ড. আব্দুল হাই তালুকদার
গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির ষষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। অনেক জল্পনা-কল্পনা ও আশা-নিরাশার মধ্যেও দলটি সম্মেলন করতে পারায় দলের নেতাকর্মী সমর্থকের সাথে দেশবাসীও আনন্দিত। সম্মেলনকে ঘিরে নানা রকম মন্তব্য, কটাক্ষ ও ষড়যন্ত্র কাজ করেছে। সম্মেলন স্থলের জন্য বারবার আকুতি-মিনতি, আবেদন-নিবেদন করেও কর্তা ব্যক্তিদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যাচ্ছিল না। শেষে বিএনপি থেকে যখন যে কোন মূল্যে সম্মেলনের ঘোষণা দেয়া হলো তারপর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সম্মেলন করার অনুমতি পাওয়া যায়। বিশাল একটি রাজনৈতিক দলের জন্য বরাদ্দকৃত স্থানটি খুবই ছোট হওয়ায় কাউন্সিলররা দেশি ও বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিএনপির কাউন্সিলর ২৮৫০ জন, দেশি-বিদেশি অতিথির সংখ্যাও ৪ থেকে সাড়ে চার হাজার হবে। অসংখ্য নেতাকর্মী মিলে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একাংশ বরাদ্দ পাওয়ায় কোনো রকমে সম্মেলন সম্ভব হয়।
রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মনোভাব মানব কল্যাণে নিবেদিত। মানবকেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনা ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণে রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনীতির জন্ম। রাজনীতি অর্থ হলো নীতির রাজা, রাজার নীতি নয়। রাজা যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো একেবারেই নয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেহেতু রাজনীতিবিদদের জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে কাজ করতে হয়, যে কারণে তারা সর্ব কাজে জনগণের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, প্রত্যাশা-প্রাপ্তি ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে বাধ্য হন। যে শাসক জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেন না জনগণ একসময় সে শাসককে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সে জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে একটি নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্ব সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেয়। কাউন্সিলে সারা দেশের সকল স্তরের নেতাকর্মী একত্রিত হন ও এক আবেগঘন পরিবেশে মত বিনিময় করেন। এবারে সম্মেলনে তরুণদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ক’দিন আগে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের কথা বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, দলের নেতাকর্মীরা পদ-পদবি পাবার জন্য যেভাবে ছোটাছুটি করে তার অর্ধেক যদি আন্দোলনে সক্রিয় থাকতেন তাহলে আন্দোলন সফল হতো এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রতিষ্ঠিত হতো। এ কথায় সত্যতা রয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অনেকে আত্মহুতি দিয়েছেন। অনেকে জীবন বাজি রেখে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। বিশেষ করে গ্রামগঞ্জ ও মফস্বল শহরে নেতাকর্মীরা যেভাবে আন্দোলন করেছেন বড় বড় শহর বিশেষত ঢাকা শহরে আন্দোলন সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ৫ জানুয়ারি ’১৬ এর কয়েকদিন আগে একবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম। তার বাসায় হাজার হাজার লোকজন দেখে আমি মির্জা সাহেবের ব্যক্তিগত সচিবকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পাই যে, তারা পদ-পদবি লাভের তদবির করতে এসেছেন। এক নেতার বাড়িতে এত লোকের সমাহার থেকে সহজেই অনুমান করা যায় অন্যান্য নেতাদের বাড়িতেও ঐ রকম ভিড় ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সারাদেশে আন্দোলন হলেও ঢাকায় আন্দোলন ছিল সীমিত আকারের। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা রকম অপপ্রচার ও মিথ্যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা দেয়া হলেও তারা কিন্তু আন্দোলন থেকে সরে যাননি। বেগম জিয়া কোন ছলছুতা করে দেশ ত্যাগ করে বিদেশে গিয়ে অবস্থান ও রাজনীতি করেননি। তার জন্ম-মৃত্যু ও বসবাস বাংলাদেশে যা তিনি বিভিন্ন সময় বলেছেন। সকল রকম ভয়-ভীতি, লোভ-লালসা বা আকর্ষণে তিনি দেশ ছেড়ে পলায়ন করেননি। কর্তৃত্ববাদী সরকার বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার নানা রকম ফন্দি-ফিকির অবলম্বন করলেও তারা ভীত বা শঙ্কিত নন যা তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তৃতা বিবৃতি থেকে স্পষ্ট।
আন্দোলনের সময় টানা ৯০ দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, খাদ্য পানীয় বন্ধ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা কর্তন করা হলেও বেগম জিয়া নতি স্বীকার করেননি। শত প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে তিনি কর্তব্য কর্মে অবিচল থাকেন ও আন্দোলন চালিয়ে যান। পঞ্চাশোর্ধ নেতাকর্মীদের নিয়ে গুলশান অফিসে বন্দি থেকে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেও তিনি পিছ পা হননি। তার দৃঢ় মনোবল ও কঠিন প্রতিজ্ঞা নেতাকর্মীদের নিকট তাকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তোলে। তার ওপর আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনায় দায়িত্ব অর্পণ করে নেতা কর্মীরা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তাই তারা সম্মেলনের আগেই বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের ওপর নেতৃত্ব তুলে দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে লক্ষ কোটি নেতাকর্মীদের মধ্যে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে যাননি। বেগম জিয়া চতুর্থ বারের মতো ও তারেক রহমান দ্বিতীয় বারের মতো চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
বেগম জিয়া ও তারেক রহমানকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করায় আমরা আনন্দিত। তাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা ক্ষোভ প্রকাশ করে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত মন্তব্য করে সমালোচনা করেছেন। এ দু’জন যেন সরকারের চক্ষুশুল। এ দু’জনকে বাদ দিলে যেন বাংলাদেশে শান্তির নহর বয়ে যাবে। বাংলাদেশ যেন দুর্নীতিমুক্ত একটি সম্পদশালী উন্নত দেশে পরিণত হবে। আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ বছরে সৃষ্ট দুর্নীতিতে বাংলাদেশ প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়। তাদের সৃষ্ট জঞ্জাল সাফ করতে বেগম জিয়ার পাঁচ বছর লেগেছে। তাছাড়া সে সময় মাত্র ৬০ দেশের ওপর জরিপ করে টিআইবি রিপোর্ট তৈরি করে। পরবর্তীতে শতাধিক দেশ এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যার মধ্যে আফ্রিকার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলো রয়েছে। শতাধিক দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩/১৪ নম্বরে ওঠানামা করছে। বর্তমানে বিএনপির শাসনামলের চেয়ে দশগুণ দুর্নীতি ব্যাপকতা লাভ করেছে। হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ার বাজার, বেসিক ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক প্রভৃতির দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করেছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮০০ কোটি লোপাট হওয়া দুর্নীতির এক ভয়াবহ চিত্র। এমন কোন সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। দুর্নীতি গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। একটি পিয়নের চাকরি পেতে ৪ থেকে ৬ লাখ টাকা উৎকোচ দিতে হচ্ছে। একজন চাকরি পেলেও অনেকে প্রতারিত হচ্ছে। সরকারি অফিস আদালত ঘুষ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, আইডিবি জাইকা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা বিভিন্ন প্রকল্প থেকে শত শত কোটি টাকা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
বিএনপির এই ষষ্ঠ সম্মেলনের স্লোগান ছিল ‘দুর্নীতি দুঃশাসন হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’। এ দল এদেশের লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণ প্রিয় সংগঠন। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই দলটি মানবকল্যাণ কর্মকা- ও কর্মসূচি দিয়ে মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। বাকশালী শাসন কাঠামো ছিন্ন করে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এই দল সৃষ্টির পর থেকে শুরু হয় মানবকেন্দ্রিক কর্মপরিকল্পনা, যার সুফল দেশবাসী ভোগ করে ফলে দেশবাসীর অন্তরে জিয়ার অবস্থান সুদৃঢ় ও স্থায়ী হয়। দেশ-বিদেশের কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রে জিয়া ১৯৮১ সালের ৩০ মে নিহত হন। পরবর্তী সময়ে দেশ এরশাদের সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। এ সময় বেগম জিয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ও তাদের প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে বিএনপির হাল ধরেন। দীর্ঘ নয় বছর তিনি রাজ পথে থেকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। এ সময়কালে আওয়ামী লীগ জনগণের প্রত্যাশার সাথে প্রতারণা করে এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এতে সামরিক শাসনের দীর্ঘায়িত হয়। তবে বেগম জিয়ার আপসহীন নেতৃত্বে এদেশের ছাত্র, যুব ও মেহনতী মানুষের অনেক ত্যাগ তিতিক্ষায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ শাহীর পতন ঘটে। দেশবাসী বেগম জিয়ার দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগী মনোভাব অবলোকন করে ৯১ সালের নির্বাচনে তাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব দান করেন।
তিনি তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেন। তবে একটি রাজনৈতিক দলের অসহযোগিতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা- মোকাবেলা করে তাকে চলতে হয়। ১/১১ অবৈধ অগণতান্ত্রিক সেনা সমর্থিত সরকারের অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে রাজনীতিতে টিকে ছিলেন। বিনা কারণে ও বানোয়াট মামলা দিয়ে বেগম জিয়া, তারেক রহমান ও কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। তারেক রহমান ও কোকোর ওপর চলে অমানুষিক বর্বর নির্যাতন। নির্যাতনে তারা দীর্ঘস্থায়ী দৈহিক অসুস্থতায় নিপতিত হন। তারেক রহমান এখনও বিদেশে চিকিৎসাধীন। কোকো অসুস্থতায় ভুগতে ভুগতে অকালে ইহধাম ত্যাগ করেছেন। আল্লাহ তার আত্মাকে শান্তিতে রাখুন এই প্রার্থনা করছি। তারেক রহমান সুস্থ হয়ে ফিরে এসে মায়ের পাশে দাঁড়ান এ প্রার্থনাও কায়মনো বাক্যে করছি। বেগম জিয়ার বয়স হয়েছে। এ সময় তার পাশে দক্ষ কুশলী মেধাসম্পন্ন ও গণমানুষের প্রিয় তরুণ রাজনীতিক তারেক রহমানের খুবই প্রয়োজন।
বিএনপির কাউন্সিলদের সাথে প্রায় ৫০ হাজার দেশি-বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথি ও নেতাকর্মীর সামনে বেগম জিয়া কাউন্সিলের উদ্বোধন করে এক আবেগময়ী দিক নির্দেশনামূলক বক্তৃতা দিয়েছেন। ক্ষমতায় গেলে ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা পেশ করেন। এটি তার নতুন সামাজিক চুক্তি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচির সাথে অনেকটা সঙ্গতি রেখে তিনি তার ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনা পেশ করেছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম জিয়ার বক্তব্যের পূর্বে বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বারবার সংলাপের আহ্বান জানানো হলেও সরকার কর্ণপাত করেনি ফলে সর্বত্র অশান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। তিনি আরও বলেন নির্বাচন কমিশন দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ কমিশনের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। সকলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করা আবশ্যক, সরকার এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে ইত্যাদি।
বেগম জিয়া তার ভিশন-২০৩০ অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয় ও অঙ্গীকার নিয়ে ঘোষণা করেন। কাউন্সিলের আগে থেকেই সরকারি কর্তা ব্যক্তিরা বিভিন্ন কটাক্ষ মন্তব্য ও অরাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন। ‘নেতৃত্বে পরিবর্তন নেই, ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়’- ওবায়দুল কাদের। আমাদের কথা হলো, নেতৃত্বে কে বা কারা থাকবেন এটি বিএনপির একান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। এ ব্যাপারে অন্যের মাথা খাটানোর দরকার নেই। বিএনপির বহু বড় বড় রাজনীতিক, প-িত, বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী রয়েছেন। বিষয়টি তারাই ভালো বুঝবেন। তাছাড়া পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি সারা বিশ্বে চালু আছে। শেখ মুজিবুর রহমান, নেহেরু, বুশ, ক্লিনটন, ইন্দিরা গান্ধি প্রভৃতি রাজনীতিবিদদের বংশপরম্পরায় রাজনীতি চলছে। এতে দোষের কিছু নেই।
বেগম জিয়া ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনা পেশকালে অত্যন্ত বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দুর্নীতি, দুঃশাসন ও বিশৃঙ্খলতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসবাদ দৃঢ় হস্তে দমনের অঙ্গীকার করে তিনি এক ভবিষ্যৎ শান্তিময় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি রাষ্ট্র নায়কের মতো ভবিষ্যতে হিংসা বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা ভুলে সকলকে নিয়ে ঐক্যমতেরভিত্তিতে দেশ পরিচালনার কথা বলেছেন। শহীদ জিয়ার আদলে বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। নেতিবাচক রাজনীতি পরিহার করে ইতিবাচক রাজনীতি চালু করা তার লক্ষ্য। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি ও উন্নয়ন ঘটিয়ে বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার অঙ্গীকার করেন। এ সময়কালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ৫ হাজার ডলার ও জাতীয় প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে নেবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। আর এসব সম্ভব শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের মধ্যে দিয়ে। তিনি বর্তমান বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থাকে অন্ধকার আখ্যাদিয়ে তা থেকে বের হয়ে আলোর পথে দেশকে পরিচালিত করতে চান। এ লক্ষ্যে তিনি নারী-পুরুষ ও যুবক সম্প্রদায়কে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির সাথে সম্পৃক্ত করতে চান। তিনি বলেন, আমার ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনা আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে সংযুক্ত করা হবে।
আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তিনটি মৌলিক নীতির কথা বলা হয়েছে- ১. মানবিক মর্যাদা, ২. সামাজিক ন্যায় বিচার এবং ৩. সাম্য। বেগম জিয়া এই তিনটি লক্ষ্য পূরণে সকল নৃগোষ্ঠীর আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে যথোপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। সুনীতি, সুশাসন ও সুসরকার প্রতিষ্ঠা করে হিংসা বিদ্বেষ ও প্রতিশোধের রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে বেগম জিয়া জনগণের মালিকানা জনগণকে ফেরত দিতে চান। নির্বাচন কমিশন দুদক, মানবাধিকার কমিশন, পিএসসি, ইউজিসি প্রভৃতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সত্যিকার স্বাধীনতা দিয়ে নিরপক্ষভাবে সাজাতে চান। বিচার বিভাগ, পুলিশ, বিজিবি, সামরিক বাহিনী প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম করে রাষ্ট্রের চরিত্রকে পালটাতে চান। দমন-পীড়ন নির্যাতনের হাতিয়ার সকল কালাকানুন বাতিল করে রাষ্ট্রকে কলুষমুক্ত করতে চান। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়ন করতে চান। আধুনিক প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে প্রশাসনকে সাজায়ে দেশের উন্নতি অগ্রগতি ত্বরান্বিত করার অভিলাশ ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশে দলীয় আনুগত্যের বদলে প্রাধান্য পাবে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততা। প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়া হবে। ওয়ানডে ডেমোক্রেসি প্রতিষ্ঠা না করে সর্বক্ষেত্রে ও সকল সময়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বহাল থাকবে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পরিষদ রাজনৈতিক বিবেচনায় গঠন না করে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা অভিজ্ঞতা ও সততারভিত্তিতে গঠিত হবে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে কঠোর হস্তে দমন করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হবে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দুরবস্থা দূরীকরণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিয়ে দেশকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে নেয়া হবে। তথ্য ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে উন্নতি বেগম জিয়ার সরকারের লক্ষ্য। বিশ্বমানের লেখাপড়া নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হবে। দুর্নীতির সাথে কোন রকম আপর না করে দলমত নির্বিশেষে দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে ন্যায়পাল নিয়োগ দিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ঘোষণাও বেগম জিয়ার ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনায় রয়েছে। মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সিলেবাসে সংস্কার আনা হবে। তারাও যাতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে পারে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি দেয়া হবে।
বেগম জিয়া তার ভিশনে সুন্দরবনসহ জাতীয় ঐতিহ্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবার ঘোষণা দিয়েছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদন, জ্বালানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, রেল, নৌ ও স্থলপথের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি তার সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বেকার সমস্যা সন্তোষজনক সমাধান করে বিপথগামী যুবাদের সঠিক পথে আনার কার্যকর পদক্ষেপ নেবার ঘোষণা যুবাদের অনুপ্রাণিত করবে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে সর্বময় ক্ষমতা সংসদীয় গণতন্ত্রের স্পিরিটকে নষ্ট করছে। বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে আলোচনা সমালোচনা অহরহ শোনা যাচ্ছে। বেগম জিয়া সরকার গঠন করতে পারলে দ্বিমক্ষবিশিষ্ট সংসদ সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির কথা বলেন। অর্থাৎ তিনি ক্ষমতাকে কুক্ষীগত না রেখে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে আগ্রহী। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে ফেরত দিতে তিনি উন্মুখ। তাই তো তিনি তরুণ কাউন্সিলরদের নেতৃত্বে আনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
তিনি দেশে প্রকৃত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জীবন ও সম্পদের অধিকার রাজনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন দেশে আজ মানবাধিকার ভূ-লুণ্ঠিত, আমার দেশসহ অনেক সংবাদপত্র বন্ধ, চ্যালেন ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতন চলছে। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, শওকত মাহমুদসহ অনেক সাংবাদিককে জেলখানায় বন্দি রাখা হয়েছে। বিচার বহির্ভূত হত্যা চলছে। সাগর রুণী হত্যার বিচার নেই। বিচারহীনতা সংস্কৃতি বর্তমান গণতান্ত্রিক পরিবেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন।
বেগম জিয়া সার্বিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, দুঃশাসনে ভরা দূষিত রাজনীতি দূর করে জনগণকে আলোকিত রাজনীতি উপহার দেবার ঘোষণা দেন। এটি সম্ভব জাতীয় ঐক্যমতেরভিত্তিতে। দেশের সার্বিক অবক্ষয় দেখে বেগম জিয়া দুঃখিত, ব্যথিত ও হতাশ। তিনি ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অঙ্গনকে কলুষমুক্ত করে সামাজিক অস্থিরতা দূর করে একটি শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। শাসনবিভাগ, আইনবিভাগ, বিচারবিভাগ, প্রশাসন, আর্থিক খাত, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষা সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব বাংলাদেশ নামক মরা গঙ্গাকে তিনি বহমান ¯্রােতস্বীনি করতে দূর প্রতিজ্ঞ বেগম জিয়া কোন তামাশা না করে সত্যিকার দরদি মন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করে সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তির আবাসভূমি নির্মাণ করতে চান। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন নেতাকর্মীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তাকে বাস্তবে রূপ দেবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এ সম্মেলন খুবই সফল হয়েছে। ৩ হাজার কাউন্সিলর ও ৫০ হাজার দেশি-বিদেশি অতিথি ও নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ সম্মেলন সাফল্যম-িত করেছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। বেগম জিয়ার সৃজনশীল ভবিষ্যতমুখী পরিকল্পনা এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে অসামান্য অবদান রাখবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ নামক ভূখ-টিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে ও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। তিনি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ঐক্যমতের ভিত্তিতে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনে সংলাপ আয়োজনের আহ্বান পূর্ণব্যক্ত করে সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। অল্পদিনের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী ব্যবস্থায় বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনে গঠিত সরকারই বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে পারবে। আমরা বাংলাদেশ, বেগম জিয়া, তারেক রহমান ও বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়ন অগ্রগতি সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
য় লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন