বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের এখনই সময়

অ ভি ম ত

অধ্যাপক মো. মোস্তফা কামাল | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রোহিঙ্গা সংকট এখন আর মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কোন সমস্যা নয়, বরং বৈশ্বিক সমস্যা। এর চরম ভুক্তভোগী বাংলাদেশ। দীর্ঘকাল ধরে অত্যাচার-জুলুমের সব সীমা ছাড়িয়ে এখন স্পষ্ট হয়েছে, মিয়ানমার একটি জাতিকে নির্মূলে গণহত্যা চালাচ্ছে। যারা কোনো মতে পালিয়ে আসতে পেরেছে তারা জান বাঁচাতে পেরেছে। জান বাঁচাতে দলে দলে বাংলাদেশের দিকে আসছে। বাংলাদেশ পড়েছে উভয় সংকটে- এই হতভাগ্য মুসলিমদের আশ্রয় না দিয়েও পারছে না; আবার জনবহুল ক্ষুদ্র দেশের পক্ষে শরণার্থীর বিশাল বোঝা বইতেও পারছে না।

বাংলাদেশের আমজনতার দাবি, বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। দীর্ঘদিন বাংলাদেশের বলিষ্ঠ ভূমিকার অভাবে বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেভাবে উপস্থাপিত হয়নি। ফলে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক মহলকে অন্ধকারে রেখে দরজা বন্ধ করে ইচ্ছামত খায়েশ মিটানোর সুযোগ পেয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে মুসলিমদের গণহারে মেরে লাশগুলোকে জ্বালিয়ে দিয়ে গণহত্যার চিহ্নগুলোও মুছে দিতে চেয়েছে। কেউ কেউ প্রাণ ভয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে ভেসে গেছে। নাফ নদীতে শত শত লাশ ভেসে এসেছে। কেউ কেউ নৌকা দিয়ে কোনমতে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে এবং প্রধান শিরোনাম হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টি চলে আসার কারণে বাংলাদেশের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে রোহিঙ্গা সংকটের সঠিক সমাধানের। বাংলাদেশের দৃঢ় সিদ্ধান্ত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ মজলুম রোহিঙ্গাদের শান্তি এনে দিতে পারে। বাংলাদেশ পারে বোঝামুক্ত হতে। কামারের হাপড়ে লোহা যখন লাল রঙ ধারণ করে তখনই হাতুড়ির আঘাতে কাঙ্খিত যন্ত্রে রূপ দেয়া যায়, বিলম্বে অজস্ত্র হাতুরি পেটালেও কাজ হয় না। রোহিঙ্গা ইস্যুটির বিষয়ে বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসীর সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই। মিয়ানমারকে চাপে ফেলে বাধ্য করার সুযোগ এখনই।
রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাংলাদেশের গরজ বেশি হওয়ারই দরকার। এখানে শরণার্থী যা আছে, তার চেয়ে আরো বেড়ে যাবে। মিয়ানমার এদের ফেরত নেয়ার চিন্তাই করবে না। ফেরত যাতে না যেতে পারে সে জন্য পথে পথে মাইন পুঁতে রাখছে। বাংলাদেশ এদের কী করবে? যুগ যুগ ধরে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে রেখে পালনের সামর্থ্য তার কতটুকু আছে? এই সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হলে এর বোঝা এবং ভোগান্তি ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, বাংলাদেশকেই ভোগতে হবে। সুতরাং নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে কারো মুখের দিকে চেয়ে নয়, নিজের সামর্থ্য ও পরিণতির দিকে চেয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপসহ অনেক দেশ দূরের হওয়া সত্তে¡ও মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ থেকে এগিয়ে আসছে। জাতিসংঘও কিছু চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এদের একমাত্র মুসলিম প্রতিবেশী দেশ; তাই বাংলাদেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে গেলেই এর সমাধান সম্ভব। তা ছাড়া ১৯৭১ সালে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার তথা আরাকান এলাকার মুসলিমরাও আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। এ কারণেই ১৯৭১ সালের ১৮ জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বার্মার জনগণ ও সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ- দলীল পত্র: ৩য় খন্ড পৃ. ৫৩)
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান বলেছেন, মিয়ানমার দীর্ঘ দিন ধরে একলা চলে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক চাপকে তারা খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না। ‘নিজস্ব প্রচুর সম্পদ তারা পেয়েছে। চীন তাদের পক্ষে জাতিসংঘে ভেটো দেয়। তাদের যে সামরিক কর্তৃত্ব, সত্তর বছর ধরেই তারা বল প্রয়োগ করে দেশটাকে এক করে রেখেছে।’ তবে সামরিক পদক্ষেপের হুমকি দিয়ে মিয়ানমারকে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে বলে মনে করেন প্রফেসর শাহীদুজ্জামান।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে ইন্দোনেশিয়া আর তুরস্ক মিলে একটি সামরিক জোট করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এই কোয়ালিশনের (জোট) মাধ্যমে সরাসরি যদি মিয়ানমারকে হুঁশিয়ারি দেয়া যায় যে, পরিণতি অত্যন্ত শোচনীয় হবে এবং যদি তারা উইথড্র না করে নেয় তাহলে সামরিক পদক্ষেপ অসম্ভব কিছু না, এই ধরনের চাপ সৃষ্টি করা, সেটা মিয়ানমারের সামরিক নেতারা এই ভাষাকেই বুঝবে। এই ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে তারা মোটেই গুরুত্ব দেবে না।’ অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, ‘বাংলাদেশ এটা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অবশ্যই আনতে পারে। এবং আনা প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।’
ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো জাকার্তায় রাষ্ট্রীয় প্রাসাদে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাখাইন সংকট সমাধানে বাস্তব অ্যাকশন দরকার, শুধুমাত্র সমালোচনামূলক বিবৃতিতে কাজ হবে না। অব. ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাখাওয়াত হোসেন এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, অনেকে সামরিক সমাধানের কথা বলছেন। একুশ শতকে বাংলাদেশের মতো কোনো দেশ বা অন্য কোনো দেশ এককভাবে সামরিক সমাধান করতে পারবে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেসব অঞ্চলে সামরিক সমাধান হয়েছে সেখানে জাতিসংঘের সমর্থনে হয়েছে। ধরুন, একটি সেফ জোন বা নো ফ্লাই জোন তৈরি করা। কিংবা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের মতো বিষয় আসতে পারে। এর আগে কসোভো, বসনিয়া-হারজেগোভিনায় হয়েছে। এ রকম পরিস্থিতি মিয়ানমারে তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি। কারণ, একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে।
পরিশেষে বলব আজকে রোহিঙ্গাদের উপর যা চলছে তা মুসলিম পরিচয়ের কারণেই। মানচিত্রে ওদের পাশে যে দেশগুলো আছে ভারত, চীন, লাওস, থাইল্যান্ড এবং বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ছাড়া এদের পাশে আর কোন মুসলিমদেশ নেই অন্তত মুসলিমদেশ হিসেবেও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেও একটা দায়িত্ব আছে। সুতরাং প্রতিবেশী, মানবতাবোধ, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সর্বোপরি রোহিঙ্গা সংকটে চরম ভুক্তভোগী দেশ হিসেবে জোরালো কূটনীতি, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন অথবা সামরিক জোট গঠন করে, যেভাবেই হোক বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দীর্ঘদিনের অশান্তির আগুনে শান্তির ফুল ফোটাতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: অধ্যাপক, খাড়াতাইয়া ইস
ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, কুমিল্লা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন