শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অর্থায়ন : শর‘য়ী দৃষ্টিভঙ্গি

আব্দুল মতিন | প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ইসলাম মানবজাতিকে পরিচালনার জন্য কমপ্লিট প্যাকেজ নিয়ে এসেছে, যার পরিপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণ বিশ্বকে শান্তি এবং নিরাপত্তার চাদরে আচ্ছাদন করতে পারে। এ ধর্ম সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট তরীকাহ্ বর্ণনা করেছে। মূলত আল্লাহ্ই সম্পদের মালিক। আর তিনি মানবজাতিকে সম্পদ ব্যবহারের প্রতিনিধি বানিয়েছেন। সুতরাং মানবজাতিকে সম্পদের প্রতিনিধি হিসেবে সম্পদের আসল মালিক আল্লাহ্ তা উপার্জন ও ব্যয় করার ব্যাপারে যে শর্তারোপ করেছেন তা পালন করতে হবে।
মানিলন্ডারিং হলো অবৈধ অর্থ বা সম্পত্তিকে বৈধ রূপ দেয়ার প্রক্রিয়া। আরো ব্যাপকভাবে বলা যেতে পারে: মানিলন্ডারিং হল, অবৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদের মূল হিসাবকে গোপন করা। আর সম্পদ গোপন করা হয় বিদেশে পাচার অথবা অন্য দেশের ব্যাংকে জমা রাখার মাধ্যমে। অথবা সে সম্পদ জমা বা বিনিয়োগ করা হয় কোন বৈধ খাতে। মানিলন্ডারিংয়ের কতগুলো উদ্দেশ্য থাকে। যেমন: ক. আয়ের অবৈধ প্রকৃতি, উৎস, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ গোপন করা। খ. আইন ফাঁকি দেওয়া। গ. বিদেশে বা দেশে পাচার করা। ঘ. আইনের অধীন রিপোর্টিং আড়াল করা। ঙ) সম্পৃক্ত অপরাধ সংঘটনে অংশগ্রহণ, প্ররোচনা প্রদান বা সহায়তা করা।
মানিলন্ডারিংয়ের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান: মানিলন্ডারিংয়ের আরবী প্রতিশব্দ ‘গসীলুল আমওয়াল’। ইসলামী শরীয়তে মানিলন্ডারিং বা গসীলুল আমওয়াল কোনটিই সরাসরি আসেনি। কিন্তু ইসলাম এমন শব্দ ব্যবহার করেছে যা মানিলন্ডারিং বা গসীলুল আমওয়াল থেকেও আরো ব্যাপক অর্থবোধক। আর তা হলো ‘আল-মালুল হারাম’ বা ‘হারাম সম্পদ’ ‘আল-কাসবুল হারাম’ বা ‘হারাম উপার্জন’ ও ‘আল-কাসবু গইরুল মাশরু’ বা ‘অবৈধ উপার্জন’।
বিংশ শতাব্দীতে সারাবিশ্বে মানিলন্ডারিং নামক আর্থিক অপরাধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং এ অপরাধ বন্ধে দেশে দেশে নানান আইন তৈরি হয়। কিন্তু ইসলাম অনেক বছর পূর্বেই সম্পদের ব্যাপারে, বিশেষ করে হারাম সম্পদের ব্যাপারে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ইসলাম হালালকে হালাল বলে উল্লেখ করে হালালভাবে অর্থ উপার্জনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছে। আর হারামকে হারাম হিসেবে বর্ণনা করে তা অপরাধের পথ হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তা থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন রাস্তা তুলে ধরেছে।
আল-কুরআন অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ ভক্ষণের উপর সাধারণভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: ‘আর তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের মাল গ্রাস করো না এবং জানা সত্তে¡ও অসৎ উপায়ে লোকের মাল গ্রাস করার উদ্দেশে তা বিচারকের নিকট নিয়ে যেও না।’ সূরাহ্ আল-বাকারাহ্, আয়াত: ১৮৮। অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা ব্যতীত অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না।’ সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯। আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন: ‘এবং তিনি তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ।’ সূরা আরাফ: ১৫৭। আর এতে সন্দেহ নাই যে, মানিলন্ডারিংয়ের টাকা অবৈধভাবে উপার্জিত ও অপবিত্র। রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেন: ‘(মনে রাখবে) তোমাদের জীবন, সম্পদ, ইজ্জত পরস্পরের মধ্যে যেমন হারাম; তেমনি আজকের এ দিন এ শহরে হারাম।’ মুসলিম (১২১৮)। এই হাদীসটি মানুষের সম্পদ রক্ষা ও অন্যের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রহণ করা না করার প্রতি নির্দেশ করে। এ হাদীসটি এক সাধারণ (আম) হাদীস যা সকল প্রকার আর্থিক ও অর্থনৈতিক অপরাধকে অন্তর্ভুক্ত করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষের সামনে এমন একটি যুগ আসবে, যখন কেউ কি উপায়ে ধন-সম্পদ উপার্জন করলো, হারাম না হালাল উপায়ে- এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রকার পরোয়া করবে না।’ (বুখারী, ১৯৭৭)। এ হাদীসটি রাসূল (সা.)-এর ভবিষ্যতবাণী। তাই মানুষকে সম্পদ উপার্জনের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পবিত্র আর তিনি পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন।’ মুসলিম (১০১৫)।
হারাম সম্পদ থেকে গঠিত যেকোন ভালো কাজ যা দেখতে সুন্দর, এর ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান স্বচ্ছ ও পরিষ্কার; যদিও তা আর্থিক ইবাদত বা শারীরিক ইবাদত হোক অথবা উভয় ইবাদত এক সাথে হোক। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘পবিত্রতা ছাড়া নামায কবুল হয় না এবং আত্মসাৎ বা খেয়ানতের সম্পদ থেকে সাদ্কাহ কবুল হয় না।’ (সহীহ মুসলিম)। আবার হজ্জের ব্যাপারে হাদীসে এসেছে, ‘যখন কোন ব্যক্তি হালাল খরচে হজ্জের জন্য বের হয়ে আরোহীর উপর পা রাখে বলে: লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। তখন আসমান হতে এক আহ্বানকারী আহ্বান করে বলে: লাব্বাইকা ওয়া সা‘দাইক। তোমার পাথেয় হালাল, তোমার আরোহণের পশু হালাল, তোমার হজ্জ কোন কিছুর দ্বারা আচ্ছাদিত না হয়ে কবুল করা হল। আর যখন কোন ব্যক্তি অবৈধ খরচে হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হয়ে সফরের জন্তুর উপর পা রেখে লাব্বাইকা বলে, তখন আকাশ হতে এক আহ্বানকারী বলতে থাকে লা লাব্বাইকা ওয়ালা সা‘দাইক। তোমার পাথেয় হারাম, তোমার খরচ হারাম আর তাই তোমার হজ্জ কবুল হবে না।’ (তাবরানী ফিল আওছাত, ৫/২৫১, হাদীস নং ৫২২৮)। ইসলাম এ কথা বলে দিয়েছে যে, যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ জমা করবে, আর যে ব্যক্তি হারাম সম্পদের উপর বেঁচে থাকবে তার এসম্পদগুলো জাহান্নাম যাওয়ার কারণ হবে। হাদীসে এসেছে: ‘যে রক্ত-মাংস অবৈধ আয়ে বৃদ্ধি পায় জাহান্নামের আগুন তাকে আগে গ্রাস করবে।’ (মুসতাদরাক, ৪/১৪১, হাদীস নং-৭১৬৩। সহীহ ইবনে হিব্বান, ১২/৩৭৮। সুনানে তিরমিযী, ২/৫১২)। সুতরাং অবৈধ পন্থায় অর্জিত সম্পদ যে বিপদের কারণ তা আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট। আকলী (বুদ্ধিভিত্তিক) দলীল: শরী‘আর উদ্দেশ্য হচ্ছে সম্পদ সংরক্ষণ করা এবং সেই সম্পদ দিয়ে অর্থনীতির উন্নয়ন করা। কিন্তু মানিলন্ডারিং এমন একটি অপরাধ যা অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়, কৌশলে অন্যায়-অবৈধ ও হারাম পন্থায় অর্থ উপার্জনের রাস্তাগুলোকে খুলে দেয়।
সন্ত্রাসী কার্যের সংজ্ঞায় সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের আলোকে বলা যেতে পারে যে, ক. কোন ব্যক্তি, সত্তা বা বিদেশী নাগরিক কর্তৃক বাংলাদেশের অখন্ডতা, সংহতি, জননিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করার জন্য জনসাধারণ বা জনসাধারণের কোন অংশের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার বা কোন সত্তা বা কোন ব্যক্তিকে কোন কার্য করতে বা করা হতে বিরত রাখতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে- প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তির ক্ষতি সাধন, হত্যা, গুরুতর আঘাত, আটক বা অপহরণ করা বা চেষ্টা করা কিংবা অন্যকে এরূপ কার্যে প্ররোচনা, সহায়তা দেওয়া কিংবা এতদউদ্দেশ্য সাধনকল্পে বিস্ফোরক দ্রব্য, দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার বা নিজ দখলে রাখা। খ. অন্যকোন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘিœত বা সম্পত্তি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে অনুরূপ অপরাধ করা, চেষ্টা করা, কাউকে প্ররোচিত করা। গ. আন্তর্জাতিক কোন সংস্থার কোন কার্য বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে অনুরূপ অপরাধ করা, চেষ্টা করা, কাউকে প্ররোচিত করা, সহায়তা করা। গ. জ্ঞাতসারে কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অর্থ সম্পদ ভোগ বা দখলে রাখলে।
সন্ত্রাসী কার্যে অর্থায়নের ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি: সন্ত্রাস একটা মারাত্মক অপরাধ যার উদ্দেশ্য হলো বিশৃংখা সৃষ্টি করা। যা মানুষের শান্তি বিনষ্ট করে। যা জান-মাল, বাড়ি-ঘর, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল-চিকিৎসালয়, শিল্প-কারখানা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে। আর ইসলাম কখনোই এ ধরনের কার্যক্রমকে সমর্থন করে না। আর যারা এ ধরনের কার্যের সাথে জড়িত সেখানে অর্থায়নকে ইসলাম আরোও সমর্থন করে না। এ ব্যাপারে আল্লাহ্ বলেন, ‘সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা কঠোর শাস্তিদাতা।’ সূরা মায়িদাহ্ : ০২। ‘আর এমন কিছু লোক রযেছে যাদের পার্থিব জীবনের কথাবার্তা তোমাকে চমৎকৃত করবে। আর তারা সাক্ষ্য স্থাপন করে আল্লাহকে নিজের মনের কথার ব্যাপারে। প্রকৃতপক্ষে তারা কঠিন ঝগড়াটে লোক। আর যখন ফিরে যায় তখন চেষ্টা করে যাতে জমিনে অকল্যাণ সৃষ্টি করতে পারে এবং শস্যক্ষেত্র ও প্রাণনাশ করতে পারে। আল্লাহ্ তা‘আলা ফাসাদ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা পছন্দ করেন না।’ সূরা বাকারাহ্: ২০৪-২০৫। রাসূল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন বিদআতীকে (ইসলামের পরিপন্থী কোনো নতুন মতবাদ সৃষ্টিকারী) আশ্রয় দেয় তার ওপরও আল্লাহর লা‘নত।’ -সহীহ মুসলিম, কিতাবুল আযাহী। ইমাম শাওকানী নাইনুল আওতার (৮/১৫৮) গ্রন্থে বলেছেন, ‘মুহদিস’ হলো ওই ব্যক্তি যে এমন কাজ করে যার দ্বারা পৃথিবীতে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়। সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় ফাতওয়া পরিষদ ‘হাইআতু কিবারিল উলামা’ উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের আলোকে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সন্ত্রাস ও জঙ্গি কর্মকান্ডে অর্থায়ন হারাম ও এমন একটা অপরাধ যার কারণে শরয়ীভাবে শাস্তির যোগ্য।
বিশ্বের প্রতিটি দেশে এন্টি-মানিলন্ডারিং আইন থাকলেও তা প্রতিরোধ করতে অক্ষম। মানিলন্ডারিংয়ের ফলে যেমন দেশের জনগণের অধিকার হরণ করা হচ্ছে তেমনি এ অর্থ বিদেশে পাচারের মাধ্যমে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে বিশ্বে আজ অশান্তি বিরাজ করছে। সুতরাং মানুষ যদি অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলমী আইন অনুসরণ করে তাহলে বিশ্বে শান্তির ছায়া নেমে আসবে।
লেখক: অফিসার, শরী‘আহ্ সেক্রেটারিয়েট,
এক্সিম ব্যাংক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
আবদুল্লাহ ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ৭:২২ পিএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো লিখেছেন। আল্লাহ উত্তম প্রতিদান দান করুন আমীন।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন