শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

নাফের পাড়ে লাখো আদম সন্তানের হাহাকার

অ ণু নি ব ন্ধ

আলী এরশাদ হোসেন আজাদ | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নাফের ঢেউয়ে ভাসছে ধর্ষিতা ও নিঃষ্পাপ শিশুর লাশ। উত্তাল নাফে ভেসে রামু-উখিয়ার পাহাড় পেরিয়ে সাপদ-শঙ্কুল অজ্ঞাত বন-বনানীর ভেতর দিয়ে অসুস্থ-অন্তঃসত্বা, নিপীড়িত-ক্ষুধার্ত লাখ লাখ বনি আদম বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতো আছড়ে পড়ছে। নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সুচির ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ তত্তে¡ উজ্জীবিতদের দেশ মিয়ানমারের জাতিসংঘ ঘোষিত ‘বিশ্বের সব চেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী’র নাম রোহিঙ্গা। দয়াময় আল্লাহর ‘রহমান’ নাম থেকে রোহিঙ্গা শব্দের উৎপত্তি। ৬৫২-৬৬০ খ্রিস্টাব্দে অথবা নবম শতাব্দিতে বর্তমান মিয়ানমারে ইসলাম ও মুসলমানদের আগমন ঘটে। এখনো লাখ লাখ রোহিঙ্গার প্রিয় স্বদেশ, জন্মভূমি রাখাইন-আরাকান এলাকা। লোককথায় আছে, সপ্তম শতাব্দিতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজের জীবিত কিছু মানুষ বহু কষ্টে উপকূলে আশ্রয়ের জন্য বলতে থাকে ‘রহম’ ‘রহম’ এবং একটু নিরাপদ হয়ে বলে: ‘আল্লাহ্র রহমে বেঁচে গেছি’। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল জুড়ে রোহিঙ্গাদের স্বাধীন আরকান রাষ্ট্র ছিল। সেখানে ইসলামি স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত ছিল। মুদ্রাগুলোর এক পাশে বার্মিজ ও অন্য পাশে আরবি-ফার্সি ভাষা খচিত ছিল। রোহিঙ্গাদের নৃতাত্বিক পরিচয় প্রসঙ্গে মহাকবি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’তে আছে:

নানাদেশি নানা লোক শুনিয়া রোসাঙ্গ ভোগ আইসন্ত (আসিল) নৃপ ছায়াতল
আরবি, মিশরি, সামি, তুর্কি, হাবসি ও রুমি, খোরাসানি, উজবেকি সকল।
লাহোরি, মুলতানি, সিন্ধি, কাশ্মিরি, দক্ষিণি, হিন্দি, কামরূপি আর বঙ্গদেশি
বহু শেখ, সৈয়দজাদা, মোগল, পাঠান যোদ্ধা রাজপুত হিন্দু নানা জাতি...।
বিশ্বব্যাপী অভিবাসন প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ধারায় আরাকানে বসবাসকারী মুসলিমদের নাম দখলদার ব্রিটিশ শাসকরা তৎকালীন বার্মার জনসংখ্যা তালিকায় লিপিবদ্ধ করেনি বিদ্বেষ-বৈষম্যের চিরায়ত অভ্যাসে। এভাবেই রোহিঙ্গারা হয়ে যায় ঠিকানাবিহীন মানবগোষ্ঠী।
১৯৬২ সালে বার্মায় জেনারেল নে উইনের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এক এক করে রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, নামায আদায়ের সুযোগ, সহায় সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার পাশপাপাশি বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। বঞ্চিত করা হয় শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বিয়ে ও সন্তান জন্মের অধিকার থেকেও। বিপন্ন রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ তাদের সীমিত সামর্থ্যরে সবটুকু উজাড় করে সহানুভূতিশীল অবস্থান নিয়েছেন। ইসলামি ভ্রাতৃত্ব ও সংহতির চেতনায় মানুষের পারস্পরিক বন্ধনকে পবিত্র কুরআনে ‘বুনিয়ানুম্ মারসুস্’ বা ‘সিসা ঢালা প্রাচীর’ তুল্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মু’মিনগণ পরস্পর ভাইভাই’ (হুজরাত: ১০)। এমন দায়বদ্ধতাকে প্রিয়নবী (স.) ‘একদেহ তুল্য’ ও ‘একই আদমের সন্তান তুল্য’ বলেছেন। তীব্র মানবিক সংকটে নাকাল রোহিঙ্গারা। সবই রয়েছে অনিশ্চয়তা অতল অন্ধকারে। তারা নিরাপদ আশ্রয় ও খাবারের অভাবে দিশাহারা। সামর্থ্যবানদের কর্তব্য হলো মানবসেবার ব্রতে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানো। মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘তারা আল্লাহ্র প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দরিদ্র, ইয়াতিম ও বদেীদেরকে খাদ্য দান করে’ (দাহার: ০৮)। বিপন্ন মানবতার সেবায় উৎসাহ দিয়ে প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘মানুষের মধ্যে সে-ই উত্তম যার দ্বারা মানবতার কল্যাণ সাধিত হয়।’
মানবিক দায়িত্ববোধে একজন মুসলমানের সব ইচ্ছা ও তৎপরতা ‘ইবাদত’ তুল্য হয়ে ওঠে, যখন তাতে দুর্গতের সেবা, অভাবীর অভাব মোচন, রুগ্নের শশ্রুষা, মৃতের সৎকার ইত্যাদি ভাবনা প্রাধান্য পায়। প্রিয়নবী (স.) বলেন, ‘তুমি মু’মিনগণকে পারস্পরিক করুণা প্রদর্শন, পারস্পরিক সহানুভূতি প্রদর্শনের দিক থেকে একই দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। যখন দেহের কোন একটি অঙ্গ কষ্ট অনুভব করে তখন গোটা দেহটাই জ্বর-নিদ্রাহীনতা দ্বারা এর প্রতি সাড়া দিয়ে থাকে’ (বুখারি-মুসলিম)। বস্তুতঃ রোহিঙ্গাদের প্রতি চরম অবহেলা ও নির্যাতন মানবতার কলঙ্ক এবং একটি বৈশ্বিক লজ্জা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইসলামিক স্টাডিজ, কাপাসিয়া ডিগ্রি কলেজ, গাজীপুর

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন