শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

বিএনপিকে জনগণের পালস্ বুঝতে হবে

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৩ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

একটি রাজনৈতিক দলের প্ল্যান থাকে, থাকে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা। এই প্ল্যান ও পরিকল্পনা অনুযায়ী দলটি তার সাংগঠনিক শক্তি বিন্যাস করে এবং করে জনগণকে প্রস্তুত। তারপর তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে হাত দেয়। প্ল্যান-পরিকল্পনাহীন, এলোমেলোভাবে কোনো রাজনৈতিক দল চলতে পারে না; চলা ঠিকও নয়। বিএনপির রাজনীতিটা অনেকের কাছে এরকমই মনে হয়। কোনো প্ল্যান-পরিকল্পনা দলটির আছে বলে তারা মনে করেন না। যার জন্য লক্ষ্য বাস্তবায়নে দলটি সফল হচ্ছে না। কিন্তু তার প্রতিপক্ষের রাজনীতিতে সুস্পষ্ট প্ল্যান-পরিকল্পনা দৃশ্যমান। তারা রাষ্ট্রীয় ও দলীয় শক্তি প্রয়োগ করে রাজনীতি করছে, যা তাদের কথা-বার্তায় এবং আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে। তারা বলছেন, ‘বিএনপি তাদের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জই নয়’, ‘বিএনপিকে শেষ করে দিতে হবে’,     বিএনপি নিষিদ্ধ হতে পারে’, সর্বোপরি ‘বিএনপি ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যাবে’। এসব কথা-বার্তায়, বিএনপিকে নিয়ে তাদের পরিকল্পনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। অন্যদিকে বিএনপির প্রধান শক্তি তৃণমূলের দিকেও তাদের লোলুপ দৃষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের তাদের দলে ভাগিয়ে নেয়ার কাজ জোরেশোরেই চলছে। এ অবস্থায় বিএনপিকে সুস্পষ্ট প্ল্যান ও পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দিকে গভীর দৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, সফলতার শর্টকাট কোনো পথ নেই; জ্ঞান-মেধা ও অভিজ্ঞতাই সফলতার চাবি-কাঠি। জ্ঞান-মেধা-অভিজ্ঞতা ও তৃণমূলকে প্রাধান্য দিয়েই, বিএনপিকে আগামী দিনের রাজনৈতিক প্ল্যান-পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। এছাড়া প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক কৌশল মোকাবিলা করা যাবে না, ধরে রাখা যাবে না তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। ঘরে তোলা যাবে না রাজনীতির সুফলও। জনগণ যে বিএনপির পক্ষে আছে, এটি দিবালোকের মতো সত্য। কিন্তু এই জনতার শক্তিকে বিএনপি না পারছে আন্দোলনে কাজে লাগাতে, না পারছে নির্বাচনে কাজে লাগাতে। জনতার শক্তিই রাজনীতির মূল শক্তি। জনতার শক্তির সামনে কোনো শক্তিই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অতীত রাজনীতিতে জনগণ যা চেয়েছে, তা-ই হয়েছে। কিন্তু জনতার শক্তিকে প্রস্তুত করতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে। তার জন্য দরকার সুস্পষ্ট প্ল্যান ও পরিকল্পনা। যে সরকার মানুষকে কথা বলার অধিকার দেয় না, মত প্রকাশের অধিকার দেয় না; দেয় না মিছিল-মিটিং করার অধিকার, সেই সরকারের কাছ থেকে সহজে কোনো কিছু আদায় করা যাবে না। জনতার শক্তিকে কাজে লাগিয়েই অধিকার আদায় করতে হবে।
আসলে একটি রাজনৈতিক দল জনগণের কাছে টিকে থাকে তার রাজনৈতিক স্ট্যান্ড ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। কিন্তু বিএনপির নেয়া কিছু সিদ্ধান্ত পরোক্ষভাবে সরকারের হাতকেই কোনো না কোনোভাবে শক্তিশালী করে। যার জন্য বিএনপি রাজনৈতিকভাবে বেনিফিশিয়ারি হতে পারছে না। এটি অত্যন্ত বাস্তবধর্মী একটি কথা, এটি আজ জনগণের মুখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে। মানুষ প্রকাশ্যেই বলছে, নিজস্ব কোনো চিন্তাধারা ও রাস্তা বিএনপির নেই; সরকারের দেখানো পথেই বিএনপি হাঁটে; সরকারের এজেন্ডাই তারা বাস্তবায়ন করে। প্রশ্ন হলো, এমন অগোছালো ও এলোমেলো রাজনীতি করে বিএনপি কী অর্জন করবে? দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যতই বা কী? বিএনপির এমন রাজনীতির কারণেই সরকার অনায়াসে তার মেয়াদ পার করার করার কথা ভাবছেÑএতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
রাজনীতিতে বিএনপির একমাত্র শক্তি হচ্ছে জনগণ। একের পর কিন্তু তাদেরকে কাজে লাগাতে না পারার কারণে, জনগণ যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়; তাহলে দলটি টিকে থাকবে কোন ভিত্তির ওপর? এটা আজ যৌক্তিক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
জনগণ বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া যেখানেই কর্মসূচি পালন করতে গিয়েছেন, সেখানেই মানুষের স্রোত উপচে পড়েছে। কারণ মানুষ বর্তমান সরকারকে চায় না। কেননা, জনগণের ভোটে তারা নির্বাচিত নয়। জনগণ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়। আর জনগণ জানে সেটি একমাত্র খালেদা জিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই জনগণ বিএনপির পেছনে ঐক্যবদ্ধ আছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ নেই বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। আর সে কারণেই একটি চরম বিতর্কিত নির্বাচন করে বর্তমান সরকার অনায়াসে দেশ চালিয়ে যাচ্ছে। পৌর নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ গ্রহণ করাতে তারা আরও কিছু দিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়ে গেল বলে জনগণ মনে করে। অর্থাৎ কাজেই রাজনীতি করতে হলে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে, তাদের পাল্স বুঝতে হবে। এই সরকারের প্রতি যে জনগণের কোনো সমর্থন নেইÑএটি তাদের কর্মকা-েই প্রতীয়মান হয়।
বিএনপির প্রয়োজন ছিল সংগঠনকে শক্তিশালী করতে দল গোছানো। অনেক ঢাকডোল পিটিয়ে দল গোছানোর কাজ শুরু করলেও, এই কাজের কোনো অগ্রগতি দৃশ্যমান নেই। ফলে তৃণমূলে বিরাজ করছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ। আন্দোলনের মাঠে যারা নিষ্ক্রিয় ছিল তারাই এখন আবার চলে এসেছেন লাইম লাইটে। বিএনপির আবার আন্দোলনের প্রয়োজন হলে, তারা আবার চলে যাবেন ব্যাকফুটে; তাদের আর রাজপথসহ কোথাও দেখা যাবে না বলে ত্যাগী নেতাকর্মীরা মনে করেন। কাজেই এভাবে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল চলতে পারে না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দলটির সুস্পষ্ট স্ট্যান্ড থাকা দরকার, যার মাধ্যমে দলটির কাছ থেকে জনগণ একটি সঠিক ও সময়োপযোগী দিক নির্দেশনা পাবে। কিন্তু এসব যৌক্তিক চিন্তা কি বিএনপির ভেতর কেউ করেন?
দেশের প্রায় ৮০ ভাগ জনগণের দাবি হলো একটি সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেশে আগে হবে এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে। এর জন্য জনগণ রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে; দিয়েছে সম্পদও, জেল-জুলুম-হামলা ও গুম গ্রেফতার এবং মামলা-মকদ্দমায় জর্জরিত হয়ে অনেকেই ফেরার জীবন-যাপন করছেন।
১৯৮২-১৯৯০ সাল পর্যন্ত বিএনপি রাজপথে ছিল। এই আট বছরে বিএনপি চোখে পড়ার মতো অনেক নেতাকর্মী তৈরি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু গত ৯ বছর ধরে বিএনপি রাজপথে। তারপরও দলটি রাজপথে নতুন কোনো নেতাকর্মী তৈরি করতে পারছে না। শরীরে নতুন রক্ত তৈরি না হলে যেমন মানুষ বাঁচে না-নতুন নেতাকর্মী তৈরি না হলেও রাজনৈতিক দল টিকে থাকে না। বিএনপির অন্যতম প্রাণ শক্তি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে আজ একটি নির্জীব সংগঠন বলে মনে হয়। সংগঠনটিতে কোনো প্রাণশক্তি নেই, নতুনত্ব নেই; নেই কোনো নতুন লড়াকু নেতাকর্মী। প্রশ্ন হলো, কেন নেই? এর পেছনের কারণ কী বিএনপি নেতৃত্ব অনুসন্ধান করেছে? অতীতের সব অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ছাত্রদেরই ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ছাত্র আন্দোলন ছাড়া কোনোভাবেই অধিকার আদায় সম্ভব নয়। কাজেই ছাত্রদলের দিকে বিএনপি নেতৃত্বকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। ছাত্রদলকে প্রস্তুত না করে আন্দোলনের মাঠে নামা হবে চরম বোকামি। ছাত্রদল থেকে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসতে হবে। ওই নেতৃত্বের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে। তাহলেই কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে আসবে।
পরিশেষে বলতে চাই, জনগণ বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন চায়; এ পরিবর্তন কীভাবে আসবে তার পথ বিএনপিকেই তৈরি করতে হবে। সারা দেশে সংগঠনের দিকে নজর দিতে হবে, সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে, সাহসী ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের লাইম-লাইটে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, শক্তি যদি নিজের পক্ষে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর এই শক্তি বিপক্ষে ব্যবহৃত হতে বাধ্য-এটা আমার কথা নয়, বিজ্ঞজনের কথা। জনতার শক্তিকে যথাযথ সময়ে নিজের পক্ষে কাজে লাগাতে না পারলে, এই শক্তি উল্টো দিকে ডাইভার্ট হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কাজেই সময়ের অপচয় করা যাবে না, যা করার দ্রুততম সময়ের মধ্যেই করতে হবে।
বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। কোনো নির্বাচন বিএনপি বর্জন করুক-এটি আমরা চাই না। কারণ গণতন্ত্রের অন্যতম পূর্বশর্ত হলো দেশে নির্বাচন হবে এবং সে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দেশে কী এখন কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যমান আছে? যেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যমান নেই, সেখানে সোজা কথায় কোনো কাজ হবে? এটা মাথায় রেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন