শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

খালেদা জিয়া মানুষের ভেতর স্বপ্ন তৈরি করেছেন

প্রকাশের সময় : ২৫ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
শেষ হলো বহুল প্রতীক্ষিত বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে বিএনপির রাজনৈতিক প্রাপ্তি নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে এই কাউন্সিলকে ঘিরে বিএনপির নেতাকর্মীদের মাঝে এক মিলন মেলার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।  উৎসবমুখর এই কাউন্সিলে সমৃদ্ধ দেশ ও আলোকিত মানুষ গড়তে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেন ‘ভিশন ২০৩০’। একই সাথে তিনি প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে উৎপাদনমুখী এক নতুন ধারার সরকার ও রাজনীতি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। খালেদা জিয়া আবারো সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য। এই লক্ষ্যে তিনি দেশবাসীকে জেগে উঠতে বলেছেন, বলেছেন ঐক্যবদ্ধ হতে; বলেছেন হরণ করা অধিকার ছিনিয়ে আনতে। একজন রাজনীতিকের অন্যতম কাজ মানুষের ভেতর স্বপ্ন তৈরি করা। এই কাউন্সিলে খালেদা জিয়া সেটিই করার চেষ্টা করেছেন, তিনি বলেছেন; অন্ধকারের পর্দা দুলে উঠছে। অচিরেই আলো আসবে। খালেদা জিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেনে, স্বপ্ন দেখিয়েছেন মানুষকেও। এ স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে গণতন্ত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষিনীতি, শিল্পনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই নিতে হবে বাস্তবধর্মী উদ্যোগ। পরিবর্তন আনতে হবে মনমানসিকতায় ও আচার-আচরণে, বিশেষ করে রাজনৈতিক বিভাজন থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের রাজনৈতিক সংস্কৃকি গড়ে তুলতে হবে। কেননা মাথা যেমন সমস্ত শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে তেমনি রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে একটি দেশকে এবং দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে। রাজনীতিতে সংকট জিইয়ে রেখে কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সুদূরপরাহত। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে উপনিত। এটি সবাইকে আশাহত করে, বিনষ্ট করে উদ্যম ও উদ্দীপনাকে। কাজেই রাজনৈতিক বিভাজন ও হানাহানি থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি করতে হবে, জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে একটি সুস্থ, সুন্দর গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। খালেদা জিয়ার সংলাপের আহ্বানে সরকারকে সারা দিতে হবে, প্রশস্ত করতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ। কেবল তাহলেই স্বপ্ন নেবে বাস্তবরূপ।
বাংলাদেশের সামনে যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি রয়েছে চ্যালেঞ্জও। আগামী দিনগুলোয় চীন, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও পিলিপাইনসহ প্রভৃতি দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তুমুল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। বিশেষ করে চীন ও ভারতের দিকে বাংলাদেশকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা এ দু’টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে এ দুটি দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে। তারা বাংলাদেশের বাজার ধরতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকেও চেষ্টা করতে হবে কীভাবে এ দুটি দেশে তার পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করা যায়। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশী বিভিন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তা রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় বাংলাদেশকে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করতে হবে। এ ব্যাপারে যা যা সহযোগিতার দরকার ভারতের বাংলাদেশকে করতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণেও। বাংলাদেশকে চীনের বাজারে প্রবেশ করতে হলে ভারত, ভুটান ও নেপালের সহযোগিতার প্রয়োজন। তাছাড়া মিয়ানমার দিয়েও বাংলাদেশ চীনে প্রবেশ করতে পারে।
বাংলাদেশের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ সুবিধাগুলো এ অঞ্চলের অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের নিয়ামক। রাজনৈতিক ও  কৌশলগত অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। উপমহাদেশ এবং এ অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখ-ের বৈচিত্র্য দিয়ে। বাংলাদেশের তিন দিকজুড়ে রয়েছে ভারত। তারপর দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে মিয়ানমার। এর পাশে রয়েছে চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং ইন্দোনেশিয়া। তাছাড়া রয়েছে ভুটান, নেপাল ও সিকিম। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এই প্রতিটি দেশ খুবই সন্নিকটবর্তী। বাংলাদেশ থেকে নেপালের দূরত্ব মাত্র ১৮ মাইল, ভুটানের ৪৫ মাইল এবং চীনের বর্ডার ৪০ মাইল। তাছাড়া বাংলাদেশ সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানা শুরু সমুদ্রের জলরাশি দিয়ে। আর এ মহাসমুদ্রই বাংলাদেশকে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ খ্যাতি। তাই বাংলাদেশকে বলা হয় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থল। এ জন্যই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক বিরাট অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে। তাছাড়া চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে আরও জোরালো ও শক্তিশালী করেছে। এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই রাজনীতিবিদদের পথ চলতে হবে এবং তৈরি করতে হবে কর্মকৌশল।
আগামী দিনগুলোয় যে কয়েকটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপরের তালিকায় উঠে আসবে এর মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত। স্ট্র্যাটেজিক দিক দিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের জন্য চমৎকার রাজনৈতিক সুযোগ। এজন্য বাংলাদেশকে দেখতে  হবে  ভিন্ন আঙ্গিকে ও ভিন্ন দৃষ্টিতে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, সিকিম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশসহ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবেশদ্বার  বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল। তাছাড়া ‘সেভেন সিস্টার’ বলে খ্যাত ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের প্রবেশদ্বারও বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল। ফলে প্রায় শত কোটি মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকা- নিয়ন্ত্রিত হবে বাংলাদেশের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে।
বাংলাদেশ ছোট কোনো জনপদ নয়; জনসংখ্যার নিরিখে বিশ্বের অষ্টম রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজন বাংলাদেশী। পরিবর্তিত বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুসংহত হয়েছে। চীন, ভারত ও পাকিস্তানসহ আরও বড় বড় দেশ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীক প্রতিপক্ষ! তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বে চীনের পরই বাংলাদেশের অবস্থান! জনশক্তি রফতানি ও ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে! কাজেই বাংলাদেশের শত্রু এখন চর্তুমুখী। ওপরে উঠতে হলে বাংলাদেশকে এসব চিন্তা মাথায় রাখতে হবে, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে; সুনিশ্চিত করতে হতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং গণমাধ্যমরে স্বাধীনতা। তাহলেই কেবল একটি দেশের অর্থনীতির আকার বড় হতে পারে, দেশটি হতে পারে উন্নত, আধুনিক একটি দেশ।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরা কি শুধুই ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করব। আমরা কি এক পক্ষ আরেক পক্ষকে হেনস্থা ও ধ্বংস করার রাজনীতি করব। রাজনীতি তো দেশের জন্য, মানুষের জন্য। সেই দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে, মানুষের ওপর জোরজবরদস্তির শাসন চালিয়ে কোনো লাভ হবে না; মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। খালেদা জিয়া আরো বলেন, এই দূষিত রাজনীতির চত্রু থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। কোনো মত, পথ ও রাজনৈতিক দলকে কখনও নিশ্চিহ করা যায় না। এ ধরনের অপচেষ্টার ফল কখনও কারো জন্য ভালো হয় না। সবাইকে তিনি সংযমী ও শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট যুক্তি ও কারণ আছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কর্মক্ষ। গত ২০ বছরে প্রায় ৫ কোটি উদ্যমী, তরুণ ও যুবক যোগ হয়েছে বাংলাদেশের জনশক্তিতে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, জনশক্তি ও বেসকারি খাত একযোগে এগিয়ে যাচ্ছে, যা একটা রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিশ্বে একটি স্বনামধন্য ব্র্যান্ডের খ্যাতি অর্জন করেছে। পাশাপাশি এ শিল্পটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পের গৌরবের অধিকারী। তাছাড়া চা, চামড়া, ওষুধ ও হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতেও বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অবস্থান রয়েছে। এসব কোনো কল্পকাহিনী নয়, বাস্তব সত্য; তাহলে এ দেশের উন্নয়নকে আটকে রাখার সাধ্য কার? যদি নিজেরা মারামারিতে লিপ্ত না হইÑনিজেদের মধ্যে যদি শৃঙ্খলা না থাকে, কোনো সিস্টেম না থাকে; না থাকে দায়িত্বশীলতা। কাজেই বাস্তববাদী হতে হবে, দূরের জিনিস দেখতে হবে; জনশক্তিকে পরিকল্পিতভাবে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে, নদীগুলোকে খনন করে মাছ চাষ ও সম্পদের উৎসে পরিণত করতে হবে, কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে, কারিগরী শিক্ষার ওপর অধিক জোর দিতে হবে, গড়ে তুলতে হবে দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তিশালী গণপরিবহন ব্যবস্থা, রেলকে করতে হবে যুগোপযোগী ও আধুনিক, রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পিত শহর হিসাবে। সর্বোপরি সংঘাতপূর্ণ, অশান্ত ও হানাহানির রাজনীতি থেকে আসতে হবে বেরিয়ে। রাজনীতিবিদদের   মন বড় করতে হবে এবং দৃষ্টি করতে হবে প্রসারিত। অনৈক্য ও বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি পরিত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে এক প্লাটফর্মে থেকে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এক সুরে কথা বলতে হবে। অহমিকা ত্যাগ করে পরমতসহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে হবে এবং সবদলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের পথ সুগম করতে হবে। তাহলেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
য় লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
belayet_1@yahoo.com

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন