ঢাকা মহানগর পুলিশের দু’জন অফিসার (এসআই) দ্বারা সম্প্রতি নিরপরাধ দু’জন নাগরিকের লাঞ্ছিত ও প্রহৃত হওয়ার ঘটনা সকল মহল কর্তৃক নিন্দিত হয়েছে। দুটি আলাদা ঘটনাতেই পুলিশের দু’জন কর্মকর্তা দ্বারা কোনো কর্তব্যরত বা নিরীহ নাগরিকের পোশাক-পরিচ্ছদ, বয়স ও চেহারা নির্বিশেষে সকলকেই অপরাধী হিসেবে গণ্য করার ও পরিচয় জেনে নেয়ার প্রতি অমার্জনীয় অনীহা থাকার কথাই মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া ব্যক্তিনির্বিশেষে সকলকেই অপরাধী মনে করে বা বানানো যাবে মনে করে তাকে মারপিট করা ও তার কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভ্যাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
বিগত ৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী পুলিশের দ্বারা নিমর্মভাবে প্রহৃত হন। তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার হুমকিও দেয়া হয়েছিল বলে তিনি অভিযোগ করা হয়েছে। এর এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ১৫ জানুয়ারি ভোররাতে যাত্রাবাড়ী থানার এক এসআই কর্তৃক নিগৃহীত ও প্রহৃত হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের কর্র্তব্যরত পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাস। প্রহারের ফলে মারাত্মকভাবে আহত বিকাশ চন্দ্র দাস শুক্রবার সারাদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অচেতন থাকার পর বিকেলে তাকে ল্যাবএইড হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ বিভাগে ভর্তি করা হয়।
ঘটনার জন্য দায়ী পুলিশ দল দুটির নেতা দুই এসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার কর্তৃক প্রদত্ত বিবরণীতে যা বলা হয়েছেÑতা হলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্তব্যরত বিকাশ চন্দ্র দাসকে মীরহাজিরবাগ এলাকার সাদা পোশাকে টহলরত পুলিশের একটি দল মোটরসাইকেলে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের কাজ পরিদর্শনের সময় তাকে থামতে বলা হলে উনি মোটরসাইকেল ফেলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পুলিশ দলের সদস্যরা তাকে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করলে পড়ে গিয়ে তিনি সামান্য আহত হন। পুলিশ কমিশনার কর্তৃক প্রদত্ত বিবৃতিতে প্রকারান্তরে পুলিশের দোষ খ-ন করারই চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকা উত্তোলন করে বাসায় যাওয়ার পথে মোহাম্মদপুর থানার একজন এসআই তাকে জেরা করে মামলায় জড়িত করার ভয় দেখান ও প্রহার করেন। পরিচয় দেওয়ার পরেও তাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। গোলাম রাব্বী এখনও হাসপাতালে। শারীরিক আঘাত কিছুটা উপশম হলেও মানসিকভাবে তিনি এখনও বিপর্যস্ত। মিরহাজিরবাগে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে প্রহার করার সময় পুলিশের যে মন্তব্যটি শোনা যায় বলে পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মীরা বলেছে, তা হলো তারা নাকি বলেছে ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। গত ১৭ জানুয়ারি বিকাশ চন্দ্র দাসকে হাসপাতালে দেখতে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। তিনি বলেছেন, বিকাশ চন্দ্র দাসকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এই উক্তি প্রহারের মাত্রা সম্পর্কে পুলিশ কমিশনারের বিবৃতিতে দেওয়া বক্তব্যকে অসার প্রমাণ করে।
ড. মিজানুর রহমান আরো বলেছেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশ’, এটা একটি ভয়ংকর উক্তি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘যেহেতু সরকার পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করেছেÑ তাই পুলিশ বাহিনীকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারা যাচ্ছে না।’ বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল মন্তব্য করেছেন যে, এর চেয়ে অবাঞ্ছিত ও ন্যক্কারজনক ঘটনা আর হতে পারে না। যাদের হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তারা এরকম বেআইনি কাজ কীভাবে করতে পারে?
কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা কর্তৃক নিরীহ ও নিরপরাধ নাগরিকদের হয়রানি, মামলায় জড়িত করার ভয় ও ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়ের চেষ্টা ইত্যাদির জন্য পুলিশ বাহিনীর সুনাম নষ্ট হচ্ছে, আর পুলিশের ওপর মানুষের আস্থাও অনেক হ্রাস পেয়েছে। অথচ ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ কথাটি প্রচলিত হয়েছিলÑপুলিশ বাহিনীর লক্ষ্য ও কাজের কথা বোঝানোর জন্যই। ইদানীং সকলেই কথাটি পুলিশ বাহিনীর ক্ষেত্রে আর প্রযোজ্য নয় বলে মন্তব্য করছেন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের প্রহার করা, নাশকতা হতে পারে এই অজুহাতে গণগ্রেফতার, বিরোধী দলের সমাবেশ ভ-ুল করার সময়ে বেপরোয়া লাঠিচার্জে কর্তব্যরত সাংবাদিকদেরও বেধড়ক পেটানো, তাদের ক্যামেরা ভেঙে দেয়ারও অনেক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে রেখেছে পুলিশ বাহিনী। ২০১২ সালের মাঝামাঝি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে পুলিশ বাহিনী ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের সর্বাপেক্ষা দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থমন্ত্রী এটা স্বীকারও করেছিলেন। তাই পুলিশ বাহিনীর এইসব বদনাম থেকে মুক্ত হতে না পারলে তাদের দ্বারা ‘দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন’ সম্ভব হবে কি নাÑতা নিয়ে সকল শ্রেণীর আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও অনুগত নাগরিকেরাই সংশয় প্রকাশ করবেন। কেউ কেউ বলছেন, সরকার পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের কিছু পূর্ব থেকেই বিরোধী দলের সকল কর্মসূচি ভ-ুল করার কাজে ব্যাপকভাবে নিয়োজিত করার কারণেই এখন পুলিশ বলছে যে ‘মাছের রাজা যেমন ইলিশ, দেশের রাজা তেমনি পুলিশ।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে হয়রানি, প্রহার ও ক্রসফায়ারের হুমকি প্রদানের সংবাদে সকল গণমাধ্যম যখন তোলপাড়, তার সাত দিনের মাথায় মীরহাজিরবাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে সাদা পোশাকধারী টহলরত পুলিশের দল কর্তৃক অমানুষিক প্রহার করার দৃষ্টান্ত এটাই প্রমাণ করে যে, পুলিশের কতিপয় সদস্য বর্তমানে আসলেই ‘দেশের রাজা পুলিশ’Ñএই কথায় মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। বিরোধী দলের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ ভ-ুল করার কাজে পুলিশকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী-সাংবাদিক নির্বিশেষে পেটানোর দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে ২০১২ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের ‘পুলিশ থেকে দূরে থাকুন’ বলে নসিহৎ করে ছিলেন। এই কথা বলে তিনি হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, পুলিশ যখন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদেরকে বেধড়ক পেটাবে-তখন ছবি তোলার জন্য পুলিশের কাছাকাছি থাকলে পুলিশ সাংবাদিকদেরকেও পেটাতে দ্বিধা করবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী ও সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের পরিদর্শক বিকাশ চন্দ্র দাসকে এক সপ্তাহেরও কম সময়ে মারাত্মকভাবে নিগৃহীত ও প্রহারের ঘটনা ছাড়াও পুলিশ বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্য অন্যান্য প্রকার অপরাধের সাথেও জড়িত হয়ে যাচ্ছেন। রোববার ১৭ জানুয়ারি চাঁদাবাজির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া এসআই নুরুল আমিন খানকে কারাগারে প্রেরণ ও দুই দিনের রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দেন মহানগর হাকিম। রিমান্ডের আবেদনে বলা হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশের একজন কর্মকর্তা হয়েও তার কর্মকা- দ্বারা পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছেন। অভিযুক্ত এসআই নুরুল আমিন খান ২০১৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর জনৈক বিমল চন্দ্র আইচকে বেআইনিভাবে আটক করেন। তিনি মামলার বাদীকে আটক করে নির্যাতন করেন ও বাদীর পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কুরিয়ার সার্ভিস মারফত ১৪ লাখ টাকা আদায় করেন। বাদীর মাইক্রোবাস ২০ লাখ টাকা মূল্য দেখিয়ে তার সহযোগীদের নামে ক্রয় করার দলিলে বাদীর স্বাক্ষর আদায় করেন। পরে বিমল চন্দ্র আইচ বাদী হয়ে গেন্ডারিয়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। উক্ত এসআইয়ের জনৈক সহযোগী গ্রেফতার হয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করলে এসআই নুরুল আমিন খানকে বরখাস্ত করা হয়।
উপরোক্ত তিনটি ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, পুলিশ বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য যে কোনো বে-আইনি কাজ করার ব্যাপারে ও এসবের দ্বারা অবৈধ অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে কোনো কিছুরই পরোয়া করছেন না।
আমাদের পুলিশ বাহিনীতে সৎ দক্ষ ও কর্মনিষ্ঠ সদস্যের অভাব নেই। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তাদের মূল্যায়ন করা হয় না। যাদের ভেতরে আল্লাহ-ভীতি কাজ করে, তারা কোনোদিনই পেশাগত জীবনে অসৎ হতে পারেন না। অথচ, পুলিশ বাহিনীর এরকম সদস্যদেরকে কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় বলে জানা যায়। আর অভিযুক্ত সদস্যদের পক্ষ সমর্থন বা তাদের অপরাধ ভুক্তভোগীদের দ্বারা বর্ণিত অপরাধ থেকে হালকা করে দেখানোর প্রবণতা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে হবে। তাহলেই পুলিশ পুনরায় জনগণের জন্য ভীতির কারণ না হয়ে জনগণের বন্ধু হতে পারবে। গত দুই বছরে পুলিশ বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্যদের বাড়াবাড়ি, অনৈতিক ও বেআইনী কর্মকা-ের ফলে বিরাট সংখ্যক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। জনগণের সেবক ও বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য পুলিশ বাহিনী থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। কেননা, পুলিশের সাহায্য ছাড়া দেশে অপরাধ দমন সম্ভব নয়। তাই পুলিশ কর্মকর্তা দ্বারা সংগঠিত বে-আইনি কর্মকা- সাধারণ জনগণের কাছে অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত মনে হয়। পুলিশ বাহিনীকে দুর্নীতি মুক্ত করুন, দুর্নীতি মুক্তদের যথাযথ মূল্যায়ন করুন; তাহলে সারাদেশে দুর্নীতি এমনিতেই অনেক কমে যাবে।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন