মাহমুদুল হক আনসারী
বাঁচার জন্য খেতে হবে, তা হতে হবে স্বাস্থ্যসম্মত। বাজারে অধিকাংশ খাদ্যের আইটেম স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। খাদ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার হচ্ছে। শাক-সবজি, তরিতরকারি, ফলমূল সব কাঁচামালেই রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে যে ফসল উৎপাদন হওয়ার কথা তা এখন হচ্ছে না। এখন উৎপাদন হচ্ছে জমিতে প্রেসার দিয়ে, সারের মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগ করে। জমির উৎপাদন ক্ষমতার বাইরে জমি ব্যবহার করা হচ্ছে। অতিরিক্ত সার প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদনে কৃষক তৎপর। শুধু উৎপাদনই নয়, জমির ফসল ঘরে তুলে সংরক্ষণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ফরমালিন, কীটনাশক। ফলে তার গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। বাজার থেকে ঘরে এনে প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়া হচ্ছে। মাসের পর মাস গোডাউনজাত করে রাখা এ ফসল, ফলমূল নানা ধরনের রোগব্যাধি মানব দেহে সৃষ্টি করছে। সারা দেশে কাঁচা পাকা ফল এভাবেই বাজারজাত হয়ে আসছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামলে দু-একদিন ভালো থাকে। পরে আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়। নগরীর সব বড় বড় বাজার, আড়তদার, পাইকারি বাজারে এ অবস্থা দেখা যায়। কাঁচা পাকা ফলের মান নিয়ন্ত্রণ রাখতে এখনই পদক্ষেপ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান প্রত্যাশা করছে সচেতন জনগণ। সয়াবিন তেল, খোলা দুধ, পাউডার দুধ, চাল, মুড়ি, মাছ, মাংস, শুঁটকিÑ এসব নিত্যপণ্যের দিকে জেলা প্রশাসকের নজর দেয়া দরকার। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, বকশিরহাট, বহদ্দারহাট, কর্ণফুলী বাজারসহ বড় বড় বাজারে পণ্যের মান খুবই নি¤œ ও ভেজাল। বোতল ও প্যাকেট জাত পণ্যের খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও বাস্তবে তা নেই। বিএসটিআইয়ের সিল তারিখ ঘষামাঝা করে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। চাল ছাড়া বাঙালির পেট ভরে না। এ চালের মধ্যে নানা ধরনের ভেজাল চোখে পড়ছে। মোটা চালকে চিকন চালে রূপান্তর, চিকন চালকে কেমিক্যাল ব্যবহার করে সুগন্ধি চালে উন্নতিকরণ, দীর্ঘ সময় গোডাউনজাত করার জন্য কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার, যা মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। চালের এ অবস্থা পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত নজরে পড়ছে। জনগণের প্রধানতম খাদ্য চালের মান নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। বিদেশি নি¤œমানের চাল আমদানি করে একশ্রেণির ব্যবসায়ী চালের বাজার অস্থির করে ফায়দা লোটার সুযোগ খুঁজছে। চালকে জনগণের প্রধান খাদ্য হিসেবে ভেজাল করা থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুঁটকি অনেকের কাছে জনপ্রিয় খাদ্য। বিদেশে রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়। শুঁটকির অবস্থা সম্পর্কে জানতে আছাদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, নতুন ব্রিজের আশপাশ এলাকায় সাগর পাড়ে সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে যা দেখা যায়, আমরা যেন শুঁটকি খাচ্ছি না। বরং টাকা দিয়ে খরিদ করে উচ্চমূল্যে বিষ খাচ্ছি। দেখা গেছে, শুঁটকি শুকানোর আগে কাঁচা মাছে এক প্রকার বিষ জাতীয় কেমিক্যাল ব্যবহার করা হচ্ছে। কেমিক্যাল মিশিয়ে মাছ শুকানো হচ্ছে। মাছ শুকানোর পর শুকনো মাছে এক প্রকার পাউডার মেশানো হচ্ছে যেন সেখানে অন্য কোনো পোকামাকড় না বসতে পারে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বাচবিচার নেই। নানা ধরনের কেমিক্যাল বিষ মেশানো শুঁটকি পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার, সেখান থেকে বাজারের ব্যাগে করে প্রায় প্রতিটি পরিবারেই পৌঁছে যাচ্ছে। শুঁটকির নামে বিষ খাচ্ছি, পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, মেহমানদের ভোজন করছি বিষ ও কীটনাশক শুঁটকির মাধ্যমে। এতে নানা ধরনের ভয়ংকর রোগব্যাধি মানব শরীরে জন্ম নিচ্ছে। শুঁটকি সেক্টরের উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে এখনই এ সেক্টরকে নিয়মনীতির আওতায় আনা দরকার। প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভেজাল ও কীটনাশক খাদ্যের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা জরুরি। চট্টগ্রামের নতুন ব্রিজ, এলাকার চতুর্দিকে শুঁটকি ব্যবসায়ীরা বিশাল একটি অংশজুড়ে শুঁটকি তৈরি করে। সরকারি খাস জমি দখল করে অথবা অবৈধ ভূমিদস্যুদের থেকে ইজারা নিয়ে ওইসব শুঁটকি পল্লী গড়ে উঠেছে। এ পল্লীর উৎপাদন, বিপণন, বাজারজাত ইত্যাদি তদারকির প্রশাসনিক কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এখানে শুঁটকি পল্লীর সঙ্গে মানুষের বাড়িঘর দেখা যায়। যারা বসবাস করে তারা মারাত্মক পরিবেশ দূষণের মধ্যে জীবনযাপন করছে। শুঁটকি পল্লীর এ মাছ শহর, নগর ও দেশ-বিদেশে বিভিন্নভাবে রপ্তানি হয়ে থাকে। নগর ও নগরীর বাইরে এ শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে। সোনাদিয়া, রাঙ্গাবালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়ার শুঁটকির নামে এ বিষাক্ত শুঁটকি বিক্রি করা হয়। কখনো এ শুঁটকিকে নতুন ব্রিজ এলাকার উৎপাদিত শুঁটকি বলা হয় না। নাগরিক জীবনে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য তা খাচ্ছে। ফলে নানা ধরনের রোগব্যাধি, স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউ-ই এ থেকে বাঁচার উপায় নেই। শুঁটকি আসক্ত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানা ধরনের বিষ প্রয়োগে উৎপাদিত এ শুঁটকি ক্ষতিকর জেনেও না খেয়ে উপায় নেই। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় আমাদের এ খাদ্য গ্রহণ করতে হচ্ছে। এ খাদ্যের উৎপাদন মান, রক্ষণ, তদারকি করা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে দেখছে নগরবাসী। এদিকে মাছ, মাংস, তরিতরকারি, প্যাকেট, বোতলজাত খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন নানা ধরনের সামাজিক সভা-সমাবেশ-মিটিং করে ভেজাল খাদ্য বাজারজাত বন্ধে ভূমিকা রাখতে পারে, সঠিকভাবে বিএসটিআইর তারিখ যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা তাও মনিটরিং দরকার। খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আগ্রাবাদ, বাদামতলীসহ নগরীর আরও বিভিন্ন এলাকায় একটি অসাধু চক্র ভেজাল ও দূষিত উপকরণ দিয়ে খাদ্য তৈরি করছে। ঘি, মধু, চানাচুর, পাউরুটি, বিস্কুট, হলুদ, মরিচ, ধনিয়ার গুঁড়ার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে রং এবং ধান ও আঠা ময়দার উচ্ছিষ্ট ধুলাবালি। নগরীর লাখ লাখ কর্মজীবী, শ্রমজীবী, দিনমজুর মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে এসব খাবার না খেয়ে পারছে না। বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছে এবং খাচ্ছে। এসব বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেখা দরকার বলে মনে করছে নগরবাসী। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের এ নগরীতে সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত জনজীবন বসবাসের উপযোগী করে রাখতে হলে সমন্বিত ও সঠিক পরিকল্পনায় এগিয়ে নিতে হবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বিআরটিএ, বিএসটিআইসহ নগর ও নাগরিক জীবনের উন্নয়নে যাদের দায়িত্ব আছে তাদের সব বিভাগকেই সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে সঠিক ও কর্মমুখী স্বাস্থ্যবান, চিন্তাশীল, মেধাবী জাতি হিসেবে তৈরি করতে হলে অবশ্যই সব প্রশাসনিক বিভাগের সমন্বয় থাকতে হবে। খাদ্যে ভেজাল, ওজনে কারচুপি, সব খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে নাগরিক জীবনের সুরক্ষায় প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।
লেখক : সংগঠক, কলামিস্ট, সভাপতি, বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ ফাউন্ডেশন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন