শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মানবতাবাদী বিজ্ঞানী আইনস্টাইন

অ ণু নি ব ন্ধ

অধ্যাপক শামসুল হুদা লিটন | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বিজ্ঞানের জগতে আইনস্টাইন ছিলেন রূপকথার সম্রাট। ছাত্র জীবনেই তাঁর মেধা ও প্রতিভার স্ফূরণ ঘটেছিল। তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত তত্ত¡ীয় পদার্থবিদ। আইনস্টাইন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে আপেক্ষিকতাবাদ উদ্ভাবন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত পারমাণবিক বোমার জনকও আইনস্টাইন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে তারই উদ্ভাবিত পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মারাত্মক পরিণতি দেখে তিনি নিজেকে পরমাণুবিজ্ঞানী হিসেবে ভাবতে লজ্জাবোধ করতেন। আইনস্টাইন মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানকে ব্যবহারের জন্যই কাজ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের জন্য, মানবতাকে ধ্বংস করার জন্য নয়। তিনি সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। তিনি মানুষকে খুবই ভালোবাসতেন। হিরোসিমা-নাগাসাকির ঘটনায় তিনি একজন বিজ্ঞানীর পাশাপাশি হয়ে উঠেছিলেন মানবতাবাদী। জনগণের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন নিজেকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন তারই সূত্র এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োগ করে পারমাণবিক বোমা তৈরি করে মানুষ ধ্বংস করার কাজে পারমাণবিক শক্তিকে ব্যবহার করলো তখন তিনি সিংহের মতো গর্জে উঠেন। এর বিরুদ্ধে তার কন্ঠ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তিনি নিজ চোখে দেখেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা ভাবতেই তিনি আতংকিত হয়ে উঠেন। আইনস্টাইনের চিন্তায় ছিল বিশ্বমানবতাবোধ। শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তারঁ মন ছিল মানবপ্রীতি ও বিশ্বমানবিকতায় ভরপুর। ব্যক্তি ও জাতির স্বাধীনতার প্রতি আইনস্টাইনের ছিল গভীর অনুরাগ। হিটলার-মুসোলিনীর মতো একনায়কতান্ত্রিক উগ্র স্বৈরশাসককে তিনি মনে-প্রাণে ঘৃণা করতেন। তিনি তাদেরকে কখনো সহ্য করতে পারেননি। এসব জনধিকৃত ফ্যাসীবাদী শাসককে বার বার ধিক্কার জানিয়েছিলেন আইনস্টাইন।
১৯৩৯ সালে বেতার মারফত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খবর শুনে আইনস্টাইনের মন বিপদের আশংকায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মানব জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্যে সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ইউরোপে হিটলার দানবের আবির্ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবী ধ্বংস যেতে পারে, তা ভেবে খুবই বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তার আশংকা ছিল, জার্মান যদি পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলে এবং তা যদি ব্যবহার করে তাহলে পৃথিবীতে মানব সভ্যতা শেষ হয়ে যাবে।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ৬ আগস্ট মারানাক হ্রদে অবকাশ যাপন শেষে তিনি যখন নৌকাযোগে ফিরছিলেন তখন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার একজন রিপোর্টার তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। নিউইয়র্ক পত্রিকার ওই সাংবাদিক আইনস্টাইনকে বলেন, ‘আজ হিরোসিমা শহরের উপর প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। আমার সম্পাদক এই সংবাদটা আপনাকে জানাতে বলেছেন।’ একটু থেমে রিপোর্টার আরো বলতে থাকেন, ‘৬০ হাজারের বেশি লোক পারমাণবিক বোমায় মারা গেছে। বিকিরণজনিত অসুখে আরো অনেক লোক হয়তো মারা যাবে।’ সাংবাদিকের কাছে হিরোসিমা শহরের ধ্বংসের ভয়াবহতা শুনে আইনস্টাইন একেবারে স্তম্ভিত হয়ে যান। তাঁর দেহ-মন সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। তিনি অসুস্থতাবোধ করেন। মনুষ্যত্বের অবমাননায় তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। সে সময় তাঁর এক বন্ধুকে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে চিঠি লিখে জানান, ‘আমার আশংকা হয় এই পৃথিবী যত দিন মানুষ থাকবে, ততো দিনই চলতে থাকবে হিংসার বীভৎস কান্ড।’
হিরোসিমা-নাগাসাকির ঘটনায় বিজ্ঞানীর খোলস থেকে বেরিয়ে আসেন আইনস্টাইন। তিনি হয়ে উঠেন মানবতাবাদী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি শান্তির পতাকা নিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জীবনের শেষ ১০ বছর তিনি বিশ্বশান্তির জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের নতুন নতুন অবিষ্কার ও গবেষণার চেয়ে পারমাণবিক বোমার ধ্বংস ঠেকানোই প্রাধান্য পেয়েছিল তাঁর জীবনে।
হিরোসিমায় পারমাণবিক বোমা ফেলার ঘটনায় অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে পারমাণবিক বোমার জনক মনে করি না। এ ব্যাপারে আমার যেটুকু ভূমিকা ছিল তা ছিলো পরোক্ষ। আমার জীবিত কালেই এই বিস্ফোরণ ঘটবে এটা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। তাত্তি¡কভাবে এটা সম্ভব, আমি শুধু এইটুকুই বিশ্বাস করেছিলাম।’
পারমাণবিক বোমার জনক হিসেবে আইনস্টাইনকে নানা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি এই সমালোচানাকে স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়েছিলেন। সমালোচনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘পারমাণবিক বোমার জন্যে যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তাহলে তার জন্যে দায়ী বিজ্ঞান নয়, দায়ী আমাদের বিশ্ব রাজনীতি। বিজ্ঞানীরা রাজনীতি বোঝে না। কেননা রাজনীতি বিজ্ঞান থেকে অনেক বেশি জটিল এবং দুর্বোধ্যও বটে’। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘ইতিহাস প্রমাণ করে যুগে যুগে পৃথিবীতে যত অকল্যাণ ও অমঙ্গল দেখা দিয়েছে তার প্রত্যেকটির জন্য দায়ী হলো রাজনীতিবিদরা।’
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, তারাগঞ্জ কলেজ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন