মহা বিজয়ের বিবরণ: তুর্কী মুসলমানদের সমূলে বিনাশসাধনের অসৎ উদ্দেশ্যে রোমান সম্রাট যে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র করেন, সে জন্য তিনি তার অর্থভান্ডার বিলিয়ে দিয়েছিলেন বলে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন। সে লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে মালাজিকার্দে বিশাল সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন এবং হামাদান ইস্পাহানে তার কল্পিত বিজয়ের পর অবস্থানের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। সুলতান আল্প আরসালান তা সঠিকভাবে উপলদ্ধি করেছিলেন। তাই তিনি শত্রু বাহিনীর সাথে রণাঙ্গনে মোকাবিলায় অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে তার ক্ষুদ্র বাহিনীর উদ্দেশ্যে দুইটি ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। একটি ঘোষণা ‘খুভে’ নামক স্থানে সামরিক কমান্ডারদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন যে, এই স্থানটি হামলা চালানোর জন্য মূল ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। দ্বিতীয় সাধারণ ঘোষণা করা হয়েছিল সামরিক জোওয়ানদের লক্ষ্য করে ভাষণ দানকালে। সাময়িক সেনা প্রধানদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা অঙ্গীকারবদ্ধ ও অনুগত থাকবে এবং অত্যন্ত ধৈর্য্য, সংযম, দৃঢ়তা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করবে। হতে পারে এই যুদ্ধ অত্যধিক সাহসিকতাপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী। স্মরণ থাকে যেন, বিজয় কামিয়াবী আল্লাহর হাতেই এবং তাঁর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে হবে। আমি যদি যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করি, তখন সকলে নেতা মালিক শাহের নিকট সমবেত হয়ে যাবে এবং তার অনুগত থাকবে এবং তাকেই আমার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সিংহাসনে বসাবে। সুলতানের এদুটি ঘোষণাকে রাজনৈতিক ফরমান হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে আরো প্রমাণিত হয় যে, সুলতান এক মহাবিপদের মোকাবিলা করার জন্য কত দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ও স্থির মনোভাব পোষণ করতেন, তা ছিল তার পথপ্রদর্শক স্বরূপ। আল্প আরসালানের ঘোষণার দ্বিতীয় দিকটি ছিল এটি কোনো সামরিক রাজনৈতিক অথবা সীমিত আকারের জাতীয় যুদ্ধ নয়, বরং এমন একটি জেহাদ, যার সাথে সমগ্র ইসলামী বিশ্বের স্বার্থ জড়িত। বিশাল সেলজুকী সা¤্রাজ্যের কেবল নিরাপত্তা নয়, বরং ইসলাম ধর্মের নিরাপত্তাও বটে।
মালাজিকার্দ যুদ্ধের পটভূমিকা কোনো কোনো ইতিহাসে এইভাবে বর্ণিত হয়েছে। আল্প আরসালানের রাজত্বকালে রোম সম্রাট ‘মম্বাজ’ নামক স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করেন। সেখানকার সকল সৈন্যকে হত্যা করার পর অধিবাসীদেরকেও হত্যা করেন। অতঃপর লুটতরাজ করা হয়। সুলতান আল্প আরসালান এ ভয়াবহ ঘটনার খবর পেয়ে সৈন্যবাহিনী নিয়ে যাত্রা করেন। পথে খবর পান যে, রোমানদের বিশাল বাহিনী সাম্রাজ্য হতে ‘খালাত’ অবরোধের জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এ জন্য তারা আজারবাইজানের পথ অনুসরণ করে।
প্রথমে রোমানদের কুড়ি হাজার সৈন্য খালাতে সমবেত হয়। হিজরী ৪৬৩ সালের জিলকদ মাসে সেখানকার সৈন্যরা বের হয়ে তাদেরকে পরাজিত করে কিন্তু যখন সমগ্র রোমান বাহিনী সেখানে পৌঁছে যায় তখন সেলজুকী বাহিনী শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রোমানরা মালাজিকার্দ ছাউনি (সেনানিবাস) দখল করে নেয়।
ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে, রোমান সম্রাট রোমানু তার সৈন্য বাহিনীতে খ্রিস্টানদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং তারা সবাই ছিল রাশিয়া, বুলগেরিয়া এবং গ্রিকের। অনুরূপভাবে জর্জিয়া ও ফ্রান্সের সৈন্যরাও ছিল। রোমান সম্রাট রোমানুসের বিশাল বাহিনীর মোট সৈন্য সংখ্যা ৬ লাখ মতান্তরে ৩ লাখ কিংবা ২ লাখ যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। রোমানুস তার বাহিনী সহকারে আক্রমণের উদ্দেশ্যে খালাত (মতান্তারে আখলাত) শহরের নিকটবর্তী মুসলিম সেনানিবাস মালাজিকার্দে উপস্থিত হন এবং তা অবরোধ করেন।
ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা করেছেন যে, সুলতান আল্প আরসালান যখন জানতে পারেন যে, রোমানরা মালাজিকার্দে ছাউনি অধিকার করে নিয়েছে এবং শহর অবরোধ করে রেখেছে, তখন তিনি দ্রুততার সাথে অগ্রসর হতে থাকেন এবং তার সৈন্য বাহিনীর আগমণেরও অপেক্ষা করছিলেন না। তার আশা ছিল যে, এ যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করবেন। ৬ জিলকদ বৃহস্পতিবার তিনি মালাজিকার্দের খালাতের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং একইদিন রোমান সম্রাটের নামে একখানা পত্র প্রেরণ করেন।
অপর বর্ণনা অনুযায়ী আল্প আরসালান তার মন্ত্রী নিজামুল মুলকের সাথে পরামর্শ করেন। এটি তখনকার কথা, যখন তিনি খবর পান যে, রোমান বাহিনী মুসলিম বাহিনীর নিকটবর্তী হয়েছে। মন্ত্রী নিজামুল মুলক তুর্কী অত্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলেন যে, সাহায্য ও বিজয় আল্লাহর হাতে। সুলতান ও তার সংকল্পের কথা উল্লেখ করেন যে জুমার দিন জোহরের সময় দোয়া কবুল হয় এ সময় তিনি নামাজের পর শত্রুর মোকাবিলায় অবতীর্ণ হতে চান। তার এ সময়কার উক্তিটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর উদ্ধৃত করে বলেন, ‘ইন্নানি ওকাতিলু মোহতাসিবান, ছাবিরান, ফাইন সালিমতু ফানেমাতুন মিনাল্লাহি আলাইয়া। ইন্না ইবলি মালিক শাহ ওয়ালিয়্যু আহদি।’ অর্থাৎ আমি হিসাব করে ধৈর্য্যের সাথে যুদ্ধ করবো। যদি নিরাপদে ফিরে আসি তা হবে আল্লাহর পক্ষ হতে আমার জন্য সৌভাগ্য আর যদি শাহাদত বরণ করি, তাহলে আমার পুত্র মালিক শাহ হবে আমার উত্তরাধিকারী (আল-আহদ)। এ উক্তি দ্বারা আল্প আরসালান তার পরবর্তী সিংহাসনের অধিকারী তার পুত্র মালিক শাহ-এর নাম ঘোষণা করলেন।
পুর্বে বলা হয়েছে যে, সুলতান আল্প আরসালান মালাজিকার্দ এলাকায় পৌঁছার পর সেদিনই রোমান সম্রাটের নিকট পত্র প্রেরণ করেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন যে, আপনি সন্ধি চান, তাতে আমরা প্রস্তুত আছি, তা না হলে আল্লাহর ওপর ভরসা করে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবো। এর জবাবে দূতকে তিনি বলেছিলেন, ‘লা হুদ নাতা ইল্লা ফির রাইয়ে’ অর্থাৎ এ চিঠির জবাব আমি রায়য়ে পৌঁছে দেব। সম্রাট রোমানুসের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও অসদাচরণের কথা শুনে মুসলমানগণ দারুণভাবে বিক্ষুদ্ধ হন এবং তাদের অন্তরে উত্তেজনা ও ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠে।
ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে যে, শাহী সেনাবাহিনীর ইমাম আল্লামা আবু নমর মোহাম্মদ ইবনে আবদুল মালেক বোখারী সুলতানকে বলেন, যেহেতু আপনি জেহাদের উদ্দেশ্যে আগমন করেছেন এবং আল্লাহর ওয়াদা সত্য যে, তিনি মোজাহেদকে জয়যুক্ত করবেন। সুতরাং উত্তম হবে আপনি কাল (৬ জিলকদ) জুমার নামাজের পর তাদের (শত্রুর) মোকাবিলায় অবতীর্ণ হোন, যাতে সমগ্র মুসলমানদের দোয়া আপনি লাভ করবেন।
সুলতান আল্প আরসালান জুমার নামাজ তার সৈন্যদের সাথে পড়েন। তারা যুদ্ধের ময়দানে অবস্থান করছিল। জুমার নামাজের পর তিনি সৈন্যদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘সংখ্যায় কম, এ বিষয়ে আমরা কোন পরোয়া করি না। শত্রুর বিপুল সংখ্যায়ও আমরা ভীত নই। আমি আজ এমন সময়ে শত্রুর মোকাবিলায় অবতীর্ণ হতে যাচ্ছি, যখন আলমে ইসলামের সর্বত্র আমাদের বিজয় ও সাফল্যের জন্য দোয়া প্রার্থনা করা হচ্ছে। এখন দুটিমাত্র পথ আমাদের জন্য খোলা আছে, হয়তো আমরা বিজয় লাভ করে মহান উদ্দেশ্য হাসিল করব অথবা যুদ্ধে শাহাদাত লাভ করে জান্নাতের অধিকারী হবো। উভয় অবস্থা আমাদের জন্য সাফল্যের দিক। যারা এ উভয় অবস্থাকে পছন্দ করে তারা আমার অনুসরণ করবে। আজ এখানে হুকুমদাতা বলতে কোনো সুলতান নেই এবং এমন কোনো সৈন্যও নেই যার ওপর হুকুম আরোপ করা হবে। আজ আমি তোমাদের মতোই একজন, আমি সুলতান নই, বরং একজন মুসলমান মোজাহেদ হিসেবে তোমাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গণকে উত্তেজিত করছে। যারা আমার সঙ্গে থেকে আল্লাহর পথে নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত, জান্নাতের সুমহান স্থান লাভ করবে তারা এবং রণক্ষেত্র থেকে যারা মুখ ফিরিয়ে থাকবে, তারা জ্বলন্ত আগুনের অনির্বাণ শিখায় দগ্ধ হওয়ার অপমান বহন করতে থাকবে।’
কিছুক্ষণ পর সুলতান আল্প আরসালান অত্যাসন্ন মহাযুদ্ধের কারণগুলোর ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে মোজাহেদীনের ওপর ছেড়ে দেন যে, তারা এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করবে কিনা সেই সিদ্ধান্ত তাদের নিজেদেরই গ্রহণ করতে হবে। সুলতানের এ ঘোষণার ফলে মোজাহেদীনের অন্তরে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়ে যায় এবং তারা প্রাণ উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
দুপুরে সুলতান যুদ্ধ শুরুর পূর্বে শেষবারের মতো তার যুদ্ধ পরিষদের সভা ডাকেন এবং যুদ্ধ সংক্রান্ত গৃহীত পরিকল্পনা সম্বন্ধে সকল সেনাপতির মতামত জানতে চান। তিনি সৈন্যদের নিয়ে জুমার নামাজ আদায় করেন। উল্লেখ্য জুমার নামাজের পর সুলতান সৈন্যদের রীতিমত বিন্যস্ত করেন এবং তাদেরকে চার ভাগে ভাগ করেন। সর্বপ্রথম খোদ সুলতান রোমানদের মোকাবিলায় অবতীর্ণ হন। তিনি দাঁড়িয়ে তীর কামান এক দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং তুর্কী ঐতিহ্য প্রথা অনুযায়ী নিজের সাদা ঘোড়ার লেজে গাডা লাগান এবং স্বীয় তরবারি ও গুণ সামলিয়ে নেন। এর সাথে সাথে সকল সৈন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। সুলতান তখন সাদা পোশাক পরিহিত ছিলেন। এ পোশাকের প্রতি ইশারা করে তিনি বলেন, যদি আমি শহীদ হয়ে যাই, তাহলে এটিই হবে আমার কাফন। অতঃপর তিনি আল্লাহু আকবর এ তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করেন, জেহাদের স্লোগান উচ্চারণ, নিজের ঘোড়াকে হাট দিয়ে আগে বাড়ান এবং শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর সঙ্গে সঙ্গেই মোজাহেদীনের সকল সৈন্য সক্রিয় হয়ে উঠে এবং রণক্ষেত্র ধূলাবালিতে ছেয়ে যায়। যখন যুদ্ধের আগুন তীব্র আকার ধারণ করে তখন দ্বিতীয় বাহিনী পেছন হতে এসে যায়। রোমান বাহিনী বিক্ষিপ্ত হতে থাকে। সুলতানের চারটি বাহিনী চতুর্দিক হতে তাদেরকে ঘিরে ফেলে এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে।
মালাজিকার্দ যুদ্ধে সুলতান আল্প আরসালানের সেলজুকী বাহিনীর ঐতিহাসিক বিজয় এবং বাইজান্টাইন সম্রাট রোমানুসের বিশাল বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটনায় ইসলামী দুনিয়ার সর্বত্র বিশেষ করে রুহানী রাজধানী বাগদাদসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে মুসলমানগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দোৎসব পালন করেন বলে ইতিহাস হতে জানা যায়। এটি স্পষ্ট প্রমাণ যে, মালাজিকার্দ যুদ্ধে যে অপূর্ব বীরত্ব ও দুঃসাহসিকতার পরিচয় মুসলিম বাহিনী প্রদর্শন করে তাতে আল্লাহর সাহায্য এবং সমগ্র ইসলামী বিশ্বের পূর্ণ সমর্থন ছিল। এমন নজিরবিহীন যুদ্ধে প্রথম বারের মতো এক বিশাল সাম্রাজ্যের মহা প্রতাপশালী সম্রাট গ্রেফতার হয়ে সুলতান আল্প আরসালানের খিদমতে নীত হন।
(আগামীবারে সমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন