শনিবার, ২৫ মে ২০২৪, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

নিবন্ধ

ভোগ-দখল শুধু নয়, সহমর্মিতা প্রয়োজন

প্রকাশের সময় : ১৭ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
দূর অতীতের মানব ইতিহাস, মধ্যযুগের রাজ-ইতিহাস এবং বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি শুধু দখলের লড়াই। এ লড়াইয়ে কোনো পার্থক্য নজরে পড়ছে না। সর্বত্র একই ছবিÑ দখল করো, ভোগ করো।
সুদূর অতীতে গুহাবাসীদের জীবনেও ছিল সীমানা বা অঞ্চল দখলের জীবন-মরণ লড়াই। পরবর্তীকালে বা মধ্যযুগে ছিল সম্রাট-শাহানশাহ-রাজা-মহারাজাদের ওই সীমানা বা রাজ্য দখলের বীভৎস লড়াই। যুদ্ধের পর যুদ্ধ। বর্তমান গণতন্ত্রের যুগেও অতীতের সেই একই দখল নদীর বেগবান খরস্রোত উত্তাল তরঙ্গে বহমান। সেই একই ধারা। এলাকা-অঞ্চল-দেশ মেকি। গণতন্ত্রে দখল করো এবং ভোগ করো।
মধ্যযুগের সমাজ জীবনের রাজনৈতিক ইতিহাসের ছবিগুলো যখন চোখে পড়ে, সে এক লোমহর্ষক ঘটনা, বীভৎস কাহিনী যা লিখতে লিখতে আমার মন মাঝে মাঝে দুরূহ চিন্তা ও দুঃসহ চেতনায় প্রায় অবশ হয়ে পড়ত। যেখানে লক্ষ্য করি কত অন্যায়-অত্যাচার, কত অবিচার-অত্যাচার, কত অমানবিকতা-পাশবিকতা, কত খুন-জখম এত নৃশংসতা, এত নির্মমতা, এত নিষ্ঠুরতা কেন? যেখানে লক্ষ্য করি, নর অপেক্ষা নারীই বেশি লাঞ্ছিতা, নির্যাতিতা। মানুষের মধ্যে মানব-হৃদয় বলে কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না।
মধ্যযুগে লড়াইয়ের মূল লক্ষ্য ছিল রাজ্য দখল, দেশ দখল। সম্পদ দখল, তারপর নর-নারী দখল। যাদের দাস-দাসী রূপে ব্যবহার করা হত। তাদের দুর্ভোগের কোনো সীমা থাকত না। তারা খোয়াড়ে গাদাগাদি করে থাকত। তারা মানুষ হলেও তাদের প্রতি অন্যান্য জীবের মতোই ব্যবহার করা হত। জীবদেরও কিছু রেহাই ছিল। কিন্তু দাসীদের মধ্যে যারা সুন্দরী ছিল, তাদের সামান্য রেহাইও মিলত না। তারা ত্রিশ দিনই দিবারাত্র লালসার শিকার হত। অকালে যখন অকেজো হয়ে যেত, রাস্তার ধারে ফেলে দেওয়া হত।
এ তো গেল দাস-দাসীদের কথা। রানী বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলাদেরও নিস্তার ছিল না। পরাজিত রাজা-উজির, সেনাপতি, আমির-উমরাগণের পরমাসুন্দরী স্ত্রী ও কন্যাদের দুর্দশাও একেবারে কম ছিল না। দখলদাররা তাদের নিয়ে কী যে লোমহর্ষক ব্যবহার করতেন, তা কেবল অনুমান করাই শ্রেয়। দেখা হত, একই মাসে ওই সমস্ত রাজপরিবারের রমণীদের তিন থেকে পাঁচ বার মালিক পরিবর্তন হত, যেহেতু তারা দখলদারের দখলীকৃত সম্পদ। এহেন কাজ পশুকেও হার মানায়। মানবতার অপমৃত্যু ও অপমান এর থেকে বেশি আর কী হতে পারে ! এখানে একটিই লক্ষ্য সকলের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে দেখা যেত, কেবল ‘দখলদারি’। কে কতটা দখল করছে, করেছে ও করবে, এটাই ছিল মূল কথা। অতীত-মধ্য ও বর্তমান যুগেও সেই একই প্রথা বহমান।
পশুপাখি, জীবজন্তুর জঙ্গল জীবনেও লক্ষ্য করা যায়, সেই একই দখলের লড়াই। কেউ কাউকে আপন এলাকা বা অঞ্চল ছাড়তে রাজি নয়। আবার আপন আপন অঞ্চলেও চলে দখলের পর ভোগের লড়াই। কে কাকে ভোগ করবে। দিবারাত্রি অহরহ এ লড়াই চলছেই। জঙ্গলের এটাই যেন একমাত্র ধর্ম। যেহেতু তারা পশু ও জানোয়ার, তাদের কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তাদের বিবেক-বুদ্ধি-জ্ঞান-গরিমা, চিন্তাচেতনা নেই। তাই ওই দখলিপনায় তারা অপরাধী হয়েও নিরপরাধ আর বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিবিদ মানুষের কথাÑ সেতো অমৃত সমান।
মানুষ নানা কারণে পরাধীন হতে পারে। কিন্তু বিনা কারণে প্রতিটি ‘মানুষের মন’টি স্বাধীন। এ কথা, মহামানব-মহাপুরুষ এমনকি নবী-রাসূলগণও বলে গেছেন। ওখানে কেউই লাগাম পরাতে পারে না। রাজা-বাদশাহকেও একজন দীনাতিদীন চাকর ঘৃণার চোখে দেখতেই পারে। তাই মানুষের অবোধ মনে প্রশ্ন জাগে, বনের পশু ও জানোয়ার ‘দখলে ও ভোগে’ মেতে আছে ঠিকই। কিন্তু সভ্য-শিক্ষিত-সুশিক্ষিত সচেতন এবং জ্ঞান-গরিমার দাবিদার মানুষ কি ওই দখল ও ভোগের লড়াইয়ে এতটুকুও কম মেতে আছে ? তাই যদি না হবে, তাহলে দেশের নব্বই শতাংশ সম্পদ মাত্র দশ শতাংশ মানুষ ভোগ করে কীভাবে ? দেশের কিছু মানুষ মাসে পঞ্চাশ হাজার থেকে দু’লক্ষ টাকা মাইনে পাচ্ছে। যেখানে অগণিত হতভাগা মানুষ মাসে মাত্র দেড় থেকে দু’হাজার টাকা মাস মাইনে পায়। এও কি ‘দখল ও ভোগের’ বীভৎস চিত্র নয় ? সব কিছুরই একটা সীমারেখা থাকা প্রয়োজন। আজ দেশে দখল ও ভোগ ‘লক্ষ্যসীমা’ অতিক্রম করেছে। জনরোষও আজ জাগ্রত। সচেতন মানুষ আজ প্রতিবিধান এবং প্রতিকার চায়।
একবার এই হতভাগা পৃথিবীর পানে তাকিয়ে দেখুন। কী সকরুণ দৃশ্য ! এই পৃথিবীর কত দুর্বল দেশ সবল দখলকারীর যাঁতাকলে পড়ে অসহায় জীবজন্তুর ন্যায় আকাশ-ভাঙা আর্তনাদ করছে। তাদের যুগ-যুগান্তের শতাব্দীব্যাপী আর্তনাদ কি ওই সমস্ত দখলকারী দানবের কানে পৌঁছায় না?
মানুষের মন যেমন মন্দপ্রবণ, তেমনি প্রশ্নপ্রবণও। মনে প্রশ্ন জাগে, একই জঙ্গলে বাঘ-সিংহ, নিরীহ হরিণ-জেব্রা ও বোকা বাইসন কেন? আবার একই পৃথিবীতে আমেরিকা-অবলুপ্তপ্রায় পানামা, বিধ্বস্ত ইরাক ও আড়ষ্ট ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং হতদরিদ্র দেশগুলো কেন? সারা পৃথিবীতে এরূপ উপমার কোনো অভাব নেই। এ যেন কেবল ‘দখল ও ভোগের’ পরিশুদ্ধ উন্নতমানের সীমাহীন হৃদয়হীন সর্বগ্রাসী সংগ্রাম। এটাই কি মানব সভ্যতার আধুনিক রূপ?
আমাদের দেশ স্বাধীন হল। বেনিয়ার জাত ইংরেজ আমাদের দেশকে প্রায় দুইশ বছর ভোগ-দখলে রেখে মনের সুখে শাসন করল। তাদের সেই দখলদারি ছাড়াতে দেশের মানুষের কালঘাম ছুটে গেল। কত অগণিত প্রাণ, নি®প্রাণ মানুষ কালে ঝরে পড়ল। কত সহস্র সন্তান পিতৃহারা হল। কত নিষ্পাপ রমণী বিধবা হল। কত মাতা ও পিতা সন্তানহারা হল। কত শিশু অনাথ হল। কাদের পাপে তারা প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করল, সে বিচার এক মহাবিচারক ছাড়া আর কে-ই বা করবেন।
দেশ স্বাধীন হল। দেশ পরিচালনায় দেশের গণতন্ত্র পরিচালিত হল। অনেকগুলো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠল। এবার আবার সেই পুরনো মদ নতুন বোতলে এসে গেল। দখল ও ভোগের সংগ্রাম। কোন দল দেশের কতটা দখল করবে? কোন দল দেশের কত মানুষ দখলে রাখবে? এসবই যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্যব্রত হয়ে উঠল। যার জন্য আজও স্বাধীন দেশের কত নিরীহ নিরপরাধ প্রাণ প্রত্যহ লুটিয়ে পড়ছে। দেশের শ্রীবৃদ্ধিও নেই, দশের উন্নতিও নেই। কেবল আছে ‘দখল ও ভোগের’ কুৎসতি কামনা, লোলুপ বাসনা মাত্র। এ পরিবর্তন শুধু পালাবদলের পালামাত্র। দলগুলো একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ মাত্র। এই পরিবর্তন দেশেরও নয়, সমাজের নয়। দেশের জনসাধারণ সার্বিকভাবে সজাগ না হওয়া পর্যন্ত এ ধারা চলতেই থাকবে।
প্রতিটি দল এখন আপন আপন দলেও পোক্ত লেঠেল ও একান্ত অনুগত ‘দলবাজ’ বানাতে ও বাড়াতে ভীষণ ব্যস্ত। আপামর জনগণ ঘুরে না দাঁড়ালে বারবার নির্বাচন হবে, আর প্রমাণ হবে গণতন্ত্রের অযোগ্য। যে সংগ্রামে ভালো কাজের জন্য আকাক্সক্ষা নেই, হৃদয়ের কোনো আকুতি নেই। মনের আকুলি-বিকুলি নেই তা পশুদের সংগ্রাম থেকেও কতই না নিকৃষ্ট মানের সংগ্রাম। যে সংগ্রাম কেবল ‘দখল ও ভোগে’র জন্য নির্বিচারে মানুষ খুন করতে ওস্তাদ দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি যার এতটুকুও সহমর্মিতা বা সমবেদনা নেই, তা দূর অতীতে দানবের লড়াই ও পশুর সংগ্রাম ছাড়া আর কী ! মানুষ তার দুঃখময় পারিবারিক জীবনে দুমুটো অন্ন ছেলেমেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছে, সেই মানুষটিকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে দিবালোকে ঠা-া মাথায় খুন করা, এ কোন হিংস্রতা। এরই নাম কী দেশসেবা, দেশ গঠন। তা হলে গভীর জঙ্গলে জানোয়ারের কাজটি কী?
মনে প্রশ্ন জাগে সকল ধর্মই তো একই কথা বলে। স্রষ্টা সর্বশক্তিমান, সর্বস্রষ্টা, সর্বশ্রোতা, সর্বনিয়ন্তাÑ যার আদি নেই, অন্ত নেই, দিন নেই, রাত নেই। তিনি একক সর্বনিয়ন্তা। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। তা হলে এই পৃথিবীটা কি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে? মানুষের জ্ঞানের পরিধি তো খুবই কম। তাই আমরা কী ভাবব ? নরকহীন এই পৃথিবীতে এই সব নারকীয় তা-বলীলা দিবা-রাত্রি দেখে শুনে আমরা তো হতবাক হয়ে যাচ্ছি। এখানে আমরা নিরুপায়।
আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক চিকিৎসক, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে আচরণ করেন তা দেখে শরীর শিউরে উঠে। কিছুটা বিদ্যা দখল করে ভোগের দুরন্ত ঘোরাতে তারা যেমন হুঁশহারা ধাবমান প্রাণী। এখানে মানবকল্যাণ ও সেবা বিতরণের মানগন্ধও নেই। দেশের শক্তিতে দখল করে এবং মনের খুশিতে ভোগ করে। সেই দখল আর ভোগ।
আবার বিধির এই নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে একটু ফিরে তাকালে স্বস্তি জাগে। কই, কোথায় গেল বিশ্বের তাবড়-তাবড় গগনস্পর্শী বিশাল সাম্রাজ্যগুলো। কে তাদের যথা সময়ে আস্তাচলে নিয়ন্ত্রিত করলেন। যারা ভেবেছিল তাদের উদয় আছে অন্ত নেই, পৃথিবীতে তাদের প্রসাদ অট্টালিকা-দুর্গগুলো চিরস্থায়ী ? কে তাদের চিরবিদায় দিয়ে আজকের এই ভোগ-দখলের ‘দলতন্ত্র’ বাগীশদের আমন্ত্রণ জানালেন! আবার সময়ে বিদায়ও ধরিয়ে দেবেন। আমরা জানি পৃথিবীর প্রাণ মানব জাতি। আবার মানব জাতির প্রাণ তাদের মনুষ্যত্ব-মানবতা। মানুষের এই মনুষ্যত্বের ও মানবতার প্রকাশ ঘটে তার দৈনন্দিন আচরণে, সকল সৃষ্টির প্রতি দায়দায়িত্ব পালনে, সকল মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা, সহনশীলতায়, ভালোবাসায়।
মানুষের প্রথম পরিচয় হোক সে একজন মানুষ। সে পরিচয় জাতি-ধর্মে-বর্ণে নয়, শিক্ষা ও দীক্ষাতে নয়, টাকা-পয়সা ও পদ-পদবিতে নয়, বংশ-গোত্র ও সমাজে নয়, কাল ও যুগে নয়, মানুষের পরিচয় হোক কেবল মানুষ বলেই। মানুষের জন্য মানুষের অকপট ভালবাসা, সহমর্মিতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা, দয়া-মায়া-ক্ষমা প্রভৃতি থাক প্রতিটি মানুষের জন্য। যেগুলো মানব চরিত্রের শ্রেষ্ঠ ভূষণ। সহমর্মিতাই পৃথিবীর প্রাণ। মানুষের প্রতি মানুষের লক্ষ্য হোক বিচ্ছেদ নয়, মিলন; বিষাদ নয়, বন্ধন; সংঘর্ষ নয়, সংহতি; ধ্বংস নয়, প্রগতি; হিংসা নয়, ভালোবাসা; হত্যা নয়, রক্ষা। মানুষ জানুক সারা পৃথিবীতে একটাই জাতি মানবজাতি। মানুষ জানুকÑ মানুষের একটাই ধর্ম- মনুষ্যত্ব-মানবতা।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন