বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের ২৪ আগস্টের পর একদফা কর্মসূচির হুমকি
সংবিধান এবং আইন-আদালতের বিষয়াদি এখন দেশের রাজনীতিকে করে তুলেছে উত্তপ্ত। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণকে ইস্যু করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। হয় রায়ের পর্যবেক্ষণ প্রত্যাহার করতে হবে; নয়তো পদত্যাগ করুন। ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ২৪ আগস্টের মধ্যে এস কে সিনহা প্রধান বিচারপতির পদ থেকে সরে না গেলে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারী দিয়েছে। তাদের দাবি, প্রধান বিচারপতি ওপেন কোর্টে পাকিস্তানের কথা বলে এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে শপথ ভঙ্গ ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য তার পদত্যাগ করা উচিত। মাহবুবুল আলম হানিফ প্রধান বিচারপতিকে আদালত ছেড়ে মাঠে নামার আহবান জানিয়েছেন। এর আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংসদের বিষয়ে অশালীন মন্তব্যের আগে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ করা উচিত ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা পুরো আগষ্ট মাস জুড়েই রায়ের ‘পর্যবেক্ষণ’ ইস্যুতে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিয়োদগার করছেন এবং তার পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছেন। অবশ্য মাঠের বিরোধী দল বিএনপি থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে প্রধান বিচারপতিও ওপর চাপ প্রয়োগ করে রায় পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে। সেটা সম্ভব না হওয়ায় তাকে অপসারণের চেষ্টা চলছে।
পহেলা আগষ্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পুণাঙ্গ রায় ঘোষণার পর দেশের রাজনীতিতে ঝড় উঠে। চাপের মুখে পড়েন প্রধান বিচারপতি। এ অবস্থায় তিনি সবার প্রতি আদালতের রায় নিয়ে রাজনীতি না করার আহবান জানিয়ে কারো ফাঁদে পা না দেয়ার ঘোষণা দেন। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ততই বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করায় ঘরে বাইরে তিনি চাপের মুখে পড়ে গেছেন। রাজপথে তার পদত্যাগ দাবিসহ নানান হুংকার-হুমকি-ধমকি চলছে। পর্দার আড়ালে ঘরের ভিতরেও তার ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। গতকালও প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে এক ঘণ্টা বৈঠক করেন গওহর রিজভী। এ বৈঠকে তাদের মধ্যে কোন বিষয়ে আলাপ হয়েছে তা জানা যায়নি। তবে এমন সময় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে গওহর রিজভী সাক্ষাৎ করলেন যখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সরকার ও সরকারি দলের ব্যাপক চাপে মুখে এস কে সিনহা। এর আগে ৬ আগষ্ট প্রধান বিচারপতির এস কে সিনহার সঙ্গে দেখা করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিক আহমেদ ও দলের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসূফ হোসেন হুমায়ুন। তারা রায়ের পর্যবেক্ষণে সরকারের বিব্রতকর অবস্থা চিত্র তুলে ধরেন। ১৩ আগষ্ট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রধান বিচারপতির কাকরাইলের বাসায় গিয়ে বৈঠক করেন তাঁর সঙ্গে। অতপর তিনি জানান, রায় নিয়ে দলের নেতাদের প্রতিক্রিয়া প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করা হয়েছে। ১৪ আগষ্ট আবার তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্ট মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে দেখা করে জানান, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যে সব কথাবার্তা হয়েছে সেগুলো প্রেসিডেন্টকে অবহিত করা হল। কারণ প্রেসিডেন্ট সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী; তিনি প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এই মধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অ্যাটর্নী জেনালের মাহবুবে আলমকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে যান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে। বৈঠক থেকে বের হয়ে ওবায়দুল কাদের জানান, আদালতের রায় ইস্যু নিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির কাকরাইলের বাসভবন ও বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগ নেতাদের দৌঁড়ঝাপে বিএনপি থেকে অভিযোগ তোলা হয় সরকার প্রধান বিচারপতিকে চাপ দিয়ে রায় পরিবর্তন করতে চায়। তাতে সফল না হওয়া প্রধান বিচারপতিকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করছে।
২০ আগষ্ট বিচারিক আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা বিধি নিয়ে আপিল শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, রায় নিয়ে আপনারা ঝড় তুলছেন। মিডিয়াতে অনেক কথা বলেন। কোর্টে এসে অন্য কথা বলেন। আপনাকে নয়, আপনাদের বলছি। আপনিই বলেন, কবে কি হবে? আপনারাই তো মিডিয়াতে ঝড় তুলছেন, আমরা কোনও মন্তব্য করছি? পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করলেও সেখানে কোনও সমালোচনা হয়নি। আমরা বিচার বিভাগ ধৈর্য ধরছি, যথেষ্ট ধৈর্য ধরছি। ২১ আগষ্ট প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, উনি সরে গেলেই পারেন। উনার তো পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনিস্টিটিউটে এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জনগণের ভোটে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হন। তারা নির্বাচন করেন প্রেসিডেন্ট। সেই প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেন প্রধান বিচারপতি। সংসদের বিষয়ে অশালীন মন্তব্যের আগে উনাকে (প্রধান বিচারপতি) এসব ভেবে দেখা দরকার ছিল। পাকিস্তানের আদালতের উদাহরণ দিচ্ছেন। পাকিস্তানের আদালতের উদাহরণ উল্লেখ করে হুমকি দিয়ে কোনো লাভ নেই। কারণ, আমরা ইয়াহিয়া, আইয়ুব খান, জিয়াউর রহমান, এরশাদ, খালেদার ক্ষমতা দেখেছি। ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। পাকিস্তানের আদালতের সঙ্গে উদাহরণ দেয়ার বিচার আমি দেশবাসীর কাছে দিলাম। আমি সবকিছু সহ্য করতে পারি কিন্তু অকার্যকর রাষ্ট্র পাকিস্তানের উদাহরণ সহ্য করতে পারি না।
চাপ দিয়ে রায়ের পরিবর্তন এবং প্রধান বিচারপতিতে অপসারণের চাপ দিচ্ছে বিএনপির এ অভিযোগ সঠিক নয় বলে দাবি করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সড়ক যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। দুই মন্ত্রীর দাবি বিএনপি কোনো ইস্যু না পেয়ে অহেতুক প্রধান বিচারপতির ওপর চাপের কথা প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের দুই প্রভাবশালী নেতা বিএনপির মিথ্যা বলছে দাবী করলেও গতকাল প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে দেয়া পর্যবেক্ষণ ও রায় ২৪ আগষ্টের মধ্যে প্রত্যাহার না করলে প্রধান বিচারপতি পদ থেকে এস সে সিনহার পদত্যাগে বাধ্য করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের এক দফা আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয়। সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের আহ্য়বাক ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সংগঠনের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এমপি বলেন, প্রধান বিচারপতি ওপেন কোর্টে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে শপথ ভঙ্গ ও সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। এজন্য তার পদত্যাগ করা উচিত। তিনি সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে (তার ভাষায়) অপ্রাসঙ্গিক ও অসাংবিধানিক বক্তব্য সুয়োমোটো এক্সপাঞ্জসহ পুরো রায় বাতিলের দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের অন্যান্য নেতাদের ভাষায় মহিলা সংসদ সদস্যদের নিয়ে প্রধান বিচারপতি রায়ের পর্যবেক্ষণে যে মন্তব্য করেছেন তা অসাংবিধানিক।
প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ গতকাল বলেছেন, ‘আপনি বলেছেন বিচার বিভাগ অনেক ধৈর্য ধরেছে। আমরা আওয়ামী লীগও অনেক ধৈর্য ধরেছি। দেশের মানুষ অনেক ধৈর্য ধরেছে। আমি অতীতের উদাহরণ বলতে চাই না। বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতির দরজায় লাথি মারা হয়েছে। এখনো সেই ঘটনা ঘটেনি। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক তা চাই না। আরেকজন প্রধান বিচারপতি এজলাসে বসতে পারেননি। বিদায় নিতে হয়েছে। আমরা চাই না দেশে সেই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। আপনি পদত্যাগ করুন। দেশের জনগণ অনেক ধৈর্য ধরেছে। দেশের জনগণ অনির্দিষ্টকালের জন্য ধৈর্য ধরবে না।’ আওয়ামী লীগ ১৯৯৯ সালে দলীয় বিবেচনায় এস সে সিনহাকে বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছে প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী না হলে আপনার মতো মৌলভীবাজার কোর্টের আইনজীবী কোনো দিন হাইকোর্টের বিচারপতি হতে পারতেন না। সংখ্যালঘু ও উপজাতীয় স¤প্রদায়ের বিবেচনায় আপনাকে হাইকোর্টের বিচারপতি করা হয়েছিল। অনগ্রসর স¤প্রদায় থেকে যে বিচারপতি হতে পারে সে উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু আপনি প্রধান বিচারপতির পদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আপনি সংসদকে অপরিপক্ব বলেছেন। এ সংসদই তো আপনার বেতন-ভাতা মঞ্জুর করেছেন। আপনি অনুরাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে হওয়ার বিচারপতির শপথ ভঙ্গ করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে লেখা আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আপনি আপনার রায়ে বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। আপনি সংবিধান লংঘন করেছেন। সুতরাং আপনি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করে বলেন, ‘এই সংশোধনী বাতিল করে জাতীয় সংসদকে অবমাননা করা হয়েছে।’ এর আগের দিন হানিফ প্রধান বিচারপতিতে আদালত ছেড়ে রাজপথে নেমে রাজনীতি করার আহবান জানান।
এর আগে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘আদালত যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, আমরা ততবার সংসদে বিল পাস করব। আমরা বিচারপতিদের চাকরি দেই। তারা সংসদের উপর পোদ্দারি করবে? আর বর্তমান সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে প্রতি আক্রমনাত্মক ভাষায় বক্তৃতা করলেও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১০ আগষ্ট সংবাদ সম্মেলনে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। তার ভাষায় ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ অনাকাঙ্খিত, অনভিপ্রেত ও অপ্রাসঙ্গিক। কিছু কিছু শব্দ এক্সপাঞ্জ করার আবেদন করা হবে। পরে তিনি জানান, রায়ের কপির জন্য আবেদন করা হয়েছ্ েকপি পেলেই রিভিউ করা হবে। সরকারের এ অবস্থান জানানোর পরও আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীরা একের পর এক প্রধান বিচারপতিকে আক্রমন করে বক্তৃতা দিতে থাকেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি বর্তমানে জাতীয় আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক সংবাদ সম্মেলন করে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে আপিল বিভাগের রায় অপরিপক্ব, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক বলে মত দেন। তিনি প্রধান বিচারপতির পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন দাবী করেন।
আইনী প্রক্রিয়ায় রায় রিভিউ এর আবেদনের প্রস্তুতির পরও মাঠে রায়ের পর্যবেক্ষন এক্সপাঞ্জের দাবি এবং প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবী, তাকে আদালত থেকে মাঠে আসার আহবান আবার পর্দার আড়ালে তার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বৈঠকের পর বৈঠকে বোঝা যায় কঠির সময় অতিক্রম করছেন প্রধান বিচারপতি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন