শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিবন্ধ

বেহাল প্রাইমারি শিক্ষা

সোলায়মান মোহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ১০ অক্টোবর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আগের দিনের মানুষ এক-দুই ক্লাস পড়লেই ভালোভাবে লিখতে ও পড়তে পারতেন। ইংরেজিও খুব ভালো পারতেন। আমার জ্যাঠা তার বর্ণনা অনুযায়ী মাত্র দু’ক্লাস পড়েছিলেন। তিনি দিব্বি শুদ্ধ উচ্চারণে সব ধরনের বই পড়তে পারতেন। আমরা ভাবতাম, তিনি কম করে হলেও এইচএসসি পাশ করেছেন। তার কারণ হলো, এখনকার অনেক এইচএসসি পাশ করা ছেলেমেয়েদের চেয়েও তিনি ভালো করে পড়তে পারতেন।
এইচএসসির শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পরীক্ষার খাতা দেখছিলাম, তাতে যা দেখলাম তা হলো প্রায় ১৫-২০ জন শিক্ষার্থী ইংরেজিতে কলেজ বানান লিখতে ভুল করেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো তাদের স্লিপ অব পেন কিন্তু পরে দেখলাম সত্যিই এরা বানানটা পারে না। আমাদের শ্রীপুরের পিয়ার আলী বিশ^বিদ্যালয় কলেজের প্রিন্সিপাল আবুল খায়ের স্যার একবার বললেন, তার কাছে অনার্সে পড়–য়া এক শিক্ষার্থী কোনো এক বিষয়ে আবেদন নিয়ে এসেছে তাতে স্যার দেখলেন ওই ছাত্র লিখেছে ‘বরাবর অদক্ষ’। ভেবে রীতিমত অবাক হলাম, এই শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া শেষে কর্মজীবনে কী করবে? গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম, তাদের এই সমস্যার জন্মটা কলেজে উঠে হয়নি; এর সূত্রপাত তাদের প্রাইমারি পর্যায় থেকে। আমাদের দেশের আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘কাঁচায় না নোয়ালে বাশঁ, পাকলে করে ঠাশ ঠাশ’। একটি বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশনে যে খরচ হয় তা পুরো ভবনের অন্য সব খরচের চেয়ে বেশি। কোনো শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার মূল ভিত্তি হলো প্রাইমারি পর্যায়। এই পর্যায় থেকে যদি কোনো শিক্ষার্থীকে গঠন করা না যায় তবে ওই শিক্ষার্থীর পক্ষে পরবর্তী পর্যায়ে আর ভালো ফলাফল করা সম্ভব হয়ে উঠে না। অর্থাৎ ভবনের ফাউন্ডেশনে দুর্বল হলে ভবনটি যেমন বেশি দিন স্থায়ী হয় না, তেমনি কোনো শিক্ষার্থী প্রাইমারিতে ভালোভাবে লেখাপড়া না করলে তার অবস্থাও ওই ভবনের মতোই হয়।
শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ, উপকরণ বা শিক্ষকমন্ডলী নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হলো শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু উদ্ভট হুটহাট চিন্তা নিয়ে। আর তা হলো শতভাগ পাশ করানোর প্রবণতা। আমার স্ত্রী সরাকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। সেই সুবাধে প্রাইমারি শিক্ষার্থীদের খাতা অনেক সময় দেখে থাকি। তার নম্বর দেওয়া দেখে রীতিমত মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। একটি ছাত্র সর্বোচ্চ পেলে ২০ নম্বর পাবে কিন্তু তাকেও পাশ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর আসে, এগুলো নিয়ে তোমার মাথা ঘামাতে হবে না, কোনো শিক্ষার্থীকে অকৃতকার্য রাখা যাবে না। সবাইকে পাশ করিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে লিখে দিতে হবে, তবুও পাশ করাতে হবে। এমনটাই উপর থেকে নির্দেশ আছে। সে আরো বলে, যদি কোনো শিক্ষার্থী ফেল করে তবে যিনি এই খাতা দেখেছেন তাকে যথেষ্ট জবাবদিহিতার মধ্যে পড়তে হয়। কাজেই সব পাশ, শতভাগ পাশ থাকতে হবে, এটাই নাকি উপর থেকে আদেশ।
এই শতভাগ পাশ করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি আমার কাছে খুব হাসির। আবার খুব কষ্টেরও কারণ এই ভেবে যে আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে কোথায় কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছি। এরা জাতির ভার গ্রহণ করলে জাতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে? একজন শিক্ষার্থী যখন পরীক্ষায় পাশ করার যোগ্য না হয়েও পাশ করে তখন সেও স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখে ওই শিক্ষার্থীর পরিবার যে তাদের ছেলেমেয়ে পরীক্ষায় পাশ করেছে, একদিন অনেক বড় হবে। কিন্তু এই বড় হওয়াটা কত বড় হওয়া তা সহজেই বুঝা যায় যখন চাকরির বাজারে প্রকৃত মেধাবীদের সাথে প্রতিযোগিতা করে কোনো চাকরি না পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে নেশাগ্রস্থ হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই হতাশাগ্রস্থ যুবকরাই সমাজ ও দেশকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে।
অথচ পরীক্ষার খাতা বা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করলে হয়তো পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাতে কি পরবর্তীতে তারা আবার চেষ্টা করবে এবং সফল হবে। এভাবে যারা সফল হয়ে আসবে কেবল তারাই দেশ বা জাতির জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে জাতি মেধা শূন্য হবে- এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন