(২৮ আগষ্ট প্রকাশিতের পর )
ছাফা ও মারওয়া তাওয়াফ এবং সাঈ শেষ করার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) সেসব লোককে, যাদের সাথে কোরবানীর পশু ছিল না, উমরা শেষ করে এহরাম খোলার নির্দেশ দেন। কোন কোন সাহাবা অতীত প্রথার প্রতি আকৃষ্ট থাকায় এ নির্দেশ পালনে অপারগতা জানাল, তখন তিনি বলেন, আমার সঙ্গে কোরবানীর উট না থাকলে আমিও অনুরূপ করতাম। বিদায় হজ্বের পূর্বে হযরত আলী (রা.)কে ইয়েমেনে প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি তখন ইয়েমেনী হাজীদের কাফেলা নিয়ে মক্কায় আগমন করেন। যেহেতু তার সঙ্গে কোরবানীর পশু ছিল সেহেতু তিনি ইহরাম খোলেননি। ৮ম তারিখ বৃহস্পতিবার রাসূলুল্লাহ (সা.) সকল মুসলমানদের সঙ্গে নিয়ে মিনায় অবস্থান করেন। দ্বিতীয় দিন জুমাবার ভোরে নামাজ শেষে তিনি মিনা থেকে যাত্রা করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তখন পর্যন্ত কোরাইশদের নিয়ম ছিল, তারা যখন হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হতো, তখন তারা আরাফাতের পরিবর্তে মোজদালেফায় অবস্থান করতো, যা হেরেমের সীমার মধ্যে অবস্থিত ছিল। তাদের ধারণা ছিল, কোরাইশরা যদি হেরেম ব্যতীত অপর কোনো স্থানে মানাসেকে হজ্জ, তথা হজ্জের নিয়মাবলী পালন করে তাহলে তাদের একক মর্যাদায় পার্থক্য এসে যাবে কিন্তু ইসলাম সাম্য বা সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাই সেদিক বিবেচনায় এ বৈশিষ্ট্য অনুমোদন করতে পারে না। এজন্য আল্লাহর নির্দেশ, ছুম্মা আফিজু মিন হায়ছু আফাযান্ নামু অর্থাৎ অতঃপর অন্যান্য লোক যেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে তোমরাও সে স্থান হতে প্রত্যাবর্তন করো। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১৯৯) সুতরাং রাসূলল্লাহ (সা.)ও সাধারণ মুসলমানদের সঙ্গে আরাফাতে আগমন করেন এবং ঘোষণা প্রচার করিয়ে দেন, তোমরা নিজেদের পবিত্র স্থানগুলোতে অবস্থান করো; কেননা তোমরা আপন পিতা ইব্রাহীম (আ.) এর উত্তরাধিকারী অর্থাৎ আরাফায় হাজীদের অবস্থান হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর নিদর্শন, স্মৃতি এবং তিনিই এস্থানকে এই বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্ধারণ করেছেন।
আরাফাত: জান্নাত থেকে অবতরণের পর হযরত আদম (আ.) ও হযরত হাওয়া (আ.) এর এখানেই পরিচয় ঘটেছিল বলে স্থানটির নাম আরাফাত হয়। আরফুল উত্তম বাতাসকে বলা হয়। যেহেতু কোরবানীর দিনগুলোতে মিনায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লেও এখানকার আবহাওয়া মনোরম থাকে, তাই এর নাম আরাফাত হয়েছে।
মিনা: হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, এখানে হযরত জিবরাইল (আ.) হযরত আদম (আ.)কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনি কী আশা রাখেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, জান্নাত। এ জন্য স্থানটির নাম মিনা হয়েছে। তামান্না হতে মিনা। এর অপর একটি অর্থ হচ্ছে প্রবাহিত করা। এখানে পশুর রক্তপাত করা হয়, এজন্য এর নাম মিনা হয়েছে।
নামিরা: একটি পল্লী বা পর্বতের নাম। এটি আরাফাতের পূর্বদিকে অবস্থিত। আরাফাতে আগমনের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশে নামিরা নামক স্থানে তাঁর তাবু (খিমা) স্থাপন করা হয় এবং সেখানে তিনি অবস্থান গ্রহণ করেন। দুপুরে সেখানে তার উট কামওয়া আসে, তিনি তাতে সোয়ার হয়ে সেখান থেকে বর্তন ওয়াদিতে আসেন এবং সেখানে উটে দাঁড়িয়ে সেই ঐতিহাসিক খুতবা প্রদান করেন, যা ইসলামের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে গণ্য এ খুতবায় তিনি ইসলামের রীতিনীতিগুলোও নির্দিষ্টভাবে ধার্য করে দেন। কাফের ও জাহেলিয়াতের প্রথাসমূহের বিলুপ্তি সাধন করেন এবং এ খুতবায় তিনি সেই হুরমে বহাল রাখেন যা সর্ব সম্মতভাবে সকল মিল্লাতে হারাম বলে গণ্য ছিল। তিনি ঘোষণা করেন, তোমাদের শোণিত, তোমাদের ধন সম্পদ এবং তোমাদের ইজ্জত-আব্রæ অপরের উপর হারাম। এ খুতবায় তিনি জাহেলিয়াতের প্রথাসমূহকে নিজের পদতলে করেন। অর্থাৎ চিরকালের জন্য মুছে ফেলার কথা ঘোষণা করেন। এ খুতবায় তিনি জাহেলিয়াতের সুদখোরীকে একেবারে মিটিয়ে দেন এবং বাতিল ঘোষণা করেন। এ খুতবায় তিনি স্বীয় উম্মতকে উপদেশ প্রদান করেন যে, তারা যেন নারীদের সাথে সদাচরণ করে এবং ব্যাখ্যা করেন পুরুষদের প্রতি নারীদের কী কী অধিকার এবং নারীদের প্রতি পুরুষদের কী কী অধিকার রয়েছে। তিনি এ খুতবায় উম্মতকে আরো উপদেশ প্রদান করেন যে, আল্লাহর কিতাবকে ধীরভাবে ধারণ করতে এবং বলেন, যতক্ষণ লোকেরা এ কিতাবের ওপর সঠিকভাবে আমল করতে থাকবে, গুমরাহ বা পথভ্রষ্ট হবে না।
নামিরার খুতবা শেষে হুজুর (সা.) লোকদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের কাছে জানতে চাওয়া হবে এসব নির্দেশ তোমাদের কাছে পৌঁছেছে কি, নাকি পৌঁছেনি, তোমার কী সাক্ষ্য দেবে? সবাই এক বাক্যে বলে উঠে যে, আপনি আল্লাহর সকল নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছেন, আপনি নিজের হক আদায় করেছেন এবং আপনি সম্পূর্ণ উপদেশ প্রদান করেছেন। অতঃপর হুজুর (সা.) আসমানের দিকে আঙ্গুল উঠান এবং তিনবার বলেন, হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো, হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষ্য থাকো, হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষ্য থাকো।
এরপর তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা যারা এখানে উপস্থিত তারা এসব নির্দেশ অনুপস্থিত লোকদের নিকট পৌঁছে দেবে।
খুতবা শেষ হওয়ার পর হুজুর (সা.) হযরত বেলাল (রা.)কে আজানের নির্দেশ দেন। তিনি আজান দেন। অতঃপর একামত দেন। দুই রাকাত জোহরের নামাজ আদায় করেন। এতে তিনি নিরবে কেরাত পড়েন, অথচ জুমার দিন কিন্তু জুমার নামাজ পড়েননি। অতঃপর দ্বিতীয় একামত হয় এবং তিনি আসরের নামাজও দুই রাকাত পড়েন।
আরাফায় অবস্থান: নামাজ শেষ করার পর হুজুর মওকেফে আসেন। তিনি পর্বতের পাদদেশে কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ান। তাঁর সামনে ছিল মাশাত পর্বত। তিনি উটের উপর আরোহণ করে ছিলেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়-বিন¤্র ও কান্নার সাথে দোয়া করতে থাকেন। এভাবে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দোয়ারত অবস্থায় থাকেন এবং বলেন, আমরা এখানে অবস্থান করেছি, কিন্তু কাল আরাফায় অবস্থান। আরো বলেন, আরাফার দিন হজ্জ এবং আরাফার দিন দোয়া উত্তম। দোয়ার সময় বুক পর্যন্ত হাত উত্তোলন করেন ঐ সময়কার দোয়াসমূহ বিভিন্ন সহি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার ঘোষণা: আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম (শেষ পর্যন্ত), অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন ইসলামকে মনোনীত করলাম। এ ঐতিহাসিক খোদায়ী ঘোষণা ৮ জিলহজ্জ আসরের সময় আসে বলে বিভিন্ন বিবরণ হতে জানা যায়। অনেকের মতে ৯ জিলহজ্ব আরাফাতের ময়দানে আয়াতটি নাজিল হয়। এ সমাবেশে প্রায় এক লাখ হাজী উপস্থিত ছিল।
মোজদ্দলেফা ও মিনায়: সূর্যাস্তের পর হুজুর (সা.) আরাফা থেকে রওয়ানা হন। হযরত ওসামা ইবনে জায়েদ (রা.)কে তার সঙ্গে উটে বসান, ধীর গতিতে চলতে থাকেন এবং সাহাবাদের বলেন, দ্রæততার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। চলার পথে সর্বত্র তিনি আস্তে আস্তে তালবিয়া লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক পড়তে থাকেন। মোজদালিফায় পৌঁছার পর তিনি পূর্ণ ওযু করেন এবং মোয়াজ্জিনকে আজান দেয়ার নির্দেশ দেন। মোয়াজ্জিন আজান ও একামত দেন এবং তিনি মাগরিবের নামাজ পড়েন। নামাজের পর লোকেরা উট খুলে দেয় এবং মাল সামান নামায় এরপর আবার আকামত-একামত হয়। হুজুর (সা.) এশার নামাজ পড়েন। এরপর তিনি শয়ন করেন এবং অভ্যাস ও নিয়ম অনুযায়ী রাতের নামাজের জন্য ওঠেননি, বরং ভোরের নামাজের জন্য ওঠেন। ফজর শুরু হওয়ার পর প্রথম ওয়াক্তে আজান ও একামতের সাথে সকালের নামাজ আদায় করেন। অতঃপর সেখানে মাশআরে হারামের নিকট এসে দোয়া করেন এবং তকবীর ও তাহলীল পড়তে থাকেন। সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বেই তিনি সেখান থেকে মোজদালেফার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এবার নতুন সোওয়ারীর ওপর ফজল ইবনে আব্বাস (রা.)কে সঙ্গে বসান এবং ওমামা ইবনে জায়েদ (রা.) পদ ব্রজে চলতে থাকেন। হুজুর (সা.) এসময় হযরত আব্বাস (রা.)কে বলেন, তার জন্য সাতটি কংকর এখান হতে বেছে নিতে। কংকরগুলো সেদিন পাহাড় হতে ভাঙ্গা হয়েছিল। হুজুর ওগুলো নিজ হস্ত মোবারকে নিয়ে বলেন, এইভাবে কংকরগুলো দ্বারা রবিউল জিম্বার অর্থাৎ পাথর নিক্ষেপ করবে এবং দ্বীনে বাড়াবাড়ি করবে না। অতীত জাতিসমূহ দ্বীনে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে।
এরপর যখন তিনি ওয়াদিয়ে মোহাসসেরে পৌঁছেন তখন দ্রæত উট চালান। তাঁর নিয়ম ছিল, যখন এমন কোনো স্থান পৌঁছাতেন, যেখানে কোনো জাতির ওপর আজাবে এলাহী নাজিল হয়েছে, তখন সে স্থান দ্রæত অতিক্রম করতেন। যেমন তাবুক যাওয়ার কালে যখন হিজর নামক স্থানে পৌঁছান যা ছিল সামুদ জাতির স্থান তখন তিনি পবিত্র মুখমন্ডল কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন এবং দ্রæত স্থানটি অতিক্রম করেন।
ওয়াদিয়ে মোহাসসের: হাসর অর্থ দুর্বল হওয়া, অক্ষম হওয়া এবং বিছিন্ন হয়ে যাওয়া। এ উপত্যকায় (ওয়াদিয়ে মোহাসসের) আসহাবে ফীল অর্থাৎ খৃষ্টান শাষক আবরাহাতুল আশরামের লোক ও হস্তী বাহিনী খানা-ই কাবা আক্রমণ করতে গিয়ে ধ্বংস হয়েছিল। আল্লাহ তালা যার উল্লেখ সূরা ফীলে করেছেন। আবরাহার হস্তী কাহিনী এ স্থান অতিক্রম করতে সক্ষম হয়নি। এজন্য এ উপত্যকার নাম হয়েছে ওয়াদিয়ে মোহাসসের। এটি মিনা ও মোজদালেফার মধ্যবর্তী অবস্থিত; মিনারও অংশ নয় মোজদালেফারও অংশ নয়। যেমন আরনানা নামক স্থানটি আরফা ও মাশআবের মধ্যে অবস্থিত। এমত অবস্থানে মিনা ও মাশআর উভয়ই হেরমের অন্তর্ভুক্ত।
মিনায় একটি মোজেযা: হুজুর (সা.) মিনায় আগমন করেন এবং এখানে তিনি ঐতিহাসিক খুতবা প্রদান করেন এবং বহু আহকাম শিক্ষা দেন। বর্ণিত আছে, এ খুতবায় মিনায় সকল লোক দূর-নিকটের নিজ নিজ স্থান থেকে শ্রবণ করছিল। এ খুতবা শ্রবণ করার জন্য সকলের কান খুলে দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল কোরবানী দিবসের খুতবা। এ সময় হযরত আলী (রা.)কে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, আমরা এ বছরের পর হজ্জ করতে পারবো না। এরপর তিনি মানাসেকে হজ্জের নিয়মাবলী শিক্ষাদেন। তিনি বলেন, আমার পরে তোমরা কাফের হয়ে যেয়ো না এবং পরস্পর রক্তপাত করো না। একই খুতবায় তিনি বলেন, ‘তোমরা সবাই তোমাদের প্রভু পরওয়ারদিগারের এবাদত বন্দেগী করবে, তোমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, নিজেদের মাসের (রমজানের) রোজা পালন করবে এবং তোমাদের মধ্যে যারা হুকুমদাতা (শাসক) তাদের আনুগত্য করবে, তা হলে তোমরা নিজেদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
এ খুতবার সময় রসূলল্লাহ (সা.) সকলের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এজন্য শাহাবায়ে কেরাম একে ‘হজ্জাতুল বিদা’ বা বিদায় হ্জ্জ বলে আখ্যায়িত করেন।
খুতবার পর রসূলল্লাহ (সা.) কোরবান গাহে গমন করেন এবং ৬৩টি উট নিজ হাতে জবাই করেন। অতঃপর হযরত আলী (রা.)কে নির্দেশ দেন, একশ’র মধ্যে অবশিষ্টগুলো জবাই করার জন্য। তিনি বলে দেন, যে চামড়া ছিলবে এবং গোশত বানাবে তাঁর পারিশ্রমিক তাকে আলাদাভাবে প্রদান করতে হবে।
অতঃপর হজ্জ ও কোরবানীর অন্যান্য যাবতীয় অনুষ্ঠান যথারীতি পালন করেন এবং বিদায় তাওয়াফ শেষে মক্কা হয়ে বিদায়ের পালা। গাদীরে খুম নামক স্থানে পৌঁছার পর সেখানে গুরুত্বপূর্ণ খুতবা প্রদান এবং অতঃপর মদীনায় প্রত্যাবর্তণ করেন। (সীরাতুন নবী ও আছাহুস সিয়ার অবলম্বনে) সমাপ্ত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন