আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলমানরা আর্তনাদ করছে ‘হে আল্লাহ জালিম (মিয়ানমার) সরকারকে তুমি ধ্বংস করে দাও। তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী বন্ধু পাঠাও’। এভাবে অর্তনাদ করছে মিয়ানমারে সেনা-পুলিশ ও মগদস্যুদের বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী-শিশু-পুরুষ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিষ্ঠুর নির্যাতনে বিরানভূমি আরাকানের লাখ লাখ রোহিঙ্গারা বৃষ্টিতে ভিজে আর রোদে পুড়ে দীর্ঘ পথ মাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। পালিয়ে আসা আরাকানের এসব রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন লাখ লাখ। তাদের করুণ কাহিনী শুনার যেন কেউ নেই।
নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতন ও গুলি থেকে প্রাণে বাঁচতে দলে দলে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গাদের করুণ আর্তনাদে সীমান্ত জনপদ উখিয়া-টেকনাফের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। তাদের অনিশ্চিত গন্তব্য ও যাত্রা কোথায় তা তাদের জানা নেই। চোখে মুখে ভয় আতঙ্ক ও বিষন্নভাব। যেখানে পারে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটপট করছে শিশুরা। অবুঝ শিশুদের কান্না থামাতে শান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়েছে মা-বাবা। এসব শিশুদের কান্না মিশে যাচ্ছে হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের শোরগোলে। নিরুপায় পুরুষদের নির্বাক চাহনি ছল ছল করছে অশ্রুজলে। তারা একটু খাদ্য-বস্ত্র আর আশ্রয় চায়। তারা অন্তত প্রাণে বাঁচতে চায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং উখিয়া-টেকনাফের পথে-ঘাটে শুনা যায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা-নারী-পুরুষের প্রতিনিয়ত এই করুণ আর্তি। সরেজমিনে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ দেখতে গিয়ে দেখা গেছে এসব চিত্র।
আইয়ুব নামের এক রোহিঙ্গা যুবক বৃদ্ধ মা আছিয়া খাতুন ও পিতা দুলু মিয়াকে কাঁধে নিয়ে ১০ দিন ধরে হেঁটে তমবাজার থেকে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছে। বাংলাদেশে এসেও সে জানে না তার বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে যাবে কোথায়, খাবে কী। প্রাণ বাঁচাতে আসা রোহিঙ্গাদের একেক পরিবারে ৭ জন থেকে ১২ জন সদস্য। নারী ও শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি। রয়েছে বৃদ্ধ পিতা-মাতা, শ্বশুর-শাশুড়ী। শত কষ্টে তাদের নিয়ে সীমান্তে শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। আশির কোঠায় মা-বাবার বয়স। হাঁটতে পারে না, দানা পানি তেমন কিছু খেতেও পারে না। যেন অবুঝ শিশু। মা ছোট্ট সন্তানকে কোলে তুলে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছে আর অনেক সন্তান মৃত্যুপুরী আরাকান থেকে প্রাণে বাঁচতে বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাঁধে তুলে ছুঁটে আসে বাংলাদেশে।
এমন কয়েকজন রোহিঙ্গা পরিবারের সাথে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। মায়েনা খাতুন (৮০)। মংডুর মেরুল্লা গ্রামের মৃত ইসমাইলের স্ত্রী। বয়সের ভারে নুয়ে চলতে পারে না। দানা খাদ্য খেতে পারে না। তার ছেলে লেড়– মিয়া (৪৮) মাকে কাঁধে বহন করে পরিবারের ১১ জন সদস্য নিয়ে ঘর থেকে ২৫ আগস্ট সন্ধ্যায় বেরিয়েছে। পাহাড় ও ধানক্ষেতে লুকিয়ে বিভীষিকাময় দিন-রাত কাটিয়েছে তারা। বর্মী সেনাবাহিনীর অবস্থান লক্ষ্য রেখে হেঁটে হেঁটে বহু কষ্টে ১২ দিন পর মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদ্বিয়া সীমান্তে পৌঁছে। সেখান থেকে একদিন পর জনপ্রতি ৯ হাজার টাকা দিয়ে গত বৃহস্পতিবার টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লম্বরী সৈকত দিয়ে এপারে চলে আসে। লম্বা এসব পথ লেড়– মিয়া তার বৃদ্ধ মাকে কাঁধে বহন করে অতিক্রম করেছে। লেড়–মিয়া আরো জানান, প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক নিয়ে প্রাণপন ছুটেছিল সে। এখন অন্তত আর সেই বিভীষিকাময় দিন-রাত ও ভয় নেই। বৃদ্ধ মা’সহ পুরো পরিবার নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পেরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে সে। বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে পেরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় সে।
শুধু লেড়– মিয়া কেন? এভাবে মংডুর গদুচছরার নাতীর কাঁদে ভর করে শহর মুল্লক (৯৫), ছেলেদের কাঁধে ভর করে মংডু থানার উদং গ্রামের শামারূপ বিবি (৯০), হাইচ্ছুরাতা গ্রামের সোনা বিবি (৮৮), বুছিডং থানার খানছামা পাড়ার আবদুর রহিম (১১০) বৃদ্ধ মা-বাবাকে জীবন বাজি রেখে ছেলেরা এপারে নিয়ে এসেছেন।
২৫ বছর ধরে মংডুর লম্বাঘোনা মিডল স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন মাষ্টার আবদুর রহিম (৮৯)। ৫ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদ্বিয়া সীমান্ত থেকে নাফ নদী পেরিয়ে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তিনি জানান, সেনাদের বর্বরতা ও অত্যাচারের শুরুর দিন থেকে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। হঠাৎ করে চারদিক থেকে সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করে এবং ঘরে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় পালাতে গিয়ে তার নাতি আবদুস সালাম (২৫) ও আমির হোছনের (৮) শরীরে গুলি লেগে মৃত্যু হয়েছে। সে সময় দিকবেদিক ছুটে কে কোথায় খবর নেওয়ার সময় পায়নি। পরে সেনারা চলে গেলে মৃতদেহগুলো দাফন করা হয়। এখন পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে এপারে চলে আসেন তিনি। এবারের মতো এমন বর্বরোচিত হামলা ও নির্যাতন আরাকান (রাখাইন) রাজ্যে আর দেখেননি বলেও জানান তিনি।
তাদের মতো দলে দলে আসা রোহিঙ্গাদের পরিবারের করুন দশা বর্ননার ভাষা হারিয়েছে অনেকে। শোকে কাতর অনেক পরিবার। এই অবস্থায় সহায় সম্বল রেখে সীমান্ত পাড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা অর্ধহারে অনাহারে বসে আছে প্রধান সড়কের পাশে ও টেকনাফ বাস স্ট্যান্ডে। এসময় বৃষ্টি হলে ভিজছে আর রোদ হলে পুড়ছে। কিছুক্ষণ পরপর গাড়ী যোগে নিজ গন্তব্যের দিকে ছুঁটছে অসহায় এই রোহিঙ্গা পরিবারগুলো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন