মোহাম্মদ আবদুল অদুদ
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। যার ফলে আজকে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি তথা মর্যাদা লাভ করেছি। কেন হয়েছিল সেই ভাষা আন্দোলন? সেদিন আমাদের প্রতিবাদের মুখ্য বিষয়ই কী ছিল? মূলত বাংলা ভাষাভাষীদের মুখ্য দাবি ছিলÑএ অঞ্চলের সংখ্যাধিক্য মানুষের বিপরীতে সংখ্যালঘু মানুষের ভাষাকে চাপিয়ে দেয়া কেন মেনে নেব? যদি রাষ্ট্রভাষা করতেই হয়, তবে দেশের অধিকাংশ মানুষ যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষাকেই করা উচিত। তার বিপরীতে ছিল খাজা নাজিম উদ্দিন ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘোষণা, সেজন্য বাংলার দামাল ছেলেরা তা মেনে নেয়নি। কার্জন হলেই আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ হয়। কারণ জিন্নাহ সাহেবের দাবিটি ছিল চাপিয়ে দেয়া। ’৪৮ থেকে ’৫২ ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চলে। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউর ও নাম না জানা অনেকের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যা যদি অধিক না হতো, ভাষা আন্দোলনের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। ভাষা আন্দোলন হতো অযৌক্তিক। তেমনিভাবে ৯০ শতাংশেরও অধিক মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়াই যৌক্তিক। তার বিপরীতে প্রশ্ন তোলা বরং পৃথিবীর অদ্ভুত সব প্রশ্নের মতোই। ৭ বা ৮ শতাংশ হিন্দু, ১/২ শতাংশ খ্রিস্টান, বৌদ্ধ আর এক সহ¯্রাংশেরও কম নাস্তিকের অযৌক্তিক দাবির নিকট কেন আমরা মাথা নত করব?
ধর্মের নামে পাকিস্তানের জন্ম হলেও ধর্মীয় জ্ঞানে পারদর্শী কোনো আলেম দ্বারা পাকিস্তান পরিচালিত হয়নি। অন্যদিকে পর্বতসম বৈষম্যের কারণে বাংলার শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যেও ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল’ কথাগুলো পাওয়া যায় না। তাহলে সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কথা তোতাপাখির মতো কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছেন কেন? আর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলে তাদের সমস্যাই বা কী? অন্য ধর্মগুলো কী বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয়? কেন অযথা এই আশঙ্কা? সত্যিকার ইসলামের যারা অনুসারী, তারা হিন্দু বাড়িতে আগুন দিতে পারে না। আর অধিকাংশ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাই অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর রাজনৈতিক কারণে হয়েছে এবং কখনো কখনো তা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উপায় হিসেবে করানো হয়েছে।
ছোটবেলা যদু ও মধুর ব্যবসা সম্পর্কিত একটি গল্প শুনেছিলাম। যদু ৯০ টাকা আর মধু ১০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে। ব্যবসায়ে লাভ হয় ১০ টাকা। মধু বাবাজী ৫ টাকা লাভ দাবি করে বসে। মূলধন যা-ই হোক মুনাফার অর্ধেক আমাকে দিতে হবে। যে যা-ই বলুক মধুর দাবি ওই একটাই। সে বুঝতেই চাচ্ছে না মুনাফা বণ্টিত হয় মূলধন হারে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের দাবি অনেকটা এরকমই।
ধর্মহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। তাহলে বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত করতেন না বা তাবলীগ জামাতের জন্য টঙ্গীতে স্থান বরাদ্দ দিতেন না। ‘ধর্ম’ মানে যা ধারণ করে মানুষ সঠিক পথের সন্ধান পায়। ধর্মহীন জীবন বল্গাহীন জীবনের ন্যায়। ধর্মহীনতার কারণে আজকের বাংলাদেশে যে সমস্ত দুর্নীতি, অসামাজিক কর্মকা-, খুন, সন্ত্রাস, ছিনতাই ও অনৈতিক কর্মকা- চলমান, তা যদি বাড়তে থাকে তাহলে কার লাভ?
‘ইসলাম মানেই জঙ্গিবাদ’, ‘মহানবী (সা.) যুদ্ধবাজ’ এসব থিওরি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মহানবী (সা.)-এর আগমনের পূর্বে ১০০ বছরে আরবে যুদ্ধ হয়েছে ১৭০০টি। মহানবী (সা.) ৬৩ বছরে যুদ্ধ করেছেন মাত্র ২৭টি। সুবিবেচক প্রতিটি মানুষের নিকট দাবিÑএকটু তুলনা করুন। তদুপরি ইসলামের একটি সুস্পষ্ট সমরনীতি আছে। এটি আক্রমণাত্মক নয়, বরং প্রতিরক্ষামূলক। আর যুদ্ধের লক্ষ্যই শান্তি প্রতিষ্ঠা। বর্বর মরুময় আরবে এতিম মুহাম্মদ (সা.) তাঁর চরিত্রমাধুর্য দিয়েই মানুষকে ইসলামের সুমহান পথের দিকে আহ্বান করেছেন। আমাদের এই আলোকিত ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায় এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী মানুষ। তাদের উসকানিতেই ১৯৮৮ সাল থেকে সংবিধানে বলবৎ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল চেয়ে রিট পুনঃ দাখিল; যা এক ভয়ানক ধৃষ্টতা। এই স্পর্ধার নাম মানবাধিকার নয়। বরং মানবাধিকারকে লুণ্ঠন করার শামিল।
গত শতাব্দীতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কত লাখ লোককে যুদ্ধের নামে হত্যা করা হয়েছে? এখানে ধর্ম কী করেছে? ধর্ম কোথায়? আমরা যদি গুগলে সার্চ করি তবে পাই, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৬) মৃতের সংখ্যা ১৭ মিলিয়ন বা এক কোটি ৭০ লাখ এবং আহতের সংখ্যা ২০ মিলিয়ন বা দুই কোটি। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১১ মিলিয়ন বা ১ কোটি ১০ লাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৪৫) প্রায় ৫৩ লাখ মিলিটারি এবং প্রায় সাড়ে ৬ লাখ সাধারণ নাগরিকের প্রাণহানি ঘটে। সর্বশেষ ২০০৫ সালের তথ্যে উঠে এসেছে সর্বমোট ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮০০ মানুষের প্রাণহানির কথা। এসব ঘটনার যারা নায়ক, যারা কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল, তাদেরকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলতে কেন আমাদের অন্তর কেঁপে ওঠে? কোথায় আমাদের মুক্তমনা চিন্তাধারা? ইসলামের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেই প্রমাণিত হয়ে যায় যে, ‘ইসলাম সত্য ধর্ম’। আর বাংলাদেশে গণভোট দিলেও তা-ই প্রমাণিত হবে।
এদেশের প্রায় ১৪ কোটি মানুষের হৃদয়ের মণিকোটায় সংরক্ষিত প্রাণপ্রিয় ধর্ম ইসলাম নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? ইসলাম সংবিধানে বহাল থাকলে কার কী অসুবিধা হয়? একটা যৌক্তিক বিষয়কে অসার কতগুলো যুক্তি আর আবেগ দিয়ে অস্বীকার করার মানে হয় না। তাই আজকে দাবি উঠেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উসকানিদাতা হিসেবে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে নিষিদ্ধ করার। এ দাবিও করেছে ওলামা লীগ। (দৈনিক ইনকিলাব, ১৩ মার্চ ২০১৬)। অন্য ইসলামী দলগুলোও একই দাবিতে একমত হবে। যদিও এই দাবির সাথে আমি ব্যক্তিগতভাবে একমত নই। তবে এমন দাবি কোনো পক্ষেরই করা উচিত নয়, যা অবাস্তব। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দের সদয় অনুধাবনের জন্য বলব, ডাক্তার প্রতিটি ট্যাবলেট দৈনিক তিন বেলা তিন বারে খাওয়ার জন্য রোগীকে প্রেসক্রাইব করলেন। কিন্তু প্রতিবেশীর প্ররোচনায় যদি রোগী তিনটি ট্যাবলেট একসাথে খেয়ে ফেলেন এবং রিঅ্যাকশনের জন্য ডাক্তার বা ওষুধের দোষ দেন, এটা কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে? আরও একটু পরিষ্কার করে বলি, কোনো মুসলিম কোনো অপরাধ করলে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। এ জন্য ইসলামকে দোষারোপ করা ওই রোগী বা রোগীকে প্ররোচনাদানকারী প্রতিবেশীর মতোই হবে।
আর একটু আত্ম-উপলব্ধির জন্য বলছি, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দায় আমরা কিন্তু অনায়াসেই বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের ওপর দিতে পারি। মহাভারতের অধিকাংশই যুদ্ধ-বিগ্রহের কাহিনীতে ভরপুর। রামায়ণে বর্ণিত যুদ্ধ আর রক্তপাতের কাহিনী সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করুন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ’ মহাকাব্য উচ্চশিক্ষিত কে না পড়েছেন? এর দায় দেখিয়ে হিন্দু-ইজম নিষিদ্ধের দাবি উঠলে আপনারা কতখানি সহনীয় থাকবেন? যদি নিজে সহ্য করতে না পারেন, একই বিষয়ে অন্যকে আঘাত করা থেকে বিরত থাকুন।
আপনারা নিজেদের নিয়ে ভাবুন। আপনারা নিজেরাও তো একটি করে ধর্ম ধারণ করে আছেন। কোনো ধার্মিক লোক তো অন্য ধর্মকে আঘাত করতে পারে না। আর হিংসার পরিণাম কখনই ভালো হয় না। পৃথিবী এখন এগিয়ে যাচ্ছে। আসুন আমরাও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত করতে এগিয়ে আসি।
রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে ডরশরঢ়বফরধ থেকে জানা যায়, অ ংঃধঃব ৎবষরমরড়হ (ধষংড় পধষষবফ ড়হ বংঃধনষরংযবফ ৎবষরমরড়হ, ংঃধঃব পযঁৎপয, বংঃধনষরংযবফ পযঁৎপয, ড়ৎ ড়ভভরপরধষ ৎবষরমরড়হ) রং ধ ৎবষরমরড়ঁং ড়ৎ পৎববফ ড়ভভরপরধষষু বহফড়ৎংবফ নু ঃযব ংঃধঃব. অ ংঃধঃব রিঃয ড়হ ড়ভভরপরধষ ৎবষরমরড়হ, যিরষব হড়ঃ ংবপঁষধৎ, রং হড়ঃ হবপবংংধৎরষু ধ ঃযবড়পৎধপু ধ পড়ঁহঃৎু যিড়ংব ৎঁষবৎং যধাব রহ ঃযবরৎ যধহফং নড়ঃয ংবপঁষধৎ ধহফ ংঢ়রৎরঃঁধষ ধঁঃযড়ৎরঃু. প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রের কত শতাংশ মানুষ একটি ধর্ম প্রতিপালন করলে তাকে আপনি রাষ্ট্রধর্ম বা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম বলবেন? জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলিম অধিবাসীরা সে যোগ্যতা রাখে। যুক্তির কষ্টিপাথরে ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্য এবং বিকল্পহীন। পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রে (কারও কারও মধ্যে প্রায় ৫৮টি) রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। যেহেতু প্রবিধান রয়েছে এবং বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত, তা বহাল থাকলে যদি জনস্বার্থ ব্যাহত হয়, না থাকলে তো তার চেয়ে ৯ গুণ জনস্বার্থ ব্যাহত হবে; সুতরাং বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলবৎ রাখাই ন্যায্য ও সঠিক।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ধিফথ০১১@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন