বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ

| প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১২:০০ এএম

অবশেষে পদত্যাগ করেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ছুটিতে থাকা অবস্থায় তিনি অস্ট্রেলিয়া থেকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান। সেখান থেকে কানাডা যাওয়ার আগে গত শুক্রবার প্রেসিডেন্ট বরাবরে লেখা পদত্যাগপত্রটি জমা দেন বাংলাদেশ হাইকমিশনে। যথারীতি পদত্যাগপত্রটি প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ে এসেছে। পদত্যাগপত্রে তিনি কি লিখেছেন, তা জানা যায়নি। তবে তার আত্মীয়স্বজনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, তিনি পদত্যাগপত্রে বিচারবিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের প্রকাশ্য দ্ব›দ্ব এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানসিক ও শারীরীক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেছেন। হাইকোটের অস্থায়ী বিচারপতি হিসাবে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা নিয়োগ পান ১৯৯৯ সালে। ২০১৫ সালের জানুয়ারীতে তিনি ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দেশের বিচারবিভাগের ইতিহাসে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রধান বিচারপতির পদ অলংকৃত করেন। আবার তিনিই এ যাবৎকালের মধ্যে একমাত্র প্রধান বিচারপতি যিনি পদত্যাগ করেছেন। আগামী বছর ৩১ জানুয়ারী তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার ৮১দিন আগেই পদত্যাগের মাধ্যমে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার দিন তিনি বলেছিলেন, বিচার বিভাগের স্বার্থে তিনি ফিরে আসবেন। সে কথা আর তার পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। প্রকাশিত কোনো খবরে বলা হয়েছে, তিনি দেশে ফিরেই পদত্যাগপত্র জমা দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তুু পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের চাপে বা পরামর্শে সিঙ্গাপুর থেকেই পদত্যাগ করছেন। প্রধান বিচারপতি হিসাবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি আলোচনায় ছিলেন। তার বক্তব্যের জন্য তিনি এতবার সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন যা এর আগে আর কোনো প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বিচারবিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি বিভিন্ন সময় সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি। আবার কখনো কখনো সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। এই স্ববিরোধিতার জন্য তিনি সমালোচিতও হয়েছেন।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্ব›দ্ব অনেকটাই ‘প্রকাশ্য’ রূপ লাভ করে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি ও শৃংখলাবিধি নিয়ে চলে আসা দ্ব›দ্ব জোরদার হয়ে ওঠে। এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশে সরকারের বার বার সময় নেয়া এর কারণ। সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে ভাস্কার্য স্থাপন নিয়ে সরকার কিছুটা বেকায়দায় পড়ে। শেষ পর্যন্ত সেটা অপসারণ করে অন্য জায়গায় স্থাপন করা হয়। অত:পর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে দ্ব›দ্ব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারসমর্থক আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতিকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেন। অনেকেই তার পদত্যাগ দাবি করেন। পরিস্থিতির এই প্রেক্ষাপটে ২ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি এক মাসের ছুটি চেয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি দেন। পরের দিন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ্যতম বিচারপতি আবুদল ওয়াহহাব মিঞাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১১ অক্টোবর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার কথা জানিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে প্রধান বিচারপতি আবেদন জানান। এই প্রেক্ষিতে তার ছুটি ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ১৩ অক্টোবর রাতে তিনি আস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। প্রধান বিচারপতির ছুটি নেয়া, ছুটির মেয়াদ বাড়ানো এবং বিদেশে যাওয়া নিয়ে অনেক বিতর্ক ও আলোচনা হয়েছে। বিশেষভাবে আলোচনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ব্যাপারে। ১৪ অক্টোবর সুপ্রিম কোটের এক বিবৃতিতে এই অভিযোগ তুলে ধরা হয়। অভিযোগগুলো আর্থিক ও নৈতিক স্খালন সম্পর্কিত। এরপর তার দেশে ফেরা ও স্বপদে বহাল হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে, গোটা বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্বিধাবিভক্তি প্রবল আকার নেয় যা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের পরও কমেনি। বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি বলেছেন, প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ বাধ্য করা হয়েছে। অপরপক্ষে আইনমন্ত্রী ও সরকারীদল সমর্থক আইনজীবীদের কেউ কেউ বলেছেন, তিনি স্বতর্স্ফূতভাবে পদত্যাগ করেছেন।
যাই হোক, এ বির্তক প্রলম্বিত না করাই হবে সঙ্গত। সৃষ্ট বির্তক ও পরস্পর বিরোধী বক্তব্য ও অভিমত বিচার বিভাগের ভাবমর্যাদাকে কিছুটা হলেও ক্ষুন্ন করেছে। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মতো রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ দু’টির মধ্যে দ্ব›দ্ব-বিরোধ একেবারেই কাম্য হতে পারে না। এদের পারস্পরিক সম্পর্ক দ্ব›দ্বমূলক নয়, সহযোগিতামূলক। সুশাসন, আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও জনকল্যাণের জন্য রাষ্ট্রের প্রতিটা অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্যমূলক ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকা একান্তভাবেই বাঞ্ছনীয়। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলেছেন, যা কিছুই ঘটেছে তাতে দেশের জন্য কোনো ভালো নজির স্থাপিত হয়নি। এতে সর্বোচ্চ আদালত ও বিচার বিভাগের প্রতি জনআস্থা সংকুচিত হতে পারে। তা যাতে না হয় সেটা সংশ্লিষ্ট সকলকে নিশ্চিত করতে হবে। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি কে হচ্ছেন, সে প্রশ্ন ইতোমধ্যেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, পরবর্তী পদক্ষেপ প্রেসিডেন্ট নেবেন। প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণে ওই পদ শূণ্য হলে কী হবে, তা সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আমরা আশা করি, নতুন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চ আদালত তথা বিচার বিভাগের সুনাম, সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন