পলাশ মাহমুদ
জগতের একমাত্র প্রাণী মানুষ; যাকে জীবনযাপনের প্রতি মুহূর্তে অর্থ ব্যয় করতে হয়। ব্যক্তির জীবনযাপনের উপাদানসমূহ (পণ্য বা সেবা) কেউ উৎপাদন করে আর অন্যরা তা ভোগ করে। বিনিময়ে প্রত্যেককে অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এভাবে দুনিয়াজুড়ে প্রতিদিন যে অর্থ ব্যয় হয় তার তিন ভাগের দুই ভাগ ব্যয় করে সাধারণ ভোক্তারা। সে কারণে অর্থনীতিতে ভোক্তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। তাই ভোক্তা সচেতনতা বাড়ানো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘ভোক্তারা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক গ্রুপ। যারা সরকারি ও বেসরকারি সকল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয় অথবা প্রভাবিত করে। কিন্তু অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ গ্রুপটি সুসংগঠিত নয়। ফলে তাদের মতামত প্রায়ই শোনা (গ্রাহ্য) হয় না।’ কেনেডির বক্তব্য অনুযায়ী ভোক্তারা সুসংগঠিত নয় বলেই তাদের মতামতের কোনো মূল্য দেয়া হয় না।
সাধারণত যিনি কোন পণ্য ভোগ করেন তাকেই ভোক্তা বোঝানো হয়। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে এটি সঠিক নয়। বাংলাদেশ সরকারের ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ এর ১৯ নং ধারায় যা বলা হয়েছে- ‘যিনি অর্থের বিনিময়ে কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয় অথবা ভাড়া করেন তিনিই ভোক্তা।’ এখানে ভোগ করার চেয়ে গ্রহণ করাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া পণ্যের পাশাপশি সেবাগ্রহীতাও যে ভোক্তা তা স্পষ্ট করা হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট কেনেডি তার ভাষণে ভোক্তাদের জন্য চারটি অধিকার সংরক্ষণের প্রস্তাব করেন। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে চারটি অধিকারকে বিস্তৃত করে আরো চারটি অধিকারকে সংযুক্ত করা হয়। ওই বছর থেকে ভোক্তাদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘কনজুমার ইন্টারন্যাশনাল’ (সিআই) আটটি অধিকারকে সনদভুক্ত করে। সেগুলো হচ্ছে- ১. মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার। ২. তথ্য পাওয়ার অধিকার। ৩. নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার। ৪. পছন্দের অধিকার। ৫. জানার অধিকার। ৬. অভিযোগ ও প্রতিকার পাওয়া অধিকার। ৭. ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার। এবং ৮. সুস্থ পরিবেশের অধিকার।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ করলেও আমাদের ভোক্তাদের মাঝে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি ‘ভোক্তা অধিকার’ বিষয়টি সাধারণ ভোক্তাদের মাঝে এখনো একেবারেই অপরিচিত। ফলে প্রতিনিয়ত ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ভোক্তার নিজেদের সুযোগ-সুবিধা না জানার ফলে তাদের প্রতারিত হতে হচ্ছে। অথচ আইনে ভোক্তাকে অভিযোগ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি অভিযোগের প্রেক্ষিতে জরিমানা হলে জরিমানার ২৫ শতাংশ অর্থ অভিযোগকারীকে পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়। অভিযোগ করতে কোনো আইনজীবীর দরকার হয় না। নির্দিষ্ট ফরমেট অনুযায়ী আলামতসহ ভোক্তা অধিকার কার্যালয়ে শুধুমাত্র একটি দরখস্ত দিলেই কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নেন। কিন্তু সচেতনতার অভাবে ভোক্তারা উল্লেখযোগ্য হারে অভিযোগও করছে না। অন্যদিকে প্রতিদিন খবরের কাগজে দেখা যাচ্ছে; দেশে সর্বত্রই নিত্যপণ্যসহ প্রায় সকল পণ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকারক দ্রব্যের ব্যবহার হচ্ছে। যা ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১০-১৩ সালের মধ্যে ২১, ৮৬০টি খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করে। এতে ৫০ শতাংশ পণ্যে ক্ষতিকারক উপকরণ পাওয়া যায়। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানের আরেক পরীক্ষায় ৪৩টি খাদ্যপণ্যের ৫ হাজার ৩৯৬টি নমুনার মধ্যে ২ হাজার ১৪৭টি নমুনাতেই মাত্রাতিরিক্ত ও ভয়াবহ ভেজালের উপস্থিতি ধরা পড়ে। যা শতকরা হিসাবে ৪০ ভাগ। এর মধ্যে আবার ১৩ ধরনের পণ্য পাওয়া গেছে যা শতভাগ ভেজাল। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায়ও একই হারে ভেজাল ধরা পড়ছে।
খাদ্যপণ্যে এসব ভেজালের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারের রোগ, গর্ভস্থ শিশু ও মায়ের নানা রোগ, ডায়রিয়া অন্যতম। খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে দেশে কি পরিমাণ মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ২০১২ সালে দিনাজপুরে লিচু খেয়ে ১৪ শিশুর মৃত্যুর কারণ ছিল বিষাক্ত কেমিক্যাল। ২০১৯ সালের স্বাস্থ্য বুলেটিনে ২০১৮ সালে খাদ্যে বিষক্রিয়ায় ৭ হাজার ৪৩৮ জনের মৃত্যুর তথ্য উল্লেখ করা হয়। গত ক্যান্সার দিবসের এক সেমিনারে বলা হয়েছে প্রতি বছর দেশে চার লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং দেড় লাখ মানুষ এ রোগে মারা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে দেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা হবে ২ কোটি ১৪ লাখ।
অন্যদিকে বিশ্ব কিডনি দিবসের আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে বর্তমানে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘণ্টায় মারা যাচ্ছে পাঁচজন। বছরে যার পরিমাণ প্রায় পঞ্চাশ হাজার। বিগত কয়েক বছরে এসব রোগ ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। যার প্রধান কারণ হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন এক সেমিনারে এ অবস্থাকে ‘নীরব গণহত্যা’ ও ‘নীরব মহামারী’ হিসেবে উল্লেখ করে।
তবে পণ্যে ভেজাল মিশ্রণ ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার বন্ধে সরকার ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৪’, ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ করে। ‘বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন’ (বিএসটিআই) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে। বাংলাদেশ দ-বিধির ২৭২ ও ২৭৩ ধারায়ও খাদ্যে ভেজাল মেশানোর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও অফিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মধ্যে দ্রব্যে ভেজাল ও কেমিক্যাল ব্যবহার প্রতিরোধে কাজ করে। তবে তাদের এসব কার্যক্রম প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই সামান্য।
শুধু পণ্যের ক্ষেত্রে নয়, দেশের সেবা খাতের অবস্থাও নাজুক। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, আইন, পরিবহন, টেলিকমিউনিকেশন, বীমাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সেবা খাতে গ্রাহক বা ভোক্তার সাথে চলছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। মূলত সেবা খাত হলেও বর্তমানে এসব খাতকে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। যেখানে কর্তৃপক্ষ তাদের আর্থিক লাভের জন্য ভোক্তাদের সথে রীতিমতো কসাইয়ের ভূমিকা পালন করছে।
এই অরাজক পরিস্থিতি থেকে উত্তরোণের জন্য সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। তাছাড়া সরকারের একার পক্ষে এটা সম্ভবও নয়। তাই প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এজন্য ‘কনজুমার ইন্টারন্যাশনাল’ প্রতিটি ভোক্তার জন্য ছয়টি নির্দিষ্ট দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে। সেগুলো হচ্ছে; ১. ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানা। ২. ভোক্তা অধিকারের সুফল সম্পর্কে জানা। ৩. ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজের কুফল সম্পর্কে জানা। ৪. যাচাই-বাছাই করে সঠিক পণ্য সঠিক মূল্যে কেনা। ৫. ভোক্তা অধিকার বাস্তবায়নে সংগঠিত ও সোচ্চার হওয়া। এবং ৬. ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন হলে অভিযোগ করা।
সুতরাং ভোক্তা হিসেবে আমরা এসব দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারি না। সচেতনতার অভাবে আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এমন অরাজক পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ ও দেশের ভবিষ্যতের জন্য সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভোক্তা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তি ও দলগত স্বার্থের উর্ধ্বে ওঠে এই নীরব গণহত্যা প্রতিরোধের এখনই সময়।
লেখক : সভাপতি, কনজুমার ইয়ুথ বাংলাদেশ (সিওয়াইবি)
ঢ়ধষধংযসধযসঁফলঁ@মসধরষ.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন