শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

রায় নিয়ে রাজনীতি

| প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মহিউদ্দিন খান মোহন : সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন সরগরম। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গীপ্রসূত প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে এ রায় সম্পর্কে। ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলের পদস্থ নেতারা এ রায় এবং এর পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে যে যার মতো কথা বলছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের কথাবার্তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, আপিল বিভাগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়া এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ে দেয়া পর্যবেক্ষণকে হজম করতে তাদের কষ্টই হচ্ছে। এ জন্য সুপ্রিম কোর্ট, বিশেষত প্রধান বিচারপতির প্রতি তাদের ক্ষোভের বিষয়টি তারা চেপে রাখতে পারছেন না। তারা এতোটাই উত্তেজিত যে, মনে হচ্ছে এ রায় তাদের ক্ষমতার মসনদকে টলিয়ে দিয়েছে। তারা এ রায়কে তাদের প্রেস্টিজ ইস্যু হিসেবে নিয়েছেন বলেও অনুমিত হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এবং মন্ত্রী এমন ভাষায় প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করে কথা বলেছেন যা, অনেকের পক্ষেই তা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কারণ, রায় বিপক্ষে গেলেও সরকারের কোনো মন্ত্রী বিচার বিভাগ বা প্রধান বিচারপতিকে এমন ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন, এটা কেউ কল্পনা করতে পারেন নি। অন্যদিকে, এ রায় নিয়ে দেশের আরেক প্রধান দল বিএনপি শিবিরে বইছে আনন্দের আমেজ। তারা এ রায়কে সরকারের নৈতিক পরাজয় বলে ধরে নিয়ে বক্তব্য-মন্তব্য করছেন। তারা সরকারের পদত্যাগও দাবি করেছেন।
অনেকের মতে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং এর পর্যবেক্ষণ নিয়ে যে ধরনের রাজনীতি এখন চলছে, তা কাম্য হতে পারে না। যে কোনো রায়ে সাধারণত এক পক্ষ আনন্দিত হয়, অন্য পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়। রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার উপায় এবং জায়গা দুটোই আছে ক্ষুব্ধ পক্ষের। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখছি, এ রায়ে সংক্ষুব্ধ সরকারপক্ষ সমস্ত নীতি-নৈতিকতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছেন। তাদের কারো কারো বক্তব্য-মন্তব্য আদালত অবমাননার শামিল বলেও মন্তব্য করেছেন আইন বিশেষজ্ঞগণ।
রায় নিয়ে গত কয়েকদিনে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের যেসব বক্তব্য-মন্তব্য পত্র-পত্রিকায় এসেছে, সেদিকে দৃষ্টিপাত করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। রায় নিয়ে প্রথম প্রতিক্রিয়া দেয় বিএনপি। তারা এ রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে স্বাগত জানায় এবং রায়ের পর্যক্ষেণের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পদত্যাগও দাবি করে। ৩ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের যে পূর্ণাঙ্গ রায় বেরিয়েছে, তাতে যে কোনো সভ্য দেশ হলে সরকার পদত্যাগ করতো। এরপর গত ৯ আগস্ট তিনি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের এক সমাবেশে বলেন, ভোটার বিহীন এ সরকার বিচার বিভাগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১২ আগস্ট অপর এক সমাবেশে মির্জা আলমগীর বলেন, রায়ে আসল চেহারা উঠে আসায় সরকারের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর প্রথম দিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, তারা রায়টি ভালভাবে পড়ে তারপর প্রতিক্রিয়া দেবেন। তবে, বেশিদিন তারা চুপ করে থাকেন নি। তারাও বাকযুদ্ধে নেমে পড়েন। গত ৭ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে রায়ের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, মন্ত্রীদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘রায়ের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলুন। জনগণ যাতে বুঝতে পারে ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে তারা কী মন্তব্য করেছে। রায়ের কোথাও সরকার, কোথাও জনগণ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়েছে। কাজেই আপনারা যেখানে সুযোগ পাবেন, এসব বিষয় জনগণকে জানাবেন।’ ৯ আগস্ট আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে রায় সম্পর্কে তার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় নিয়ে কোনো বিতর্ক চলে না, রাজনীতিও চলে না। বিএনপির কয়েকজন নেতা উসকানিমূলক কথা বলছেন, এটা নিয়ে রাজনীতি করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন। কারণ তাদের হাতে আর কোনো খেলা নেই। আওয়ামী লীগ এ রায় নিয়ে রাজনীতি করতে চায় না। তিনি আরো বলেন, সুপ্রিম কোর্ট সরকারের প্রতিপক্ষ নয়, কিন্তু বিএনপি প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছে।
একই দিনে সংবাদ সম্মেলন ডেকে রায় সম্পর্কে মন্তব্য করে হৈ চৈ ফেলে দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। তার সবচেয়ে সমালোচিত মন্তব্যটি হলো- ‘বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।’ বিচারপতি খায়রুল হকের মন্তব্য সবাইকে বিস্মিত করেছে। কেননা তিনি কোনো সাধারণ নাগরিক নন, সাবেক প্রধান বিচারপতি। তাছাড়া আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে সরকারি চাকরিরত অবস্থায় তিনি সংবাদ সম্মেলন করে আদালত সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করার এখতিয়ার রাখেন কীনা সে প্রশ্নও উঠেছে।
এ রায় এবং এর পর্যক্ষেণ নিয়ে আরো যেসব মন্তব্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে করা হয়েছে, সেসব সবিস্তারে এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এ রায়কে নিয়ে যে রাজনীতি করতে চাচ্ছে সেটা এখন আর অস্পষ্ট নেই। কিন্তু উভয় দলই রায় সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নয় বলেই মনে হচ্ছে। বিএনপি এ রায়কে যেন নিজেদের বিজয় হিসেবে দেখছে। তারা হয়তো উল্লসিত এ জন্য যে, গত কয়েক বছরের সর্বাত্মক চেষ্টায়ও তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি। এ রায় সরকারকে সেই বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে বলেই হয়তো তারা মনে করছে। কিন্তু রায়ের পর্যবেক্ষণের ভেতরে বিএনপির বিব্রত হওয়ার মতো যে অনেক উপাদান আছে সেটা হয়তো তারা খেয়ালই করেন নি। আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রায়ের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ হলো, এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যথাযথ মর্যাদাসহকারেই উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান তার এক নিবন্ধে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ১১ বার এসেছে। এর মধ্যে সর্বাধিক পাঁচবারই উল্লেখিত হয়েছে প্রধান বিচারপতির অংশে। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি এসেছে নয়বার। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতি উল্লেখ করেছেন তিনবার। এছাড়া পর্যবেক্ষণের ৩০, ৫৪ ও ২০০ পৃষ্ঠায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।” প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে এ মন্তব্যও করেছেন যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রধান বিচারপতির যে মন্তব্য আওয়ামী লীগনেতাদের উত্তেজিত করেছে সেখানে তিনি কী বলেছেন সেটা একটু দেখা যাক। তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘কোনো জাতি বা দেশ কোনো এক ব্যক্তিকে দিয়ে গড়ে ওঠে না, কিংবা কোনো একজন দ্বারা তা গঠিতও হয় না। আমরা যদি সত্যিই জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলায় বাঁচাতে চাই, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে আমিত্বের আসক্তি এবং এ আত্মঘাতী অভিপ্রায় থেকে মুক্ত হতে হবে।’
এখন দেখার বিষয় হলো, রায়ের পর্যবেক্ষণের মন্তব্য নিয়ে বিএনপি কেন এতটা উল্লসিত হলো, আর আওয়ামী লীগই বা কেন এতটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলো সাদা চোখে দেখলেও বুঝা যায় এখানে বিএনপির উল্লসিত হওয়ার মতো কোনো উপাদান নেই। একমাত্র নির্বাচন ও সংসদ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি যে মন্তব্য করেছেন তাতে বর্তমান সংসদ ও ২০১৪-এর নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য বলে চিহ্নিত করা যায়। তবে, তাতে এমন কোনো উপাদান নেই যে, যার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দেয়া যায় বা সরকারকে পদত্যাগ করানো যায়।
রায় এবং তার পর্যবেক্ষণে বিচারপতিদের মন্তব্য নিয়ে যে ধরনের রাজনীতি দেশে চলছে, তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক একটি পত্রিকাকে বলেছেন, রায় নিয়ে ভিন্নমত থাকাটা স্বাভবিক। কিন্তু এ নিয়ে বাকবিতন্ডা করা, বিচারককে অপমান করা, অপমানসূচক মন্তব্য করা, রাজনৈতিক রেষারেষি, পাল্টাপাল্টি অবস্থান দেশের আইনের শাসন, আইনের প্রতি সম্মান এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ড. শাহদীন মালিকের এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণের অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। দেশবাসীও তেমনটিই প্রত্যাশা করে। বিচার বিভাগ দেশ ও জাতির স্বার্থে সিদ্ধান্ত দেবে এবং সবাই তা মেনে নেবে। আদালত বা বিচার বিভাগকে নিয়ে রাজনীতি যেমন কাম্য নয়, তেমনি তা শুভকরও নয়। এ সত্যটি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অনুধাবন করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন