আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে মানুষজনকে তুলে নিয়ে যাওয়া সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের অধিকাংশেরই কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। জনগণের মধ্যে এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তারা আর কখনোই ফিরে আসবে না। ব্যতিক্রম হিসাবে যে দু’চারজন ফিরে আসে, তারা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ হয়ে যায়। কারা তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কোথায় তারা ছিলেন, তাদের কাছে কী জানতে চাওয়া হয়, কী ব্যবহার তাদের সঙ্গে করা হয়েছে, কোনো কিছুই তারা বলেন না। বুঝাই যায়, যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাদের চাপে ও ভয়েই তারা মুখ খুলতে সাহস পান না। ফলে কারা তাদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল তা অজানাই থেকে যায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা অস্বীকার করা হয়। আবার ক্ষেত্র বিশেষে ধরে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে গ্রেফতার দেখানো হয়। যাদের এভাবে তুলে নেয়া হয়, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তি যেমন আছেন তেমনি ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, শিক্ষক এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষও আছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে চলতি বছর অন্তত ৫৫ জন গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে নয় জন ফিরে এসেছেন। দুইজনের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে। আর তিনজনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার দেখিয়েছে। বাকীদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, কেউ বলতে পারে না। গুম হওয়া এবং এখনো নিখোঁজ থাকা ব্যক্তিদের পরিবার-পরিজন আত্মীয়-স্বজন তাদের ফিরে আসার প্রতীক্ষা করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আবেদন-নিবেদন ও ধরনা দিচ্ছে; কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং তুলে নেয়াদের অধিকাংশের হদিস না মেলার ঘটনায় সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেই এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। দিনে দিনে গুম ও নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আরেক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৫৪০ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্তত: ৩৪৭ জনের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাকীদের কারো কারো লাশ পাওয়া গেছে এবং কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে, গুম হওয়া বা নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে থানায় মামলা করতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহযোগিতা পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে মামলা নিতে অস্বীকার করা হয়। থানা-পুলিশের এহেন আচরণ সঙ্গতকারণেই সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়। যদি মনে করা হয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত নয়, তাহলে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অস্বীকার করতে বা এড়িয়ে যেতে পারে না। অন্তত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অপনোদনের জন্য হলেও প্রতিটি গুমের ঘটনা আমলে এনে অপহরণকারীদের খুঁজে বের করা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা অত্যন্ত দুঃখজনক। মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বিনা পরোয়ানা ও সাদা পোশাকে আটকের ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালতের যে নির্দেশনা আছে, তা মানা হলে গুমের ঘটনা অনেক কমে যেতো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের নামে যারা তুলে নেয় তারা সাদা পোশাকে থাকে এবং কোনোরূপ পরোয়ানা ছাড়াই তাদের তুলে নেয়া হয়। দুষ্কৃতিকারীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করতে পারে এবং তা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু বিনা পরোয়ানায় ও সাদা পোশাকে গ্রেফতার যদি সম্পূর্ণভাবে রহিত করা যেতো তাহলে দুষ্কৃতিকারীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নাম ব্যবহার করতে পারতো না। এজন্য সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মেনে চলা শুধু জরুরি নয়, অত্যাবশ্যকও বটে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক গুম পরিস্থিতি নিয়ে বলেছেন, ‘এমন অভিযোগ আসছে যে, সরকারী বাহিনীর লোকজন সাদা পোশাকে বা কখনো ইউনিফর্মে অন্যের ভাড়া করা গাড়িতে বা নিজেদের গাড়িতে করে অনেককে তুলে নিয়ে আসছে। এভাবে তুলে নেয়া ব্যক্তিদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’ মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে গুম নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক বিরাজ করছে। সবাই মনে করছেন, যে কেউ যে কোনো সময় গুম হয়ে যেতে পারেন।’ এই যখন প্রকৃত বাস্তবতা তখন নাগরিক নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারে? বলাবাহুল্য, একদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অন্যদিকে গুম বা তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা, এটা নির্ভয় ও নিরাপদ সমাজের পরিচয় বহন করেন না। যে সমাজে ধরনের অনিরাপত্তা ও ভীতি-আতঙ্ক বিরাজ করে সে সমাজ এগিয়ে যেতে পারে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গুম-খুনের সংস্কৃতি দুঃশাসনের পরিচয়বাহী। প্রকৃত গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসন বিদ্যমান থাকলে এরকম দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে না। সরকারকে নাগরিক অনিরাপত্তা ও ভীতি-সন্ত্রাসজনক এই পরিস্থিতির নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গুমের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা থাকলে যেমন তার প্রতিবিধানে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে তেমনি না থাকলেও কারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করতে যথাযথচিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো মূল্যে নাগরিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন