১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকা অবস্থায় আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ৫ম বিএমএ লং কোর্সে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হই এবং জানুয়ারি ১৯৮০ সালে চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য যোগদান করি। একই বছর অক্টোবর মাসে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ বিএমএ-তে কমান্ড্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন। সেখানেই সর্বপ্রথম একজন স্মার্ট, দক্ষ ও অত্যন্ত কড়া মেজাজের সেনা কর্মকর্তার দেখা পাই। বাস্তবে একজন কমান্ড্যান্ট (হান্নান শাহ) ও একজন জেন্টেলম্যান ক্যাডেট (আমি) এর অবস্থান আকাশ ও পাতাল দূরত্বে। আমাদের মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণের সময় তিনি অত্যন্ত কঠিন সামরিক ও মানসিক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করেন। বক্তৃতার সময় প্রায়ই বলতেন ‘কঠিন প্রশিক্ষণ, সহজ যুদ্ধ’। আমাদের ফায়ারিং প্রশিক্ষণের সময় প্রায়ই তিনি ফায়ারিং রেঞ্জে উপস্থিত থেকে আমাদের ফায়ারিং পর্যবেক্ষণ করতেন এবং উৎসাহ দিতেন, কারণ তিনি নিজেই একজন অত্যন্ত দক্ষ শুটার ছিলেন।
বিএমএ-তে ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে আমরা যখন সকালের শারীরিক প্রশিক্ষণের জন্য মাঠে একত্রিত হই তখন আমাদের অবাক করে বলা হলো, ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সকল ক্যাডেট নিজ নিজ রুমে অবস্থান করবে’। সকাল আনুমানিক ১০টার সময় বিএমএ-র সকল ক্যাডেটকে একত্রিত করে ঘটনা জানানো হলো: Our President has been killed. সংবাদটি আমাদের কাছে এসেছিল আচমকা বজ্রপাতের মতো। আমাদের বুঝতে বাকী রইলো না যে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব চরম হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। পরবর্তীতে জানতে পারলাম, স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের মরদেহ লোকচক্ষুর অন্তরালে গুপ্তস্থানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন রাষ্ট্রপতির মরদেহ পাওয়া যাচ্ছিল না তখন হান্নান শাহ স্বউদ্যোগে নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকার বাইরে গিয়ে জিয়াউর রহমানের মরদেহ উদ্ধারের কাজে যুক্ত হন। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করা হলেও তার মরদেহ কোন গুপ্তস্থানে রাখা হয়েছে তা কেউ খুঁজে বের করতে পারেনি। সে সময় হান্নান শাহ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মরদেহ উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেন। অনেক অনুসন্ধানের পর হান্নান শাহ্ চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস থেকে ৩৭ কিলোমিটার (২২ মাইল) উত্তর পূর্বে রাঙ্গুনিয়া এলাকায় বর্তমান চুয়েট-এর সন্নিকটে চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের পার্শ্বে এক পাহাড়ের পাদদেশে মাটি চাপা অবস্থায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে তিনি জিয়াউর রহমানের মরদেহ কফিনে ভরে হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রায় ২৬ বছর থাকার পর ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে আমি সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করি। একই বছর ২৭ সেপ্টেম্বর আমি বিএনপিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করি। এর প্রায় ৪ মাস পরই আসে ১/১১ এর ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন সরকার। সে সময় বিএনপি চেয়ারপার্সন যখন বাসায় অন্তরীন ছিলেন তখন ১/১১-এর কুশিলবরা তাকে আজীবনের জন্য বিদেশে পাঠাবার পরিকল্পনা করে। দেশের এমনই এক সংকটময় মুহূর্তে আমার প্রাক্তন সামরিক কমান্ডারকে গর্জে উঠতে দেখি। আমি কালবিলম্ব না করে তার (হান্নান শাহ) সঙ্গে মহাখালী ডিওএইচএস-এর বাসায় সাক্ষাৎ করি এবং আমার রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার সঙ্গে সর্বাবস্থায় থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করি। সেই থেকে তার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক পথ চলা শুরু হয়, যা তার মৃত্যুর মাধ্যমে পরিসমাপ্তি ঘটে।
১/১১ সরকার দেশনেত্রীকে জোরপূর্বক বিদেশে পাঠাবার আয়োজন করে। সে সময় হান্নান শাহ দেশনেত্রীর বাসায় গিয়ে কোনো অবস্থাতেই বিদেশে না যাওয়ার পরামর্শ দেন। দেশনেত্রী গৃহবন্দী অবস্থায় থাকায় মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে কোনো বার্তা বা বক্তব্য দিতে পারছিলেন না। হান্নান শাহ তখন বিএনপি চেয়ারপার্সনের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়ার জন্য দেশনেত্রীর অনুমতি প্রার্থনা করেন। বেগম খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিক হান্নান শাহকে অনুমতি প্রদান করেন। এর পর থেকেই হান্নান শাহ দেশনেত্রীর পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত মিডিয়াতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন এবং ১/১১-এর সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সে সময় হান্নান শাহ মোবাইল ফোনের সাহায্যে দেশনেত্রীর বক্তব্য প্রচার করে বিএনপির নেতা কর্মীদের উজ্জীবিত করে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বিরাট ভূমিকা রাখেন। হান্নান শাহর বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন গংরা দেশনেত্রীকে দেশান্তরিত করতে পারেনি। এর পরেই অবৈধ সরকার দেশনেত্রীকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। সে সময় বিএনপি চরম সংকটে পতিত হয়। হান্নান শাহ চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা হয়েও যে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তা সত্যি অনুকরণীয়। দলের সেই সংকটময় মুহূর্তে তার সঙ্গে একত্রে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, যা আমার স্মৃতিতে আজীবন অমলিন থাকবে। সে সময় গুটি কয়েক কুচক্রী তৎকালীন মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও হান্নান শাহর সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক তৈরি করার অপচেষ্টা করেছিল। বিষয়টি অবগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ও আশির দশকের ছাত্রনেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইলের খন্দকার বাবুল চৌধুরী মহাসচিব খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে একান্তে আলাপ করি। এর পর আমরা হান্নান শাহর বাসায় গিয়ে তাকে আমার গাড়িতে তুলে সরাসরি সংসদ এলাকায় ন্যাম ভবনে খন্দকার দেলোয়ারের বাসায় নিয়ে যাই। সেখানে আমাদের চার জনের উপস্থিতিতে খন্দকার দেলোয়ার ও হান্নান শাহ দীর্ঘ সময় আলাপ আলোচনা করেন। সর্বশেষে সিদ্ধান্ত হয় যে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত খন্দকার দেলোয়ার ও হান্নান শাহ যে কোন প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও একত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে ১/১১-এর সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন এবং জীবন দিয়ে হলেও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখবেন। এর পরের ইতিহাস সকলেই জানেন। হান্নান শাহর বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণেই ১/১১-এর অবৈধ সরকার তার দেশ-ধ্বংসকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি।
২০০৯ ও ২০১৬ সালে বিএনপির ৫ম ও ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ (অব:)-কে শৃঙ্খলা ও সেবা উপকমিটির আহ্বায়ক করা হয়। তিনি ঐ উপকমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেন। এই দু’টি কাউন্সিল সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য হান্নান শাহ যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন তা সত্যি অনুকরণীয়। তার নিখুঁত পরিকল্পনা, সদা জাগ্রত দৃষ্টি ও নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্যই উভয় কাউন্সিল সফল ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে হান্নান শাহকে সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ঐ সমন্বয় সেলের সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। সরকারের প্রতিনিয়ত হুমকি ও প্রশাসনের চরম বৈরী আচরণের মাঝেও কী করে দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে প্রকাশ্যে ও গোপনে কাজ করে সফলতা অর্জন করতে হয় তা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে।
হান্নান শাহ বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-বরিশাল রোড মার্চ, ঢাকায় অনুষ্ঠিত অসংখ্য বিক্ষোভ সমাবেশ ও মহাসমাবেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এমন সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন যে প্রত্যেকটি কর্মসূচি নিরাপদে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হান্নান শাহর সব চেয়ে বড় গুণ ছিল যে, তিনি দলীয় কর্মীদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশে যেতে পারতেন এবং খোলাখুলি সব বিষয় আলোচনা করতেন। বর্তমান সরকারের একদলীয় নির্বাচনের পূর্বে ২০১৩ সালের ২ নভেম্বর আমি আমার গ্রামের বাড়ি সাভারের ডেন্ডাবর এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করার সময় দলীয় নেতাকর্মীসহ গ্রেফতার হই এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হই। আমাকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি জেল (৪নং জেল) এ অন্তরীন রাখা হয়। এর কিছুদিন পর হান্নান শাহ গ্রেফতার হয়ে আমাদের জেলে আসেন। সে সময় আমাদের জেলে বন্দি ছিলেন ব্যারিস্টার মাহাবুবউদ্দিন খোকন, নাসিরুউদ্দিন পিন্টু, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মেজর হানিফ (অব.), ব্যারিস্টার ফখরুলসহ অনেক নেতাকর্মী ।
তখন হান্নান শাহ প্রতিদিন আমাদের খোঁজখবর নিতেন এবং দলীয় নেতাকর্মীদের মনোবল উঁচু রাখার জন্য সবসময় সচেষ্ট থাকতেন। জেলখানার কঠোর ও বৈরী পরিবেশের মাঝেও আমাদের জন্য প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী রুমে পাঠিয়ে দিতেন। ডিসেম্বর মাসে যখন দেশব্যাপী সরকার বিরোধী প্রচন্ড আন্দোলন চলমান তখন এবিষয়ে আমাদের সঙ্গে প্রায়ই খোলামেলা আলোচনা করতেন। এই আন্দোলনের মাঝে হঠাৎ যখন ‘ঢাকা অবরোধ’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো হান্নান শাহ তখন বলেছিলেন, আন্দোলনরত নেতাকর্মীরা তাদের নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলে তাদের পুনরায় সংঘঠিত করা কঠিন হয়ে পড়বে এবং আন্দোলনের তীব্রতা কমে যাবে।
হান্নান শাহ সব সময় রাষ্ট্রের স্বার্থ ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতেন। বর্তমান সরকার যখন দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতকে করিডোর / ট্রানজিট প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তিনি প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেন। পিলখানা হত্যাকান্ড, ইলিয়াস আলী, চৌধুরী আলমসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম-খুনের বিরুদ্ধে তিনি অসংখ্যবার বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন। বর্তমান সরকারের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দৃঢ় ও স্থির সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। তিনি বর্তমান সরকারের চরম রোষানলে পতিত হন। ৭৪ ঊর্ধ্বো এই প্রবীণ দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ অসংখ্য মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে জীবনের অনেকটা সময় আদালত অঙ্গনে নিঃশেষ করেছেন। আমি যখন ২০১৬ সালে ৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে তার মহাখালী ডিওএইচএস-এর বাসায় দেখা করি তখন জানালেন যে, তিনি খুবই অসুস্থ বোধ করছেন কিন্তুু পরের দিন ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার সিএমএম কোর্টে মামলা থাকায় অসুস্থতা সত্তে¡ও হাজিরা দিতে যাবেন। ৬ সেপ্টেম্বর সকালে হান্নান শাহ অসুস্থ শরীরে যখন ঢাকা সিএমএম কোর্টের উদ্দেশ্য যাত্রা করেন, তখন ঢাকা সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেটের সন্নিকটে তিনি Massive heart attack-এ আক্তান্ত হয়ে অচেতন হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ঈগঐ এ নেয়া হলে হান্নান শাহকে CMH-তে ভর্তি করা হয়। অবস্থার কোন উন্নতি না হলে ১৩ সেপ্টেম্বর এয়ারএ্যাম্বুলেন্স যোগে সিঙ্গাপুর নেয়া হয়। এদেশের লক্ষ লক্ষ ভক্ত, গুণগ্রাহী ও শুভাকাক্সক্ষীকে অশ্রুসিক্ত করে ২৭ সেপ্টেম্বর প্রত্যুষে সিংগাপুরের Raffle Hospital-এ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসম হান্নান শাহ (অব:) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।
লেখক: বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন