দেশের উত্তর এবং মধ্যাঞ্চল এখন বন্যাকবলিত। দেশের অন্তত ২৫টি জেলার ১২২টি উপজেলার বিশাল এলাকাজুড়ে বন্যা চলছে। প্রায় ৫০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। চারিদিকে কেবল পানি আর পানি। এ বন্যার কারণে অসহায় গরীব মানুষদের জীবনে এখন সীমাহীন দুর্ভোগ। বন্যার পানিতে ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। মাঠের ফসল, ধান ক্ষেত আর তরিতরকারি সবই পানিতে ডুবে ধ্বংস হয়েছে। সঞ্চিত ধান, গোয়ালের গরু আর ছাগল সবই ক্ষতিগ্রস্থ। ধ্বংস হয়েছে কয়েক শত পোল্ট্রি খামার। পানিতে ভেসে গেছে হাজারো হাঁস-মুরগি। রাস্তাঘাট, বসত বাড়ি, স্কুলের মাঠ সবই পানির নিচে। মসজিদ, মাদরাসা, মন্দির গির্জা সবটার ভিতরেই পানি। বাড়ির বাইরেও পানি, ভেতরেও পানি। দাঁড়ানোর জন্য কোথাও একটু শুকনো জায়গা নেই। বসার এবং ঘুমানোর জন্যও কোথাও একটু জায়গা নেই। সব মিলিয়ে মানুষের জীবনে আজ বড়ই কষ্ট। মহিলা, বৃদ্ধা এবং শিশুদের জীবনে এই কষ্ট আরো বেশি এবং তারা আরো বেশি অসহায়। বন্যার পানিতে লÐভÐ হয়ে গেছে মানুষের জীবন। সবদিকেই কেবল হাহাকার। পানির কারণে কয়েক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখাও বন্ধ। খাবার পানির বড়ই অভাব। সব নলকূপই পানির নিচে এবং পুকুরসমূহ ময়লা পানিতে ভরাট। রান্ন্া করে খাবার তৈরির সুযোগ কোথাও নেই। শুকনো রুটি, বিস্কুট, মুড়ি আর চিড়া খেয়েই জীবন চালাতে হচ্ছে। এক কথায় ত্রাণের সাহায্যের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে জীবন। এ অবস্থায় সব ভেদাভেদ ভুলে আজ আমাদের দুর্গত মানুষদের রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এখানে কোন ধরনের রাজনীতি নয়, সংকীর্ণতা এবং বিভেদ নয়।
বন্যার কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা বর্ণনাতীত। এ ক্ষতি সহজে পূরণ হবার নয়। এখন প্রয়োজন বন্যা দুর্গত মানুষদের সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করা। তারা যেন আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সে জন্য তাদের সহযোগিতা করতে হবে। বন্যার সময় সবদিক দিয়েই মানুষের জীবনে কষ্ট নেমে আসে। আবার বন্যার পানি নেমে যাবার পরও অনেক দিন ধরে বন্যা কবলিত মানুষদের সেই কষ্ট সহ্য করতে হয়। কারণ তখন মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দেয় প্রকটভাবে। পুকুরসমূহ ময়লা পানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় ব্যবহারের পানিরও সংকট চলে। মানুষ ব্যাপক হারে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ অবস্থায় বন্যার্ত মানুষদের সাহায্য করাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আসুন, আমরা বন্যাদুর্গত মানুষদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। সারাদেশের সামর্থ্যবান মানুষেরা যদি আজ এগিয়ে আসে তাহলে এই দুর্যোগকে মোকাবেলা করা অসম্ভব নয়। আমাদের সম্মিলিত প্রয়াসে এসব দুর্গত মানুষ অচিরেই তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে, একথা আমরা দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি। আসুন, দুর্গত মানুষদের কাছে পৌঁছে দিই শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ। বন্যার কারণে যে মানুষটি আজ সর্বহারা তার প্রতি, আসুন, আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই। বন্যার কারণে যে মানুষটির ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে, তাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে আসুন মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিই। যে কৃষকের ফসল ধ্বংস হয়েছে নতুন করে কৃষিকাজের জন্য সেই কৃষকের পাশে দাঁড়াই। যারা গবাদি পশু হারিয়েছে, তাদের হাতে আবারো গবাদি পশু তুলে দিই। ক্ষতিগ্রস্থ পোল্ট্রি এবং মৎস্য চাষীদেরকে আবারো নতুন করে ব্যবসা শুরুর জন্য সহযোগিতা করি। যে ছাত্রটির বই খাতা নষ্ট হয়েছে সেই ছাত্রটির হাতে আবারো বই খাতা কলম তুলে দিই। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষেরা যেন সহজে ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ নিয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য পুনরায় চালু করতে পারে, সে জন্য ব্যাংকগুলোকে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ীদের বর্তমানে বিদ্যমান ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য সময় দিতে হবে। দেশের এক কোটি মানুষ যদি আজ প্রত্যেকেই মাত্র একশত টাকা করে দুর্গত মানুষদের জন্য দান করে তাহলে নিমিষেই জোগাড় হবে শত কোটি টাকা। আর যদি দান করে প্রত্যেকেই এক হাজার টাকা, তাহলে নিমিষেই জোগাড় হবে হাজার কোটি টাকা। সুতরাং এই উদ্যোগ আজ আমাদের গ্রহণ করতে হবে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, শিল্পপতিসহ ধনী মানুষদের আজ দুর্গতদের জন্য অনেক কিছু করার আছে। যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব তা যদি সবাই করে, তাহলে খুব সহজেই বিশাল একটি ত্রাণ তহবিল গড়ে ওঠবে। আর এই তহবিলকে যথাযথ ব্যবহার করে এইসব দুর্গত মানুষকে আবারো সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে। তাই এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সেক্টরকেও এগিয়ে আসতে হবে। দেশের মানুষের উপকার করার এখনই সময়। দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহকে কর্পোরেট স্যোশাল রেসপনসসিভিলিটির অংশ হিসাবে ত্রাণ কাজে এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন শিল্পগ্রপ, বেসরকারি ব্যাংক, দৈনিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ত্রাণ তহবিল গঠন করতে হবে। তারা উদ্যোগ নিলেই তাদের সেই উদ্যোগে এদেশের মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে সহযোগিতা করবে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিবেÑ এই বিশ্বাস আমরা করতে পারি। আজ শুধু প্রয়োজন উদ্যোগের এবং প্রয়োজন উদ্যোক্তার। মনে রাখতে হবে, এটা জাতীয় সমস্যা। বন্যার কারণে যারা আজ সহায়-সম্পদ হারিয়ে বেঁচে আছে- তারা সবাই আমার আপনার মতই মানুষ। তারা প্রত্যেকেই আমাদের কারো না কারো পিতা-মাতা, কারো না কারো ভাইবোন অথবা কারো না কারো আত্মীয়। সর্বোপরি তারা মানুষ এবং আমাদের সমাজেরই অংশ। আজ তারা বিপদগ্রস্ত। আগামীতে তাদের মতো আমরাও হতে পারি বিপদগ্রস্ত। আজকে তাদের যেমন প্রয়োজন আমাদের সাহায্য, তেমনি আগামীতে আমাদের প্রয়োজন হতে পারে তাদের সাহায্য। সুতরাং মানবতার স্বার্থেই আসুন, তাদের পাশে দাঁড়াই।
বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ এবং ষোল কোটি মানুষের দেশ। এখনো এদেশের শতকরা আশি ভাগ মানুষ দারিদ্রের মধ্যেই বেঁচে আছে। স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা খুব বেশি অগ্রসর হতে পারিনি। এখনও আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে কম উন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) অন্তুর্ভুক্ত। আমরা সবেমাত্র নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে প্রবেশ করেছি। আমাদের এখন উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার জন্য কাজ করতে হবে। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে যেসব দেশের অবস্থান ছিল আমাদেরই কাতারে, সময়কে যথাযথ এবং পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে তারা আজ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। দারিদ্র, অশিক্ষা আর হতাশাকে জয় করে তারা আজ উন্নত, শিক্ষিত এবং ধনী রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে আছে। মালয়েশিয়া, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিংগাপুর তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে তারা সর্বদা অগ্রসরমান। এসব দেশের তুলনায় আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। কলহ আর বিবাদে আমরা সর্বদাই ব্যস্ত। অপ্রয়োজনীয় এবং অহেতুক কাজে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে আমাদের মূল্যবান সময়। তদুপরি বন্যা, খরা, ঘুর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ¡াস হয়েছে আমাদের নিত্যসঙ্গী। কিছুদিন পরপর এসব আমাদের জীবনে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সুতরাং প্রকৃতির এই প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করেই আমাদের বাঁচতে হবে। এদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে বসবাস করার সুযোগ আমাদের নেই। এখানেই জন্মেছি, এবং এখানেই বাঁচতে হবে। প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে আমাদেরকে আবারো সোজা হয়ে দাঁড়াতেই হবে। সুতরাং আমাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে একতা, বন্ধুত্ব এবং স¤প্রীতি। আসুন, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি, সম্মান করি এবং বিপদগ্রস্ত মানুষদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। হিংসা, বিদ্বেষ ও হানাহানি থেকে নিজেদের রক্ষা করি।
লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন