মুহাম্মদ রেজাউর রহমান
বাংলাদেশ ব্যাংক গত ৭ মার্চ স্বীকার করেছে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশের একাউন্টে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার ৮০০ কোটি টাকা সমমূল্যের ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের অজান্তে তুলে নেয়া হয়েছে। দারিদ্র্য-পীড়িত এই দেশটিকে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নিচের দিকে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্বের দাবিদার বর্তমান সরকার কোনোমতেই এটা দাবি করতে পারে না যে, দেশের অভ্যন্তরে জনগণের মধ্যে আয় বৈষম্য কমেছে- দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সুষম বণ্টন হচ্ছে আর দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ সচ্ছলতার উপকার ভোগ করছে। ৮০০ কোটি টাকার বিনিময়ে দেশের অভ্যন্তরে আট হাজার প্রাথমিক স্কুল ভবন তৈরি করা যেতো, ৮০০ কোটি টাকার দ্বারা ১৬০০ থেকে ৩০০০ যুব ও যুব মহিলাকে উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রাথমিক মূলধন বা স্পিড ক্যাপিটাল-এর যোগান দেয়া যেতোÑ আটশত কোটি টাকার বিনিময়ে আরো অন্তত দুইশত হাসপাতালে প্রদত্ত স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন করা যেতো।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর কৃতিত্বের দাবিদার বাংলাদেশ ব্যাংক সবচেয়ে অবাক কা- ঘটিয়েছে রিজার্ভ তহবিল থেকে এই বিপুল পরিমাণ ডলার হ্যাকিং বা চুরি করে শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে সরিয়ে নেয়া হলেও স্বয়ং অর্থমন্ত্রীকে ঘটনা সম্পর্কে প্রথমে কিছুই জানায়নি। ৭ মার্চ অর্থমন্ত্রী যা বলেছেন, তা হলো : ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি যাওয়ার বিষয়ে কিছুই জানি না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক আমাকে কিছুই জানায়নি। আমি বিষয়টি পত্রিকায় পড়েছি।’ দেশ কোন দিকে যাত্রা করেছে- যে দেশের অভ্যন্তরে হলমার্ক গ্রুপ নামে একটি স্বল্প পরিচিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি গোষ্ঠী রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে ভুয়া রফতানির কাগজপত্রের বিনিময়ে তুলে নেয় প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। সেটিও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং সংক্রান্ত শাখা, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও অর্থমন্ত্রী স্বয়ং সে সম্পর্কে প্রথম দিকে কিছুই জানতেন না। হলমার্ক গ্রুপের জালিয়াতি চলেছিলো কয়েক বছর যাবত। ওই বছরগুলোতে সোনালী ব্যাংকের ওই শাখার হিসাব নিরীক্ষার কাজও বন্ধ ছিলো। সাংবাদিকরা এ সম্বন্ধে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে অর্থমন্ত্রী টাকার পরিমাণকে সামান্য বলেই মন্তব্য করেছিলেন। বর্তমান জালিয়াতিতে যে পরিমাণ অর্থ সরানো হয়েছে- তাতে যদি সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে আট হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভবন পাকা করা যেতো, তাহলে হল মার্কগ্রুপ ও সোনালী ব্যাংকের দুষ্টচক্র যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছেÑসে অর্থ দিয়ে কতো প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাসপাতালে স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন করা যেতো তা সহজেই অনুমেয়।
তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেটওয়ার্কে হ্যাক করে সুইফট সিস্টেমে ঢুকে পঁয়ত্রিশটি অর্থ পাঠানোর বার্তা দিয়েছিলো হ্যাকাররা। তার মধ্যে ৫টি বার্তা কার্যকর হলে শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে ৮০৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার চলে যায় বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব থেকে। ঘটনা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেছেন যে, এরকম ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে অবহিত করার নিয়ম। তা হয়নি দেখে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে, ঘটনা ধামাচাপার চেষ্টা করা হয়েছিলো কিনা এবং হয়ে থাকলে দায়ী ব্যক্তিদেরও বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।
ফিলিপাইনের ইংরেজি দৈনিক দি ইনকোয়ারার গত ২৯ ফেব্রুয়ারি এক প্রতিবেদনে জানায় যে, ম্যানিলা শহরের ব্যবসাÑএলাকা মাকাটির রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকের কর্পোরেশনের শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশের রিজার্ভ অ্যাকাউন্ট থেকে জমা হওয়া অর্থ পুনরায় স্থানান্তর করা হয়েছে ‘ফিলরেম’ নামক একটি আর্থিক লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনটি জুয়া খেলার প্রতিষ্ঠান ক্যাসিনোর অ্যাকাউন্টে। পরে ক্যাসিনো তিনটি তা পাচার করে দেয় অন্য দেশের অ্যাকাউন্টে। এর আগে ডলার থেকে ফিলিপাইনের মুদ্রা পেশোতে রূপান্তরিত অর্থ জমা হয় একটি চীনা ব্যবসায়ী অ্যাকাউন্টে। ফিলিপাইনের সরকারি প্রতিষ্ঠান ফিলিপাইনের ওই ব্যবসায়ীর অ্যাকাউন্ট থেকে পাচার হওয়া অর্থের গন্তব্য সম্পর্কে তদন্ত শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮০৮ কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে হ্যাক করে সর্বশেষে অজানা গন্তব্যে স্থানান্তর করার বিষয়টিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও দায়িত্ব এড়াতে পারেন না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন। আওয়ামী লীগ শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দও ঘটনা সম্পর্কে খুবই ক্ষুব্ধ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঘটনার ফলে আমাদের অনেক দিকের অর্জন ও সাফল্য মøান হয়েছে। অর্থ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বিবিসিকে দেয়া এক বক্তব্যে জানিয়েছেন যে, ১৪ মার্চের মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ নিয়ে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং আইন ও বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
এভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত করা ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে গতানুগতিক পন্থা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির পরেও সরকার ব্যাংকের টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের জন্য ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি অর্থ যে কোনো হিসাব থেকে স্বনামে বা বেনামে রক্ষিত ব্যাংক হিসাবে ট্রান্সফার বন্ধ করার জন্য কোনো বিশেষ আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। অথচ অন্যান্য বহু অপ্রয়োজনীয় ও বিতর্কিত বিষয়ে আইন প্রণয়ন করেছেন বা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। গণ-মাধ্যমের ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রস্তাবিত আইনও এমন একটি। প্রচলিত আইনে ঢিমে-তেতলাভাবে শুরু হয়েছে হলমার্ক গ্রুপের কয়েকজনের বিচার। এছাড়াও হলমার্ক গ্রুপের অনুসরণে বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায়ও এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকায় গচ্ছিত বাংলাদেশের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ অন্য দেশে স্থানান্তর করা সংক্রান্ত ৩৫টি বার্তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি বার্তা কার্যকর হয়েছে; কিন্তু ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে বাকী ৩০টি বার্তা কার্যকর করলে যে পরিমাণ গচ্ছিত ডলার বেরিয়ে যেতো- তার ফলে এখানে শুরু হয়ে যেতো শোকের মাতম। যেহেতু বাংলাদেশ একটি আমদানি নির্ভর দেশÑ রফতানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আমদানি মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হয় না, সেহেতু বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ২৭ বিলিয়ন ডলারের অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিক ও কর্মীদের পাঠানো। সেই বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় থেকে ৮০৮ কোটি টাকা বেরিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি আঘাতই বলতে হবে।
সুইফট কোড পাসওয়ার্ড হ্যাক করে ১০০ মিলিয়ন ডলার উঠিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বলেছে যে, তাদের ইতিহাসে এরকম জালিয়াতির ঘটনা একেবারেই নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায় যে, নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৫০টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের অর্থ লেনদেন হয়। এসব ব্যাংকের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। সুইফট কোডের পাসওয়ার্ড দুষ্কৃতকারী হ্যাকাররা জেনে তা ব্যবহার করেই টাকা স্থানান্তরের পরামর্শ-বার্তা দেয়। টাকা পাঠানো সংক্রান্ত যে পাঁচটি পরামর্শ-বার্তা কার্যকর করা হয়েছে- সেগুলোর প্রাপক ব্যক্তিগত নামে থাকায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ হলে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিস্তারিত জানতে চান। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাগণ জবাবে জানান যে, যে পাঁচটি পরামর্শ বার্তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়েছে-সেগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নয়। তাই ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অবশিষ্ট ৩০টি পরামর্শ বার্তার কার্যকারিতা স্থগিত করে দেয়।
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কোন দুষ্টচক্র এই হ্যাকিং ও অর্থ সরিয়ে নেয়ার জন্য দায়ীÑতা খুঁজে বার করার জন্য সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক ইন্টারপোল, ইন্টারনেট কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সংস্থার সাহায্য নিতে পারে। একশত মিলিয়ন ডলার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লোপাটের জন্য কে বা কারা দায়ীÑআন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু বাংলাদেশের একার পক্ষে তা জানা কোনোদিনই সম্ভব হবে না। তবে একটা সত্য এখানে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছেÑআর তা হলো সবকিছু ডিজিটাল হলেও আন্তর্জাতিক লেনদেনের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ এখনও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে পারেনি । তাই প্রবাসী বাংলাদেশিদের কষ্টার্জিত এই মূল্যবান ডলার যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানান্তরিত না হয়, সেই ব্যবস্থাই বাংলাদেশের নেয়া উচিত।
১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর ড. আতিউর রহমানের গভর্নর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এছাড়াও দুজন ডেপুটি গভর্নরসহ সাতজনকে ইতোমধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। পদত্যাগের পর ১৫ মার্চ বিকাল তিনটায় নিজ বাসভবনে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি তার পক্ষে যে কৈফিয়ৎ দিয়েছেনÑতা অনেকটা গ্রহণযোগ্য হলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি ম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিনের ফেসবুকে তার যে পর্যবেক্ষণ দেখা যায়- তা স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি গভর্নর হিসেবে ড. আতিউর রহমানের জন্য দায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ-মর্যাদায় থেকে ড. আতিউর রহমান তার নিজের জন্য বহির্বিশ্ব থেকে পদক, স্বীকৃতি ও পুরস্কার আদায়ের কাজেই বেশি ব্যস্ত রয়েছন বলে দেখা যায়।
এদিকে রিজার্ভ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার লোপাট সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী সকাল ১১টায় (১৫ মার্চ) সংবাদ সম্মেলন করার কথা ঘোষণা দিয়ে পরে তা দুপুর আড়াইটায় করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাও বাতিল করা হয়। এটাতে আশঙ্কা করা হয় যে, তার সাথে বিষয়টি সম্পর্কে সরকার প্রধানের মত-পার্থক্য রয়েছে। ঘটনা যাই হোক, এটা সত্য যে দেশে সাম্প্রতিক ইতিহাসে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক গ্রুপ, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতিসহ অনেক বড় বড় অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনাই ঘটেছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার রিজার্ভ থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরির ঘটনা ঘটল। তবে এটা দৃশ্যমান যে, অন্য ঘটনাগুলোর চেয়ে এবারের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনেক বেশি সক্রীয়। একইভাবে সরকারের নিকট অন্যান্য জালিয়াতির ঘটনাসমূহও গুরুত্ব পেলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার প্রমাণ পাওয়া যেত। স্থিতিশীল হতে পারত দেশের আর্থিক খাত।
য় লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন