মীর আব্দুল আলীম
সুন্দরবনের ঝুঁঁকি কাটছে না। আবারো সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শ্যালা নদীতে কার্গো জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে। ১৯ মার্চ ‘সি হর্স-১’ নামে একটি কার্গো জাহাজ ১ হাজার ২৩৫ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে শ্যালা নদীর হরিণটানা এলাকায় ডুবে যায়। এ নিয়ে গত দুই বছরের মধ্যে এই রুটে ৭টি দুর্ঘটনা ঘটল। এর আগে ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঘটে গেছে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে পানিতে তেল মিশে যাওয়ার ভয়াবহ ঘটনা, যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। ২০১৫ সালের ৫ মে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর বিমলের চরে এমভি জাবালে নূর নামে একটি সারবাহী কার্গো ডুবে যায়। জাহাজটিতে প্রায় ৫শ’ মেট্রিক টন এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) সার ছিল। ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর ৫১০ টন কয়লা বোঝাই একটি কার্গো ডুবে যায়। এরপর আরো কয়েকটি কার্গোডুবি ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এই নৌ চ্যানেলটি দিয়ে পণ্যবাহী যানচলাচল বন্ধ করতে দেশে-বিদেশে পরিবেশবাদী ও সচেতন মহলের উদ্বেগ এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এতদিন তা কার্যকর হয়নি। বিকল্প রুট চালু না থাকার অজুহাতে বিআইডব্লিউটিএ এই চ্যানেল দিয়ে নৌযান চলাচল উন্মুক্ত রেখছে এবং দুর্ঘটনাও ঘটে চলেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, গত ২৩ মার্চ বুধবার এই চ্যানেলটি দিয়ে নৌচলাচল বন্ধ রাখার ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের আঁধার, ঝড়-জলোচ্ছাস, মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, এ জনপদের সবচেয়ে বড় ঢাল বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন বারবারই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে। সিডর, আইলা, লায়লা, মহাসেনের আঘাতে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সুন্দরবন। উপরন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করায় বিপর্যস্ত করছে সুন্দরবনের পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য।
এমনিতেই সুন্দরবন রয়েছে নানা ঝুঁঁকিতে। কয়লাবাহী এই জাহাজডুবির ঘটনায় সুন্দরবনের জন্য দীর্ঘ বিষক্রিয়া সৃষ্টি করবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, কয়লার সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন প্রভৃতি সুন্দরবনের পানিতে মিশে বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন, জীববৈচিত্র্য ও বায়ুম-লকে দারুণভাবে দূষিত করবে। এই কয়লা মিশ্রিত পানি থেকে সৃষ্ট ক্ষতিকর মিথুন গ্যাস সুন্দরবনের শ্বাসমূল, উদ্ভিদ ও ডলফিনসহ মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গত এক দশকে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, জলবায়ু পরিবর্তন ও লবণাক্ততার প্রভাবে আগামী দু’দশক নাগাদ সুন্দরবন থেকে সুন্দরী গাছ বিলীন হয়ে যেতে পারে। দেশের অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। সুন্দরবনে ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৪৩ প্রজাতির মালাস্কা বিদ্যমান। অসংখ্য সম্পদরাজিতে ঐশ্বর্যম-িত সুন্দরবনকে রক্ষায় এখনই কার্যকর ও স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে ঘষিয়াখালী চ্যানেলসহ বন্ধ থাকা নৌপথগুলো দ্রুত চালু করতে হবে। পরিতাপের বিষয়, সম্প্রতি ডুবে যাওয়া জাহাজটি দ্রুত উত্তোলনের কোনো পদক্ষেপ আমাদের নজরে পড়েনি। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা আছে বলেও মনে হয় না। এটা ঠিক, ডুবে যাওয়া পণ্যবাহী জাহাজ দ্রুত উত্তোলনে সংশ্লিষ্টদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তা সত্ত্বেও এ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত। একটি কয়লা বোঝাই জাহাজ দিনের পর দিন নদীতে ডুবে থাকবে, এটা হতে পারে না। সুন্দরবন এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষার বিষয়ে অবহেলা করার সুযোগ নেই।
সুন্দরবনের জন্য সম্প্রতি বড় হুমকি মনে করা হচ্ছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তির পর থেকেই তেল-গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের তীব্র বিরোধিতা করে আসছে। তবুও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন করে ভারতীয় কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে এমন অভিযোগ খুব পুষ্ট। নিয়মনীতি ও পরিবেশ আইন অগ্রাহ্য করে সরকার সুন্দরবনের আরো কাছে কয়লাভিত্তিক আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ওরিয়ন গ্রুপকে অনুমতি দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, এটি হলো সুন্দরবন ধ্বংসেরই নামান্তর। আশার কথা এতটুকুই যে, গত ২৫ জুন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ম্যানগ্রোভ বা বাদাবন কাটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন মহামান্য হাইকোর্ট। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। শ্যামনগরের স্থানীয় এক বাসিন্দার করা রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে আদালতের দেয়া নির্দেশটি ম্যানগ্রোভ বন রক্ষায় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। এখন কেউ কেউ বলছেন, একসঙ্গে বিদ্যুৎ চাইব আবার বনও চাইব তা কিন্তু হবে না। যে কোনো একটা চাইতে হবে। সুুন্দরবন নাকি বিদ্যুৎ? কোনটা চাইবেন? নিঃসন্দেহে বিদ্যুতের প্রয়োজনীয়তা অনেক। অন্যদিকে আরো বেশি প্রয়োজন সুন্দরবনের। সুন্দরবন আমাদের নিরাপত্তা প্রাচীর। জাতীয় স্বার্থেই একে বাঁচাতে হবে। বিদ্যুতের বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবনের বিকল্প নেই, এটাই তো মোদ্দা কথা। সুন্দরবনকে কিছুতেই ধ্বংস হতে দেয়া যায় না। আগামী প্রজšে§র জন্য সুন্দরবনকে আমাদের সুরক্ষিত রেখেই যেতে হবে। জীববৈচিত্র্যের সম্ভার, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বৃহত্তর খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই বন জানমাল রক্ষায় সুরক্ষা হিসেবে কাজ করেছে। সরকার সব নিয়মনীতি ও পরিবেশ আইন অগ্রাহ্য করে সুন্দরবনের কাছে দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। সুন্দরবনের কাছে বাগেরহাটের রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে উপকূলীয় লোকজন অরক্ষিত হয়ে পড়বে, বিপর্যয়ে পড়বে বনের জীববৈচিত্র্য। প্রস্তাবিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যখন পক্ষ-বিপক্ষে চলছে নানা বিতর্ক, সুন্দরবন নিয়ে শঙ্কিত দেশের মানুষ, তখন সেই শঙ্কা তোয়াক্কা না করে সুন্দরবনের আরো কাছে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছে ওরিয়ন গ্রুপ। ইতোমধ্যে বাগেরহাটের মংলায় প্রকল্প এলাকায় জমি কিনে মাটি ভরাটের কাজও শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। মাটি ভরাট শুরু করলেও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরিবেশের বিষয়ে কোনো ছাড়পত্রই নেয়নি ওরিয়ন গ্রুপ এমন অভিযোগও আছে। নিয়ম না মানায় পরিবেশ অধিদফতর কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিলেও তা মানছে না ওরিয়ন। এবার হাইকোর্টের নির্দেশ কতটা কার্যকর হয় তাই এখন দেখার বিষয়।
আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, রামপাল প্রকল্প ও ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎ প্রকল্প দু’টির দূষণে নিবিড় সুন্দরবন পরবর্তী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যেই হারিয়ে যাবে। কেবল রামপালের ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে প্রতিদিন ছড়িয়ে পড়া ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড, ৮৫ টন নাইট্রোজেন, ডাই-অক্সাইড, ২ হাজার ৬০০ টন ছাই সুন্দরবনের নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে নিয়ে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রকল্প কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় ৪৭ লাখ টন কয়লা সুন্দরবনের গভীরতম অংশের মধ্য দিয়েই পরিবহন করা হবে। লাখ টনি বাল্ক ক্যারিয়ার আর হাজার টনি লাইটারেজ জাহাজের বছরব্যাপী আনাগোনা, তীব্র শব্দ, জাহাজ হতে চুইয়ে পড়া তেল, কয়লার ভাঙা টুকরা, জাহাজ চলাচলের প্রচ- ঢেউ যে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে নিয়ে আসবে। কয়লা পুড়ে ছাই হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় আরেকটি বর্জ্য কোল সøাজ বা তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই এবং সøাজ উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। এতে মানবদেহের যেমন ক্ষতি হবে, তেমনি বন ও বন্যপ্রাণীরও ক্ষতি হবে। কাজেই এসবের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে এখনো ভাবার সব সময় ফুরিয়ে যায়নি।
সুন্দরবন শুধু বাংলাদেশেরই নয় এটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। পৃথিবীতে নোনাপানির এত বিশাল বন আর নেই। এর অংশবিশেষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যেও ছড়িয়ে আছে। এর রয়েল বেঙ্গল টাইগারের পরিচিতি দুনিয়াজুড়ে। মায়াবি চিত্রা হরিণের অবাধ বিচরণ পৃথিবীর যে কোনো দেশের প্রকৃতি প্রেমিককে মুগ্ধ করে। বনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত অসংখ্য খাল দিয়ে জোয়ারের সময় অবাধে নৌকায় ঘোরা যায়। ওখানে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম বিষধর সাপ রাজ গোখরা। নোনাপানির কুমিরগুলো কখনো কখনো দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে খাল বা নদীর পানিতে। রয়েছে বহু প্রজাতির বিরল পাখিসহ নানাবিধ জীবজন্তু। এর বৃক্ষরাজিও অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ অমূল্য সম্পদ। কিন্তু সুন্দরবনের অস্তিত্বই এখন পড়েছে সংকটের মুখে। সুন্দরবন রক্ষায় নানাবিধ উদ্যোগ-আয়োজনের কথা শোনা গেলেও কার্যত ফল শূন্য। সুন্দরবনের ধারাবাহিক বিপর্যয় রোধে এখনই সবাইকে ভাবতে হবে।
য় লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
newsstore13@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন