শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

উল্টো পথে চলা, উল্টো কথা বলা

মহিউদ্দিন খান মোহন | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গত ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে রাজধানী ঢাকায় এক ব্যতিক্রমধর্মী অভিযান শুরু করেছে পুলিশ। ওইদিন ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে আসা ৫৭টি গাড়িকে জরিমানা করেছে তারা। বিকালে রমনা পার্ক ও রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুগন্ধার পাশের রাস্তায় এ অভিযান চলে। অভিযানের সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। অভিযান চলার এক পর্যায়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোসলেহউদ্দীন, ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) রিফাত হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এসে উপস্থিত হন। ওইদিন পুলিশ যে, ৫৭টি গাড়ি আটক করে, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে সেগুলোর চালকদের বিরুদ্ধে মামলা করে। কোনোটির কাছ থেকে আদায় করা হয় নগদ জরিমানা। যাদের গাড়ি আটক করা হয়, তাদের মধ্যে ছিলেন সরকারের প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, সাংবাদিক, বিচারক ও ব্যবসায়ী। আটককৃত গাড়িগুলোর মধ্যে ৪০টির বেশি সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি।
উল্টো পথে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার ঘটনা রাজধানী ঢাকায় বিরল নয়। বরং যানজটের কারণে এ অসাধু উপায় অবলম্বন করে একটু তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেককেই করতে দেখা যায়। এ কাজটি যিনি করেন, তিনি হয়তো একটু আগে যেতে পারেন, তবে সে জন্য অনেক সময় যানজট আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এ আইন অমান্য করার প্রবণতায় অশিক্ষিত রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে দেশের মন্ত্রী-এমপি-সচিবরা পর্যন্ত আক্রান্ত। যারা আইন বানান এবং তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেন, তারাও আইন ভাঙছেন দ্বিধাহীন চিত্তে! উল্টো পথে গাড়ি চালিয়ে নির্বিকার চিত্তে চলে যাবার দৃশ্য ঢাকার রাস্তায় প্রায়শই দেখা যায়। এমন কি ফুটপাথের ওপর দিয়ে মোটর সাইকেল চালিয়ে চলে যায় কতিপয় বিবেকহীন মানুষ। তারা এটা ভেবে দেখে না, যে ফুটপাথ পথচারিদের চলাচলের জন্য নির্মিত, সেটার ওপর দিয়ে মোটর বাইক চালালে পথচারিদের কতটা অসুবিধা হবে। একটি বিষয়ে বোধ করি কেউই দ্বি-মত প্রকাশ করবেন না যে, স্বার্থপরতা অর্থাৎ নিজের সুবিধাটুকু বৈধ কিংবা অবৈধ পন্থায় আদায় করে নেয়ার হীন মানসিকতা এক শ্রেণির মানুষের মধ্য নিরাময় অযোগ্য ব্যাধির মতো জাঁকিয়ে বসায় রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে আইন লঙ্ঘন থেকে শুরু করে নানা কিসিমের দুর্নীতি আজ বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ করেছে।
ওইদিন (২৪ সেপ্টেম্বর) পুলিশ যাদের গাড়ি আটক এবং জরিমানা করেছে, মামলা দিয়েছে তারা সবাই শিক্ষিত এবং দেশের প্রচলিত আইন সম্পর্কে জ্ঞাত। কেউ কেউ আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং তারা অজান্তে একটি ভুল কাজ করে ফেলেছেন এমনটি বলা যাবে না। বরং এটাই সত্যি যে, তারা সচেতনভাবেই আইন লঙ্ঘন করে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন। একজন অশিক্ষিত মূর্খ লোক যদি না জেনে আইন লঙ্ঘন করে তাহলে প্রথমবার হয়তো তাকে ক্ষমা করা চলে। কিন্তু আইন প্রণয়নকারী বা বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি যখন সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে আইন ভেঙ্গে সুবিধা নেন, তখন তার বা তাদের সরকার বা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকার নৈতিক অধিকার আর অবশিষ্ট থাকে কীনা এটা ভেবে দেখা দরকার।
প্রশ্ন হলো, এ অভিযান কতটুকু সফলতা বয়ে আনবে। আগামী দিনেও এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে কীনা। গাড়ি আটক ও জরিমানা আদায় করে ট্রাফিক আইন ভঙ্গের কুপ্রবণতাকে রোধ করা যাবে কীনা। যাদেরকে সেদিন জরিমানা করা হয়েছে, তাদের পরিচিতি থেকেই অনুমান করা যায় দু’চার হাজার টাকা জরিমানা তাদের মানিব্যাগে তেমন কোনো প্রভাবই ফেলবে না। তবে, পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশ-প্রচার হওয়ায় তাদের বিবেকের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওইদিন ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত এক পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, ‘একটা মামলা বা দেড়-দুই হাজার টাকা জরিমানা তো ওনাদের কোনো বিষয় না। আপনার জাতির সামনে ওনাদের সুন্দর মুখটা তুলে ধরেন, তাতেই কাজে দিবে।’ ওই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য যে যথার্থ তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। কেননা, যেসব ব্যক্তি ওইদিন পুলিশি অভিযানের জালে আটকা পড়েছিলেন, তাদের পরিচয় এখন আর কারো অজানা নেই। তাদের কেউ কেউ টিভি ক্যামেরা দেখে গাড়ির ভেতর মাথা নিচু করে মুখ লুকিয়েছিলেন বলে পত্রিকার খবরেই বলা হয়েছে। বুঝা যায়, আইন ভঙ্গের মতো অনৈতিক কাজ করে তারা লজ্জায় অধোবদন হয়েছেন। এ রকম লজ্জাবোধ যদি রাষ্ট্র ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মনে অহর্নিশি কাজ করতো, তাহলে এ দেশ থেকে দুর্নীতিসহ অনেক সামাজিক অপরাধ বহু আগেই পাত্তাড়ি গুটাতো। কিন্তু ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’ প্রবাদকে অকাট্য প্রমাণ করে অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে একই অপরাধ বা অপকর্ম বারবার করতে দেখা যায়। পুলিশের আকস্মিক অভিযানে ধরা খাওয়া পদস্থ ব্যক্তিগণকে আইন ভঙ্গের দায়ে কারো কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হবে কীনা জানি না। কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় তারা আদৌ আসবেন কীনা তাও কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। হয়তো বেচারা ড্রাইভারের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে এ যাত্রা তারা মুখ বাঁচাবেন। কিন্তু তারা গাড়িতে বসা থাকা অবস্থায় চালক তার বা তাদের অনুমতি ছাড়া বেআইনি পথে গাড়ি চালিয়েছে, এটাতো কাউকে বিশ্বাস করানো যাবে না। বাংলাদেশ না হয়ে অন্য কোনো দেশে যদি এমনটি ঘটতো তাহলে ওইসব পদস্থ ব্যক্তিকে যে আইনি ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা যে বাংলাদেশ! সব সম্ভব-অসম্ভবের দেশ আমাদের এ মাতৃভূমি। এখানে আদালত কর্তৃক দন্ডিত ব্যক্তিরা জরিমানা দিয়েও নির্বিঘেœ মন্ত্রিত্ব করতে পারে। আবার কারো কারো ভাগ্যে জোটে বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাবাস।
উল্টো পথে চলতে গিয়ে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ধরা খেয়ে আজ সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, শুধু উল্টো পথে চলা নয়, উল্টো কথা বলা বা কাজ করাও যেন আমাদের সমাজের কতিপয় মানুষের মজ্জাগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আগপাছ না ভেবেই তারা কোনো বিষয়ে উল্টা-পাল্টা মন্তব্য করে বসেন। আর এ প্রবণতাটি আমাদের দেশের রাজনীতির মানুষদের মধ্যে বেশি। তারা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে কখনোই উঠতে পারেন না। জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়েও তারা কখনোই একমত হতে পারেন না। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী তাদেরকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, চোখের সামনে জাতীয় স্বার্থ বিনষ্ট হতে দেখলেও তারা নির্বিকার থাকেন, অথবা সব দোষ প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দিয়ে এক ধরনের অপরিণামদর্শী আত্মতুষ্টি লাভ করেন। পাশপাশি চলে দোষারোপের প্রতিযোগিতা। কে কাকে অভিযুক্ত করে কতটা রাজনৈতিক ফায়দা লুটে নিতে পারলেন, সেটাই যেন মুখ্য বিষয়। আর এজন্যই বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগ ও বিরূপ পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনীতিবিদরা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। দেশ ও জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের ডাক আমরা বিভিন্ন জনের কাছ থেকে শুনতে পেয়েছি। কিন্তু সে ঐক্য গড়ে তোলার নিয়ামক শক্তি যারা, তাদের কোনো পক্ষ হয়তো এক ফুৎকারে তা উড়িয়ে দিয়েছেন। এখানে দৃষ্টান্ত টেনে আনা প্রয়োজন মনে করছি না। দেশবাসী সেসব ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং জীবন্ত সাক্ষী। আর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের একে অপরের উল্টো পথে চলা এবং পরষ্পর উল্টো কথা বলার কারণে আমাদের এগিয়ে চলাটাও যেন উল্টো দিকেই যাচ্ছে। এটা আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে যে, জাতীয় দুর্যোগ বা স্বার্থের ক্ষেত্রেও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দলীয় বিভাজনের রেখা অতিক্রম করতে পারছেন না।
উল্টো পথে গাড়ি চালানোর বিরুদ্ধে পুলিশের এ অভিযান চালকদের বা গাড়ি ব্যবহারকারীদের আইন লঙ্ঘন থেকে কতটা বিরত রাখতে পারবে তা এখনই বলা যাবে না। হয়তো কয়েকদিন বা কিছুদিন তারা সংযত থাকবে। তবে, অভিযানের যদি ফলো আপ না হয়, অর্থাৎ ধারাবাহিকতা যদি রক্ষা করা না হয়, তাহলে অবস্থা ‘যথা পূর্বং তথা পরং’ হতে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, পুলিশ অভিযান চালিয়ে গাড়িচালকদের হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। কিন্তু আমাদের রাজনীতির যারা চালক তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? যদি বলেন জনগণ, তাহলে বলতেই হয়, রাজনীতিকদের কাছে তাদের মূল্য কতটুকু? সুতরাং, পুলিশি অভিযান চালিয়ে গাড়ির উল্টো পথে চলা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও রাজনীতিকদের উল্টো কথা বা কাজকে নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। তাদের আত্মেপলব্ধি ও আত্মনিয়ন্ত্রণই এ ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন