়ে প্রথম শ্রেণি রয়েছে এবং তাদের অনেকেই আবার এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রির অধিকারী হয়েও পদোন্নতিতে অনুপাত থাকার কারণে সহকারি অধ্যাপক হতে পারেন না। তাদের এত উচ্চমানের ডিগ্রি থাকার পরও ট্রেজেডিটা হলো তাদের অনেকে পুরো চাকরি জীবনে প্রভাষক হিসাবে জীবন কাটিয়ে দেন। বেসরকারি কলেজে পদোন্নতির কোন সুব্যবস্থা না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন এই সম্মানিত পেশায় আসতে চরম অনিহা প্রকাশ করে। পৃথিবীর কোন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে এমন তুঘলকী প্রথা আছে বলে আমাদের জানা নেই। দেশের মেধাবীদেরকে এই পেশায় আনার জন্য দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকদের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আসছেন কিন্তু তার এই ঘোষণা ঘোষণা হিসাবেই থাকলো আলোর মুখ দেখলো না। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো শিক্ষার গুণগত মানে অগ্রগামী ভূমিকা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল, মর্যাদাবোধ, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্টস পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছেন। তাদের এ আন্দোলন অত্যন্ত যৌক্তিক বলে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা মনে করেন। বর্তমান সরকার তাঁদের অনেকগুলো দাবি পূরণ করেছেন। এখনো অনেক যৌক্তিক দাবি পূরণের অপেক্ষায় আছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে শিক্ষকদের বেতন ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা আমাদের দেশ থেকে কয়েকগুণ বেশি। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আর. এম দেবনাথ সা¤প্রতিক দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় তার এক নিবন্ধে লিখেন, একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তাকে জানিয়েছেন, ভারতে নির্দিষ্ট ডিগ্রি নিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক এখন যোগদান করলেই ২০-২৫ হাজার ভারতীয় রূপি পান যা চাকরিতে যোগদান করলে বাংলাদেশের একজন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বেতনের সমান। তাই এই স্বাধীন দেশের একজন শিক্ষক যখন তার জন্য নির্ধারিত সম্মানীর মাধ্যমে পরিবারের ভরণ পোষণ ব্যবস্থা করতে না পেরে হতাশায় আত্মহত্যা করেন কিংবা এই মহান পেশা ছেড়ে দিয়ে জীবন জীবিকার তাগিদে অন্য কোন অসম্মানের পেশায় জড়িয়ে যান তখন স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা। এই জন্য অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী করতে তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অবশ্যই সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তবেই দেশে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি হবে এবং যোগ্য সু-নাগরিক প্রত্যাশা করা যায়।
কোন জাতি যদি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় তাহলে সে-জাতির পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। প্রায় তিন দশকের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ভিয়েতনাম শিক্ষাখাতে জিডিপির ৬.৬ শতাংশ বিনিয়োগ করে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে আমাদের বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনি¤œ মাত্র ২.২ শতাংশ। জিডিপির অন্তত ৬ শতাংশ ও জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করলে আমরা সার্কভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবো। ইউনেস্কোর হিসাব অনুসারে, শিক্ষাখাতের ব্যয় ৬.৬% হওয়া উচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শিক্ষাখাতে বাজেটের ২১ শতাংশ বরাদ্দ থাকত। এখন তা কমিয়ে ১১ শতাংশে নামানো হয়েছে। কয়েক বছর আগে একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমি যখন দায়িত্ব নিই তখন শিক্ষা বাজেট ছিল শতকরা ১৪ ভাগ। পরের বছরে তা কমে হয় ১৩ ভাগ এখন সেটা ১১ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, সারাবিশ্বে যখন শিক্ষা বাজেট বাড়ছে আমাদের তখন ক্রমেই কমছে। অথচ দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষাকেই সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। কারণ শিক্ষাই একমাত্র দেশকে পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, জঙ্গীবাদ, ধর্মীয় অন্ধত্ব থেকে মুক্ত করতে পারে। শিক্ষামন্ত্রী প্রায়ই বলেন, আমরা শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন দিতে পারি না। তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে, কীভাবে শিক্ষার গুণগত মান তৈরি হবে? ভারত ও নেপালে শিক্ষা খাতে মোট ব্যয় দেশজ সম্পদের ৪ শতাংশ এর বেশি, ভুটানে ৫ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৮ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১১ শতাংশ, চীনে ১২ শতাংশ, ব্রাজিল এবং চিলিতে ৪ শতাংশ। শিক্ষা খাতে ব্যয় সঠিকভাবে ব্যয়িত হলে তা দেশের উৎপাদনশীল কর্মকাÐকে গতিশীল করে এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানব সম্পদের কেবল যোগান দেয় না বরং আন্তর্জাতিক পরিমÐলে সঠিক মাত্রার মানব সম্পদ তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ সালে প্রণয়ন করেছে। অথচ তা দ্রæত বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে পারছে না। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষাখাতে অধিকতর বাজেট বরাদ্দ দেয়া আবশ্যক। প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয় বলে মন্তব্য করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, এই বাজেটে শিক্ষার লক্ষ্য পূরণ হবে না, বরাদ্দ আরো বাড়ানো দরকার। তিনি আরও বলেন, এবারের বাজেটে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের মোট বরাদ্দ গত বছরের তুলনায় বেশি হলেও পারসেন্টেজের তুলনায় তা আবার গত বছরের চেয়ে কম। বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারের প্রতি দাবি ও চাপ অব্যাহত রেখেছে বলেও জানান তিনি। আমরা আশা করি, সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে শিক্ষক সমাজের ন্যায্য পাওনা সুনিশ্চিত করা হবে। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি ও ভাষাগতভাবে দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। আর এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বাস্তবায়িত করবেন মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা। তাই পাঁচ লাখ বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরকে অভুক্ত রেখে কখনোই সরকারের এই মহৎ উদ্দেশ্য সফল হবে না। বেসরকারি শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিগুলো সরকার পূরণ না করলে তারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়বে, রাষ্ট্র এবং সমাজে সকল পেশার মানুষের নিকট হেয় প্রতিপন্ন হবে। শিক্ষকদের বর্তমান বেতন থেকে ১০ শতাংশ হারে কল্যাণ ট্রাস্ট অবসর সুবিধার জন্য কেটে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে তাতে ৫ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক এবং শিক্ষক নেতৃবৃন্দ হতাশ। কেন্দ্রীয় শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বলছেন, সরকার যদি এ অযৌক্তিক, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না করে তাহলে সারাদেশে সমগ্র হাই স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় তালা ঝুলিয়ে দিয়ে শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য অধিকারের জন্য রাস্তায় নেমে আসবে। সেটা হলে দেশের ৯৮ শতাংশ শিক্ষা দানকারী প্রতিষ্ঠান অচল হয়ে যাবে। এতে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে। লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর ব্যাপক ক্ষতি হবে। শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে তাদের অভিভাবকরাও চরম উৎকণ্ঠায় পড়বে। এর বিরূপ প্রভাব সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন