শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মিল মালিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই চালের বাজারে শৃঙ্খলা ফেরানোর ইঙ্গিত বাণিজ্যমন্ত্রীর

চাল ব্যবসায়ী-মন্ত্রীদের বৈঠকে কথা কাটাকাটি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার : | প্রকাশের সময় : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সমস্যা সমাধানের আশ্বাসে চালের দাম কমানোর ঘোষণা ব্যবসায়ীদের বাধ্যতামূলক চটের বস্তায় চাল আমদানি ৩ মাসের জন্য স্থগিত
চালের অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাল ব্যবসায়ী ও মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছেন চাল ব্যবসায়ীরা। বৈঠকে কারসাজির অভিযোগের বিষয়টি তুলে সভার শুরুতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল বলেন, দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই এবং সারা দেশে প্রায় এক কোটি টন চাল আছে, ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। খাদ্যমন্ত্রীর জবাবে জয়পুরহাট চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল বারী বলেন, ‘খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, আমরা কৃত্রিম সঙ্কট করেছি। কী ধরনের সঙ্কট আমরা করেছি? তা আমাদের এক্সপ্লেইন করেন।’ এ সময় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল কিছু বলতে গেলে চরম হট্টগোলের সৃষ্টি হয়। কয়েকজন ব্যবসায়ী একসঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেন। খাদ্যমন্ত্রীর ওপর ক্ষোভও প্রকাশ করেন তারা। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ খাদ্যমন্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে সভা সঞ্চালনার দায়িত্ব নেন। তিনি এ সময় মিল মালিকদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই চালের বাজারে শৃঙ্খলা ফিরানোর ইঙ্গিত দেন। তবে পরবর্তীতে সরকারের কাছ থেকে ‘বেশ কয়েকটি সমস্যার সমাধানের’ আশ্বাস পেয়ে চালের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন চাল ব্যবসায়ীরা।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সরকারের তিনজন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের এক পর্যায়ে বক্তব্য দেয়াকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটি এবং চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চাল ব্যাবসাযীদের সঙ্গে এ বৈঠক হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সভা চলাকালে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করেন চাল ব্যবসায়ীরা। এক পর্যায়ে বক্তব্য দিতে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সরকার সমর্থিত পক্ষের সভাপতি খোরশেদ আলম। এ সময় অপর পক্ষের নেতা আব্দুর রশিদ ও লায়েক আলী খোরশেদ আলমকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তিনি সরকারের দালাল। তিনি সরকারকে বিভ্রান্ত করছেন। এ পর্যন্ত এক ছটাক চাল সংগ্রহ করতে তিনি সরকারকে সাহায্য করেননি। ফলে তার এখানে সরকারকে সহযোগিতা করার কোনও সুযোগ নেই।
আব্দুর রশিদ ও লায়েক আলীর সমর্থক ব্যবসায়ীরা খোরশেদ আলমের উদ্দেশ্যে বলেন, দালালি ছাড়েন, সরকারের গুদামে চাল দেন। এটিই হবে সরকারের বড় সহযোগিতা। পরে খোরশেদ আলম আর বক্তব্য দিতে পারেননি।
বৈঠক সুত্রে আরও জানা যায়, শুরুতেই চাল ব্যবসায়ীরা চাল আমদানিতে চটের বস্তা ব্যবহারে সরকারি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তুলে ধরেন। তারা বলেন, চটের বস্তায় চাল আমদানি করলে প্রতি কেজিতে এক টাকা খরচ রাড়ে। আর প্লাস্টিকের বস্তায় খরচ হয় মাত্র ১৫/১৬ পয়সা। যদি চটের বস্তা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করা হয় তবে আমদানিতে প্রতি কেজি চালের দাম দুই টাকা কমবে।
ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যমন্ত্রীকে বলেন, ‘সংকট কাটাতে চাল আমদানির শুল্ক দেরিতে কমানো হয়েছে। এছাড়া চাল ও ধান সংগ্রহে সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে তা অনেক কম। তখন যদি চালের দাম ৩৪ টাকা নির্ধারণ না করে ৪০ টাকা করা হতো তবে আমরা অনেক চাল দিতে পারতাম।’
বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ দেশের চাল সংকট মোকাবিলা করতে চাল ব্যবসায়ীদের যেকোনো উপায়ে চাল আমদানির নির্দেশ দেন। মিল মালিকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেই চালের বাজারে শৃঙ্খলা ফিরাতে কাজ করবে সরকার। সেই সাথে চালের দাম কমাতে চাল সংরক্ষণ ও পরিবহনে প্লাস্টিকের বস্তা ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারেরও ঘোষণা দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে চটের বস্তায় চাল আমদানির সরকারি বাধ্যবাধকতার সিদ্ধান্ত আগামী তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হলো। এখন যে যেভাবে পারেন চাল আনেন। আমি এনবিআর ও কাস্টমসকে বলে দিচ্ছি। কেউ বাধা দেবে না। এছাড়া ভারত থেকে জিটুজি পদ্ধতিতে চাল আমদানি করতে আমি নিজে কথা বলবো। ভারত থেকে ট্রেনে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রোহনপুর দিয়ে চাল আনার জন্যও পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান তোফায়েল।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘দেশটা আমাদের। আমরা আপনাদের, আপনারা আমাদের। আসুন আমরা হাতে হাত মিলিয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই।’
প্রসঙ্গত, ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’ অনুযায়ী ধান-চাল পরিবহন ও সংরক্ষণে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
গত রোববার সচিবালয়ে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছিলেন, বৈঠকে চাল ব্যবসায়ীদের কাছে সংকটের মূল কারণ জানতে চাওয়া হবে। যদি চাল সংকটের জন্য কারও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর বৈঠকে উপস্থিত বেশ কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী বলেন, দুই-এক দিনের মধ্যেই চালের দাম কমতে শুরু করবে।
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বুধবার থেকে সারা দেশের প্রতিটি উপজেলায় খোলা বাজারে (ওএমএস) চাল বিক্রির কার্যক্রম চালু হবে। তাই খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি (১০ টাকা কেজি দরে) সাময়িকভাবে স্থগিত থাকবে।’ কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী দেশে এক কোটি টন চাল মজুত আছে জানিয়ে অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা মোটা চাল মেশিন দিয়ে কেটে মিনিকেট বানান। ব্যবসায়ীরা তাঁর এ বক্তব্যেরও প্রতিবাদ করেন।
সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি যখন খাদ্যমন্ত্রী ছিলাম, তখন ভারত থেকে চাল আমদানি করতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মাত্র পাঁচ লাখ টন চাল আনার চুক্তি করেও কোনো চাল আনতে পারিনি। পরে ভিয়েতনাম থেকে চাল এনে সঙ্কট মোকাবেলা করেছি।
চালের দাম অচিরেই সহনীয় পর্যায়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
দুই দফা বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি চালের মজুদ তলানিতে নেমে আসায় সরকার তিন মাস আগে আমদানির উদ্যোগ নেয়। সেইসঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি উৎসাহিত করতে ২৬ শতাংশ থেকে শুল্ক নামিয়ে আনা হয় দুই শতাংশে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায় মিলিয়ে গত আড়াই মাসে রেকর্ড পরিমাণ চাল আমদানি হলেও বাজারে চালের দাম বাড়ছে, যার পেছনে মিল মালিকদের কারসাজিকে দায়ী করে আসছে সরকার। সরকারি হিসেবেই মোটা চালের দাম গত এক মাসে বেড়েছে ১৮ শতাংশ, এক বছরে বেড়েছে ৫০ শতাংশ। এখন বাজারে ৫০ টাকার নিচে কোনো মোটা চাল নেই। ধারাবাহিকভাবে চালের দাম বৃদ্ধির মধ্যে মজুদদারি বন্ধে শাসন গত সপ্তাহে বিভিন্ন রাইস মিলে অভিযান শুরু করে। কুষ্টিয়ার খাজানগরে চালকল মলিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রশিদের চালকলে অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করা হয়। রশিদকে জরিমানা করার পর এই কদিনে মিনিকেট চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চারশ টাকার মতো বেড়ে যায়; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে অন্য চালেরও দাম।
বৈঠকের পর অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভালো একটি বৈঠক হয়েছে। দু’এক দিনের মধ্যেই চালের দাম কমতে শুরু করবে।
সভায় জয়পুরহাট চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল বারী বলেন, চাল আমদানির ট্যারিফ কমানো নিয়ে আপনাদের সিদ্ধান্ত রং (ভুল) ছিল। দেশে চালের সঙ্কট হওয়ায় আপনারা ট্যারিফ কমাচ্ছেন আর ইন্ডিয়া চালের দাম বাড়াচ্ছে। তাহলে ট্যারিফ কমিয়ে কী লাভ হল?
‘কৃষিমন্ত্রী যদি বলেন আমি কৃষকদের ন্যায্য দাম দেব। বাণিজ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী বলেন আমরা ট্যাক্স কালেকশন করব। খাদ্যমন্ত্রী মহোদয় যদি বলেন আমি দাম কমাব। পাট প্রতিমন্ত্রী যদি বলেন আমি পরিবেশ রক্ষা করব। তাহলে কি স্যার আপনার প্রকিউরমেন্ট হবে?’
পৃথিবীতে কোন দেশে পাটের বস্তায় বেচাকেনা হয়- এই প্রশ্ন রেখে আমিনুল বলেন, ট্যারিফ কমানো যুক্তিযুক্ত হয়নি, সময়মতো একেবারে সব তুলে দেওয়া যেত।
এই সভাটি আগেই হওয়া প্রয়োজন ছিল উল্লেখ করে রশীদ বলেন, সরকারি গুদামে চাল দিতে আমরা দাম একটু বাড়িয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম, কিন্তু দাম বাড়ানো হয়নি। আমরা লস দিয়ে হলেও চুক্তির বেশির ভাগ চাল সরবরাহ করেছি। চিত্ত মজুমদার নামে একজন চাল আমদানিকরক বলেন, শুল্ক কমানোর ঘোষণার পরে তা বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় ভারতে অনেক চালের ট্রাক অনেক দিন অপেক্ষা করেছে। এ সময়ই চালের দাম বেড়েছে। “সরকার ভারত থেকে বেশি দামে চাল আমদানি করছে। আমাদের দায়িত্ব দিলে আমরা সরকারের চেয়ে কম দামে ভারত থেকে চাল এনে দিতে পারতাম।”
জাহাজ, ট্রাক ও ট্রেনে করে চাল আনার তাগাদা দিয়ে চিত্ত মজুমদার চাল আমদানি ও পরিবহনে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার দাবি জানান। দিনাজপুরের জহুর অটো রাইস মিলের মালিক আব্দুল হান্নান বলেন, চালের আমদানি শুল্ক কমাতে গিয়ে অনেক সময় নেওয়া হয়েছে। ধাপে ধাপে কমানো হয়েছে। এসব কারণে দাম বেড়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অটো, মেজর ও হাস্কিং রাইচ মিল আছে ২০ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ৪০০ অটো রাইস মিল মালিকদের নেতা সরকার সমর্থিত খোরশেদ আলম। বাকি ১৯ হাজার ৬০০ মিল মারিকদের নেতা আব্দুর রশিদ ও লায়েক আলী। বৈঠকে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ও খাদ্য সচিব মোহাম্মদ কায়কোবাদ উপস্থিত আছেন। এছাড়া ব্যবসায়ী পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক পক্ষের সভাপতি আব্দুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী, অপর গ্রুপের খোরশেদ আলম খান, মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল, সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানসহ বিভিন্ন চাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নেতারা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন