আলী এরশাদ হোসেন আজাদ : কুরবানির পশু মহান আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সৃষ্টি-নৈপণ্যের নিদর্শন, ‘কুরবানির উট গরুকে আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন স্বরূপ বানিয়েছি’ (হজ্ব: ৩৬)।
জীবিকার্জনের আদর্শ অবলম্বন ব্যবসায় অনৈতিকতা ‘রিয্ক’কে অপবিত্র বানিয়ে ফেলে। ইসলামি আদর্শ ‘হালালান তাইয়্যেবা’ অর্থাৎ ‘বৈধ ও পবিত্র’ উপায়ে জীবিকার্জন। হাদিসে বলা আছে ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পবিত্র, তিনি পবিত্র ছাড়া কিছু গ্রহণ করেন না’।
অনৈতিক পন্থায় পশু মোটাতাজাকরণ দন্ডণীয় অপরাধ এবং ইসলামের দৃষ্টিতে একটি বর্জনীয় বিষয়। কুরবানির পশুর ক্ষেত্রে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার দায়িত্ব বেশি। সুরা জুমাআ’তে বলা হয়েছে ‘ওয়া জারুল বা’য়’ অর্থাৎ ‘বিক্রয় বন্ধ কর’। আরবি ‘বা’য়’ অর্থ বিক্রয়। এতে বোঝা যায়, ক্রেতা কী করবে তা বিবেচ্য নয়। বিক্রেতাকে মহান আল্লাহ্র হুকুম পালনের জন্য বিক্রয় বন্ধ করতে হবে। বিক্রেতা বিক্রি বন্ধ করলেই তবে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। উৎপাদন পর্যায়ে অনৈতিক পন্থায় পশু মোটাতাজাকরণ বন্ধ করা এবং এজন্য রাষ্ট্রীয় তদারকি ও জনসচেতনতা সমান জরুরি। কঠোর নজরদারিও প্রয়োজন যেন বিদেশ থেকে অবৈধ পথে অসুস্থ গবাদিপশু দেশে না আসে। বিদেশি গবাদিপশু এ্যানথ্রাক্সসহ অসংখ্য ঘাতক ব্যধি নিয়ে আসে। এতে দেশীয় পশু সম্পদ ও খামারিগণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
‘রিযিকদাতা’ মহান আল্লাহ্ মানুষের জন্য ‘রিজ্কান কারিমা’র (সম্মানজনক জীবিকা) ব্যবস্থা করেছেন। হাদিসের ভাষায় ‘জীবিকার দশভাগের নয় ভাগ রয়েছে ব্যবসায়’। হাদিসের শিক্ষায় ব্যবসায়ের পবিত্রতম মূলধন- সততা, বিশ্বস্ততা, সুনাম, সেবা তথা মানবকল্যাণ। কুরবানির কথা চিন্তায় রেখে পশু প্রতিপালন, মোটাতাজাকরণ একটি ইবাদতমুখী সেবা। তবে অধিক লাভের মোহে নিরিহ, ‘বোবাপ্রাণি’কে কষ্ট দেওয়া বা মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে অসমর্থনীয়। যেমন: গ্রোথ হরমোন, ডাইক্লোফেনাক, অনুমোদনহীন স্ট্রেরয়েড ব্যবহার, সনদপ্রাপ্ত চিকিৎসকের লিখিত পরামর্শ ছাড়া যখন তখন পশুকে ঔষধ ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য দেওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়াও অভিযোগের তালিকায় আছে তথকথিত তূলা, টেবলেট, ইঞ্জেকশন, ভিটামিন, ইউরিয়া সারের অপপ্রয়োগের ঘটনা। অথচ গো-খাদ্য হলো: খড়, ঘাস, খৈল, কূড়া-ভূষি, লবণ, ছোলা, খুদ, ভাতের ফেন, প্রচুর বিশুদ্ধ পানি ইত্যাদি। কৃমি ও রোগমুক্ত উন্নতজাতের পশুকে এগুলো পরিমিত পরিমাণ খাওয়ালে দ্রæত মোটতাজাকরণ সম্ভব।
কুরবানি প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন ‘তোমাদের প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করা ছাড়া তোমরা কখনোই সৎকর্মশীলতায় পৌঁছাবে না’ (আল-ইমরান: ৯২)। প্রিয়নবীর (স.) নির্দেশনা ‘কুরবানির পশুতে চারটি দোষ সহনীয় নয়- (ক) স্পষ্টতঃ অন্ধ (খ) মারাত্মক অসুস্থ (গ) দুর্বল-হাড্ডিসার (ঘ) চার পায়ে চলতে পারে না এমন অক্ষম বা খোঁড়া’ (তিরমিযি)। অন্য বর্ণনায় আছে, ইবনু ওমর (রা.) এমন পশু কুরবানি করতে নিষেধ করেছেন যার দাঁত নেই এবং যা সৃষ্টিগত ভাবেই পঙ্গু (মুওয়াত্তা)। ফতোয়ায়ে শামিতে আছে ‘পবিত্র খাবার খায়িয়ে পশুগুলোর শরীর থেকে অপবিত্রতা দূর করবার জন্য এবং অপবিত্র খাবার থেকে মুক্ত রাখবার জন্য উট ৪০ দিন, গরু মহিষ ২০ দিন, ছাগল ভেড়া ১০ দিন বেঁধে রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়’।
মোটাতাজাকরণের নামে পশুর প্রাকৃতিকগত গুণ, বৈশিষ্ট্য বা আকৃতি বদলে ফেলা, প্লায়ার্স দিয়ে পশুর দাঁত তুলে ফেলে বয়স প্রমাণের চেষ্টা, পশুর হৃদপিন্ড, কলিজা, ফুসফুস, কিডনি বিকল করে ফেলে এমন ঔষধ প্রয়োগ করা নৈতিকতা পরিপন্থী, হারাম ও প্রতারণা। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘বিনাস ও বিপর্যয় ধোঁকাবাজদের জন্য...’ (মুতাফ্ফিফিন: ০১)। প্রিয়নবী (স.) বলেছেন, ‘যে প্রতারণা করে সে আমার দলভুক্ত নয়’ (মুসলিম)।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন