বাংলাদেশে আসা লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গার মাঝে ত্রাণ বিতরণ ও তাদের পুনর্বাসনে গতকাল থেকে সেনাবাহিনী কাজ শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুদিন আগে জানিয়েছিলেন, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কাজে সেনাবাহিনী সহযোগিতা করবে। সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়। অবশ্য ত্রাণ কার্যক্রম সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার জন্য বেশ আগে থেকেই দেশের নাগরিক সমাজ ও বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার আহŸান জানানো হয়। এ কাজে সেনাবাহিনী নিয়োগ করায় আশা করা হচ্ছে, এতদিন ধরে দেশি-বিদেশি এবং বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে যে সমন্বয়হীন ও বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চলছিল, তাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। আমরা বিগত প্রায় এক মাস ধরে লক্ষ্য করেছি, আশ্রয়হীন লাখ লাখ রোহিঙ্গা তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে। ব্যক্তি বা সংগঠন পর্যায়ে কেউ ট্রাক বা গাড়িতে করে ত্রাণ নিয়ে গেলে সেখানে ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গাদের মাঝে খাদ্য সংগ্রহে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। হুড়োহুড়ির কারণে ত্রাণ বিতরণ সুষ্ঠুভাবে করা যাচ্ছিল না। ত্রাণবাহী গাড়ি দেখলেই দলে দলে রোহিঙ্গারা ঘিরে ধরছে এবং ত্রাণ নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে চলন্ত গাড়ি থেকেই খাবারের প্যাকেট ছুঁড়ে দিতে দেখা গেছে। এতে কেউ খাবার পেত, কেউ পেত না। অনেকের মধ্যে খাবারের প্যাকেট নিয়ে মারামারি করতেও দেখা গেছে। পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় এবং তা শৃঙ্খলার মধ্যে আনা জরুরী হয়ে পড়ে। এ কাজে সেনাবাহিনী নিয়োগের বিষয়টি শুধু কাক্সিক্ষতই ছিল না, অনিবার্যও হয়ে পড়েছিল। অবশেষে সরকার সেনাবাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়ায় সকল মহলই সাধুবাদ জানিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
লাখ লাখ রোহিঙ্গার মাঝে সুষমভাবে ত্রাণ বিতরণ অত্যন্ত জটিল ও কঠিন একটি কাজ। সিভিল প্রশাসন, দলীয় লোকজন ও সাধারণ মানুষের পক্ষে এ কাজ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করা সম্ভব নয়। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ ও সুশৃঙ্খল বাহিনী। বলা বাহুল্য, এক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই। আমাদের সেনাবাহিনী জাতীয় যে কোনো দুর্যোগে ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কাজ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সুচারুভাবে করার নজির ইতোমধ্যে স্থাপন করেছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও এ বাহিনী তার দক্ষতা প্রমাণ করেছে। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে নিয়োজিত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেনাবাহিনী ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসন কাজে যে সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে, তা বিশ্বে বিপুলভাবে প্রশংসা পেয়েছে। দেখা গেছে, যেসব কাজে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং প্রশ্নাতীতভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজেই নয়, দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে এ বাহিনীর সুনাম রয়েছে। হাতিরঝিল, বনানী ফ্লাইওভার নির্মাণ থেকে শুরু করে যেসব অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেয়া হয়েছে, সেগুলো যথাসময়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। দেশে যে রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, তা কোনো সাধারণ সমস্যা নয়। দেশের জন্য এ এক জটিল সমস্যা। লাখ লাখ রোহিঙ্গার পুনর্বাসন এবং ত্রাণ বিতরণ সহজ কাজ নয়। এতদিন বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে কী অবর্ণনীয় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সরকারের সিভিল প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সঠিকভাবে ত্রাণ কার্যক্রম তো হয়ইনি, বরং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এবং অশেষ ভোগান্তির উদ্ভব হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে আসা বিপুল ত্রাণ সংরক্ষণ এবং বিতরণের জন্য একটি সুষম ও সমন্বিত প্রক্রিয়া অত্যাবশ্যক। ইতোমধ্যে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সুযোগ সন্ধানীরা ত্রাণ সামগ্রী তসরুফের পায়তারা শুরু করেছে। সুষম ও সঠিকভাবে ত্রাণ বিতরণ করা সম্ভব না হওয়ায় অনেক অসহায় রোহিঙ্গা বঞ্চিত হচ্ছে। এতে দুর্ভোগ যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি সামগ্রিক পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনী নিয়োগ ছাড়া ভিন্ন কোনো পথ খোলা ছিল না।
আমাদের সেনাবাহিনী দেশ ও জনগণের যে কোনো সেবায় বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সব ধরনের বিতর্কের উর্ধ্বে থেকে দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে কর্ম সম্পাদন করে আসছে। দেশের মানুষেরও এ বাহিনীর উপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনী নিয়োগ করায় সাধারণ মানুষ আশ্বস্থ হয়েছে। জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, একমাত্র সেনাবাহিনীর পক্ষেই সম্ভব সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা। সেনাবাহিনী নিয়োগ করায় অচিরেই এর সুফল মিলবে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শৃঙ্খলা যেমন ফিরে আসবে, তেমনি ত্রাণ প্রাপ্তি থেকে কোনো রোহিঙ্গাই বঞ্চিত হবে না। ত্রাণ নিয়ে অসাধু চক্রের অপতৎপরতাও থাকবে না। পাশাপাশি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। শুধু ত্রাণ বিতরণই নয়, রোহিঙ্গাদের সাময়িক পুনর্বাসনের একটা বিশাল কাজও অপেক্ষা করছে। বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে এ কাজ করা বাস্তব কারণেই কঠিন ও দুরূহ। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীই একমাত্র বিকল্প। আমরা আশা করি, সেনাবাহিনী অর্পিত দায়িত্ব সুচারু রূপে সাফল্যের সঙ্গে পালন করতে পারবে। সেনাবাহিনীর জন্য বিপন্ন মানুষের সেবা করার এটা একটা বড় সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেনাবাহিনী তার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করবে, এটাই একান্ত প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন