মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নিযার্তন চলছে। সেখানকার উগ্রপন্থী কিছু বৌদ্ধ বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতন করেই চলেছে। আর সেদেশের সরকারও বৌদ্ধদের এসব কর্মকান্ডকে সমর্থন করছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় বাহিনীও রোহিঙ্গা নির্মূলে মাঠে নেমেছে। সেখানে আজ যা চলছে তা জাতিগত নিধন ছাড়া আর কিছুই নয়। কোন ধরনের অপরাধের জন্য বিচারের মুখোমুখি না করে, সেখানকার মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। বাঁচার তাগিদে ঘরবাড়ি ছেড়ে, নিজ দেশ ছেড়ে হাজারো রোহিঙ্গা আজ ভিন দেশের রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছে। কখনো বা নৌকা, কখনো বা ভেলায় চড়ে জীবনবাজি রেখে হাজারো রোহিঙ্গা অন্য দেশে চলে যাচ্ছে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ভিন দেশে প্রবেশের জন্য এসব মানুষ কখনো পাড়ি দিচ্ছে সাগরের উত্তাল জলরাশি, কখনো পাড়ি দিচ্ছে পাহাড়ি জঙ্গলের কণ্টকাকীর্ণ পথ আবার কখনো পাড়ি দিচ্ছে সীমান্তের কাটা তারের বেড়া। ওরা রোদের গরমে পুড়ছে, বৃষ্টির পানিতে ভিজছে আর রাত্রে খোলা আকাশের নীচে ঘুমাচ্ছে। ভয়ংকর এবং বিপদসংকুল এই যাত্রাপথে ইতোমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ আজ উদ্বাস্তু এবং শরণার্থী। যাদের এক সময় অর্থ বিত্ত আভিজাত্য সবই ছিল, তারা আজ তাবুর ঘরে বাস করছে। কারো কারো দিন কাটছে সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নীচে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবাই আজ বিপদগ্রস্ত। বেচেঁ থাকার মৌলিক কোন উপাদানই এদের জীবনে বিদ্যমান নেই। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা কিছুই নেই। এদের জীবনে বিদ্যুৎ, বিনোদন এবং স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নেই। একজনের জায়গায় দশজন বাস করছে। রোহিঙ্গাদের জীবনে আজ সুখ, আনন্দ আর শান্তি বলতে কিছুই নেই। ওদের জীবনে কোন স্বপ্ন এবং সুন্দর ভবিষ্যতের হাতছানি নেই। প্রাণ আছে বলেই বেঁচে আছে আর কি। মিয়ানমারের উগ্রপন্থী কিছু মানুষের নির্যাতন আজ লাখো রোহিঙ্গার জীবনকে শেষ করে দিয়েছে। এসব মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে আজ সবাই ব্যর্থ। জাতিসংঘ, ওআইসি, আরবলীগ, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, আসিয়ান, সার্ক, আফ্রিকান ইউনিয়ন, জি-৭সহ সবাই ব্যর্থ। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীনও ব্যর্থ। ব্যর্থ পুরো মানবজাতি এবং ব্যর্থ মানবাধিকারের প্রবক্তারা। এরা সবাই আজ নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই ব্যর্থতা পুরো মানবজাতির জন্য লজ্জা ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু মনে রাখা দরকার, রোহিঙ্গা বলে পরিচিতরাও মানুষ। আমার আপনার মতো বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার ওদেরও রয়েছে। অতএব ওদেরকে একটু বাঁচতে দিন।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং তখন এর নাম ছিল বার্মা। আর ১৯৬২ সাল থেকেই সেখানে সেনাবাহিনীর শাসন চলছে। বাংলাদেশ সীমান্তের পাশ^বর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে তারা সেখানে বসবাস করছে। প্রায় হাজার বছর আগে রাখিয়াং নামে এক জাতি ইসলাম গ্রহণ করে রোহিঙ্গা নাম নিয়ে মিয়ানমারে বসতি স্থাপন করে। সেই থেকেই রোহিঙ্গা বলে পরিচিত এই জনগোষ্ঠী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। অথচ মিয়ানমার সরকার এখন রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে। ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এই রোহিঙ্গারা ভোট দিতে পারত এবং তারা প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশটির সংসদে পাঠাত। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৮২ সালের ১৫ই অক্টোবর ‘বার্মিজ সিটিজেনশিপ ল’ নামে একটি আইন পাশ করে এবং এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়। তখন থেকেই রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। ২০১৪ সালের আদম শুমারিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাদ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মিয়ানমার সরকারের ভাষ্য মতে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী নয়। ফলে এরকম নির্যাতিত, অবহেলিত, অধিকারহীন এবং রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা পৃথিবীতে আর একটিও নেই। মিয়ানমারের বৌদ্ধদের হাতে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হবার কারণে ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসাবে প্রায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাস করছে। কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুবপালং এবং টেকনাফের নয়াবাজার শরাণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গারা খুবই মানবেতর জীবন যাপন করে। এছাড়া উখিযার লেদা এবং টেকনাফের টাল মেকশিপ্ট ক্যাম্পেও অনেক রোহিঙ্গা বসবাস করে। বাকীরা চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। এদিকে ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া নতুন করে নির্যাতনে ৩ হাজার রোহিঙ্গা মারা গেছে বলে জানিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আরো প্রায় দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেও, রোহিঙ্গাদের প্রতি পরিচালিত নির্যাতন বন্ধে তিনি বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, অং সান সুুচি এই ইস্যুতে একেবারেই নীরব। তার এই নীরবতা রোহিঙ্গাদের প্রতি চলমান নির্যাতনকে উস্কে দিয়েছে।
যাদেরকে নিয়ে ওপরের কথাগুলো বলেছি, তারা কিন্তু পৃথিবী নামক আমাদেরই গ্রহের বাসিন্দা। তারা এই সভ্য দুনিয়ারই বাসিন্দা, যেখানে আকাশ চুম্বি অট্টালিকা আর বিদ্যুতের জমকালো চমকানিতে চোখ দিশা হারিয়ে ফেলে। যেখানে বিনোদনের জন্য খেলা, নাটক, সিনেমা আর গানের পিছনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। অথচ এই সব বনি আদম আজ র্সবহারা। রোহিঙ্গা বলে পরিচিত এসব মুসলিম জনগোষ্ঠী আমার আপনার মতই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। তাদের জীবনেও আমাদের মতো চাওয়া পাওয়া রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই পৃথিবীর প্রতিটি দেশে বসবাসরত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এবং প্রতিটি নাগরিকেরই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার, মতো প্রকাশের এবং রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। একজন মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে বেঁেচ থাকার সকল অধিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীরও রয়েছে। এখানে ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্রীয়ভাবে কাউকে চিহ্নিত করে, তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারো নেই। যদি করা হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের সুষ্পষ্ট লঙ্ঘন।
বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার আর ফেরত নিতে ইচ্ছুক নয়। অপরদিকে এই সব রোহিঙ্গারাও নির্যাতনের ভয়ে মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজী নয়। নিজ দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তা এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করাটা যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র এবং সরকারের নৈতিক দায়িত্ব, সেখানে মিয়ানমারের সরকার আজ সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের দেখামাত্রই হত্যা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করা হচ্ছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গা সংকট রাংলাদেশের জন্য একটি স্থায়ী সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে আশ্রয় দেবার মত শক্তি সামর্থ্য আমাদের নেই এ কথা নিরেট সত্য। কিন্তু এর পরও শুধুমাত্র প্রাণে বাঁচানোর জন্য হলেও, বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় দিতে হবে। কারণ এটা মানবিক বিষয়। এখানে ধর্ম, বর্ণ এবং গোত্র বিবেচনার বিষয় নয়। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশেই জন্ম গ্রহণ করেছেন, বাংলাদেশেই বড় হয়েছেন এবং এদেশেই বিয়ে শাদী করে সংসার করছেন। এরা অনেকটাই এদেশের মানুষের সাথে মিশে গেছে। একথা সত্যও যে, অনেক রোহিঙ্গা বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত হয়েছে। তাদেরকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে শাস্তির আওতায় আনা হোউক। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রদান বন্ধ করা মোটেই উচিত হবে না। কারন এই রোহিঙ্গাদের জীবনই আজ বিপন্ন। সুতরাং আগে ওদের জীবন বাঁচাতে হবে। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে। জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াসহ সকল বৃহৎ রাষ্ট্রকে মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করার এবং এই সংকটের একটি স্থায়ী এবং গ্রহণযোগ্য সমাধান করার জন্য বিনীত আবেদন জানাচ্ছি। বিশে^ শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত এইসব শক্তি এবং রাষ্ট্রকে আজ মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিশেষে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা এবং নির্যাতন এই মুহুর্তেই বন্ধ করার জন্য মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই। একই সাথে মিয়ানমারের প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সুচির প্রতিও আহ্বান জানিয়ে বলছি, আপনি অনুগ্রহ করে রোহিঙ্গাদের প্রতি নির্যাতন বন্ধে পদক্ষেপ নিন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এইসব নির্যাতন কোন সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না। কোন মানুষ এ ধরনের বিবেকহীন কাজ করতে পারে না। কিছু মানুষকে হত্যা করে কখনো একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা যায় না। জাতিগত বিভেদ এবং সাম্প্রদায়িকতার দেয়াল সৃষ্টি করে কখনো একটি সমাজে এবং রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। একইভাবে একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রকে শান্তি এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়া যায় না। সুতরাং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিন এবং তাদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। বিদেশের মাটিতে শরণার্থী হিসেবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিন এবং তাদের নিজ বসত ভিটায় নিরাপদে বসবাস করতে দিন। রোহিঙ্গাদের সাথে নিয়েই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলুন। এতেই মিয়ানমারের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
omar_ctg123@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন