হোসেন মাহমুদ
গত ১৯ মার্চ শনিবার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সব কিছু ভাগ হয়ে যাওয়া এবং সকল বিষয়ে দ্বিধাবিভক্তির শিকার এ দেশে কোনো বিষয়েই অধিকাংশ মানুষের মতামত পাওয়া সম্ভব নয়। বিএনপির কাউন্সিল সম্পর্কেও তা আশা করা যায় না। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনারা বিএনপির কাউন্সিল সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করবেন, এটা আশা করা সমীচীন নয়। তারা এর মধ্যে তামাশার নাটক দেখেছেন। সে যাই হোক, এটা স্বাভাবিক যে বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দল এবং দু’একটি মিত্র ভাবাপন্ন ছোট দলের সমর্থকÑবিশেষ করে খোদ বিএনপি দলীয় লোকদের মধ্যেই এ কাউন্সিল নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল বেশি। সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সাম্প্রতিককালে যে কঠিন সময় অতিক্রম করছেন সে প্রেক্ষাপটে বিএনপির এ ষষ্ঠ কাউন্সিল ছিল অপরিসীম গুরুত্ববাহী। প্রকৃতপক্ষে কাউন্সিল পরবর্তী সময়ে এখন অনেকটাই চূড়ান্ত হয়ে যাবে যে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারবে, না মুসলিম লীগের মতো কাগুজে দল হয়ে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে।
সংবাদপত্রের খবরে দেখা গেছে, বিএনপি বেশ আগে থেকেই এ কাউন্সিল আয়োজনের জায়গা চেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিল। ‘তবে চাহিবা মাত্রই পাইবে’ এ প্রচলিত নীতির বাস্তবায়ন এক্ষেত্রে ঘটেনি। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের হুমকি বিজড়িত বাংলাদেশে তিনবারের শাসক দল বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠানের অনুমতি সহজে মেলেনি। তবে ধৈর্য্যরে পরীক্ষায় শেষপর্যন্ত বিএনপি উৎরাতে সক্ষম হয়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের অনুমতি মেলে কাউন্সিল অনুষ্ঠানের দিন দশেক আগে। সদাশয় কর্তৃপক্ষ একেবারে শেষদিকে এসে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানেও কাউন্সিল আয়োজনের অনুমতি দিয়ে দলটিকে বাধিত করেন।
দেশের জনসমাজে মতপার্থক্যের কথা আগেই উল্লেখিত হয়েছে। যদি বলা হয়, বাংলাদেশে বিএনপিই একমাত্র দল যে দলটিকে নিশ্চিহ্ন করতে ক্ষমতাসীনরা সুপরিকল্পিতভাবে চেষ্টা করে চলেছে, এ কথাটি বাতাসে ছড়াতে যা দেরী, বিরুদ্ধপক্ষ তাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে সগর্জনে ধেয়ে আসবেন। লক্ষ করলে দেখা যায় যে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে দিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিএনপি দমন নীলনকশার বাস্তবায়ন শুরু হয়। যার পরিণতিতে পরিলক্ষিত হয় যে, ২০০৭-৮ মেয়াদে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যেসব মামলা দায়ের করেছিল, ২০০৯ সালেই তার মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলাগুলো চটজলদি প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে কোনো মামলাই প্রত্যাহার করা হয়নি। তিনি আজো সেগুলোর ঘানি টেনে চলেছেন। তারপর থেকে বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নেতারাও ক্রমাগত মামলার শিকার হয়ে চলেছেন। ২০১৪-র ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন এবং ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সে নির্বাচনের প্রথম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ঘোষিত বিএনপির সমাবেশ বানচাল করতে সরকারের নজিরবিহীন পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর সৃষ্ট সহিংস পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিএনপি নেতা-কর্মীদের উপর সর্বকালের সর্বোচ্চ দমন নীতি চালানো হয় যা এখনো শেষ হয়নি বলে জানা যায়।
বিএনপিতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে নেতা-কর্র্মীদের মধ্যে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা প্রশ্ন নেই তা সর্বজন বিদিত। তিনি বিএনপির অবিসংবাদিত নেতা। তাকে ছাড়া বিএনপির কথা ভাবা যায় না। তিনি বিএনপির প্রাণভোমরা। এ নিদির্¦ধ সত্য সম্পর্কে যারা অবহিত সেই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা চান তিনি যেন নেতৃত্বে না থাকেন। তাহলে সে অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে যা তারা চাইছেন। এখানে আসে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কথা। তাকে নিয়ে কিছু বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ যে তিনি তৈরি করেননি তা বলা যায় না। কিন্তু তার পরও সব কিছুর ঊর্ধ্বে যা সত্য তা হচ্ছে তারেক রহমান আগামী দিনের বিএনপির জন্য অপরিহার্য নাম। আর এও সত্য বলে শোনা যায় যে, বিএনপির মধ্যেই সিনিয়র নেতাদের একটি অংশ তার ঘোর বিরোধী। এই বিরোধীরা চান না তারেকের হাত সর্বময় ক্ষমতা নিয়ে বিএনপিকে নিয়ন্ত্রণ করুক। বিএনপির পুনরুজ্জীবনে, নবশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক সমস্যা হতে পারে। এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে নিয়ে বেগম জিয়া সময় থাকতে কম-বেশি ছাড় দিয়ে যদি কার্যকর সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে যেতে অপারগ হন তাহলে তার ফলাফল নেতিবাচক হতে বাধ্য। কারণ, তারেক রহমান নিজ ক্যারিশমায় দলে নিবিড় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, এমন কোনো আশাবাদ নাকি অনেকেই পোষণ করেন না। তাই অনিবার্য যে খালেদা জিয়ার অবর্তমানে অন্তর্বিরোধ বাড়বে বই কমবে না, বিশেষত ঢোলে বাড়ি দেয়ার লোকের যখন অভাব বিএনপিতে নেই।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ^াসীজনেরা এক সময় দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন বলে মনে করা হতো। সময় ও অবস্থার পরিবর্তনে পরিস্থিতির অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে। তাই এর অনুসারীদের সংখ্যা এখন বেশ হ্রাস পেয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। তারপরও জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশ এখনো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অনুসারী বলে অনুমান করা যায়। তাদের কাছে বিএনপির কোনো বিকল্প নেই। কোনো অবস্থায়ই তারা অন্য ঘরানার দাওয়ায় আসনপিঁড়ি হতে উৎসাহী নন। মূলত এরাই হচ্ছেন বিএনপির প্রধান শক্তি।
কোনো কোনো বিষয়ে বিএনপির সাম্প্রতিক অবস্থান, বিশেষ করে ভারতীয় বিএসএফের সীমান্তে অব্যাহত বাংলাদেশি হত্যা, ভারতের কাছ থেকে প্রতিদান ছাড়াই সব কিছু উজাড় করে দেয়া, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলটির নীরব ভূমিকা এবং নয়াদিল্লির ক্ষমতাসীনদের আনুকূল্য লাভের দৃষ্টিকটু প্রচেষ্টা বহু জাতীয়তাবাদীকেই আশাহত করেছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সমর্থকদের এ হতাশার মনোভাব সম্পর্কে কতটা অবহিত কিংবা কতটা সচেতন, তার কোনো আভাস মেলেনি।
এখন কথা হচ্ছে, বহু প্রতীক্ষিত এ কাউন্সিল বিএনপির দলীয় লোকজন ও সমর্থক এবং সাধারণ মানুষের জন্য কী আশার বাণী বয়ে আনল? পত্র-পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, কাউন্সিল থেকে দেখা যাচ্ছে যে বিএনপি নতুন ধারার রাজনীতি ও সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিএনপি চেয়ারপারসন সম্মেলনে তাঁর বক্তৃতায় বেশ কিছু ঘোষণা দেন। তার মধ্যে রয়েছে নানা বিষয়। যেমন তিনি বলেছেন, তাঁর দল ক্ষমতায় গেলে দু’কক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ করার পদক্ষেপ নেবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনবে। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। এ অবস্থার অবসানকল্পে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতার ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা হবে।’ বোঝা যায় যে সাম্প্রতিক তিক্ত দৃষ্টান্তই তাঁকে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে চালিত করেছে। তবে বলা আর করা তো এক নয়। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এসব করার পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তারা যে ক্ষমতায় যাবে তার যেমন কোনো নিশ্চয়তা নেই, তেমনি কীভাবে যাবে তাও কেউ বলতে পারে না। এ সরকার নির্বাচন বহির্ভূত পন্থায় যেমন কারো ক্ষমতায় যাওয়া অসম্ভব করে তুলেছে, তেমনি অনুমোদিত গণতান্ত্রিক পন্থায়ও অন্য কারো জন্য ক্ষমতার বুড়ি ছোঁয়ার পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। কোনোটিই আজ আর সহজ নয়।
তবে বিএনপি চেয়ারপারসন ভিশন-২০৩০ নামে যে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন সে ব্যাপারে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়েছে। উল্লেখ্য, এর রূপরেখা ঘোষণা করা হলেও বিশদ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়নি। এর মাধ্যমে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও মানুষের মাথাপিছু আয় ৫ হাজার মার্কিন ডলার হবে বলে আশা করা হয়েছে। যাহোক, অনেকেই একে স্বাগত জানিয়েছেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের ভিশন-২০৩০ ঘোষণাটি ভালোই। এ ‘ভিশন’ বাস্তবায়ন করা গেলে তা রাজনৈতিক গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যে দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে ‘ভিশন-২০৩০’ ঘোষণা ইতিবাচক। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে ‘ভিশন-২০৩০’ জাতির সামনে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশকে ঈপ্সিত উন্নয়নের লক্ষ্যে নিয়ে যেতে বিএনপির এ ভিশন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, কিছুটা আওয়ামী লীগের ভিশন-২০২১-এর আদলে খালেদা জিয়াও ভিশন-২০৩০-এর কথা বললেও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে ধরে নেয়া যায়।
অন্যদিকে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে বিএনপি অনড় এবং সরকার তা না মানার দাবিতে অবিচল, যার পরিণতিতে অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একপেশে নির্বাচন ও যার কারণে পরবর্তীতে ঘটে নির্মম সহিংসতা ও প্রাণহানি, সে নির্বাচন বিষয়ে দু’ বছর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি কী দাঁড়িয়েছে তা জানার আগ্রহ ছিল অনেকেরই। কাউন্সিলে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘দেশের প্রায় সবাই একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল, গণতান্ত্রিক সরকার চায়। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। কীভাবে এটি হতে পারে সে ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে পৌঁছাতে চাই। তাহলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকবে না। আন্দোলনেরও কোনো প্রয়োজন হবে না। কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য একটি নির্বাচন বা সংলাপ চাইছি না। জবাবদিহিতা মূলক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং একটি স্থিতিশীল ও সমঝোতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করাই এর লক্ষ্য।’
এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির অপরিবর্তিত অবস্থানই পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে। যে দাবিতে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল সে দাবি থেকে তারা সরেনি। আর যেভাবে নির্বাচিত হয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন, তা যে প্রশ্নবিদ্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এ নিয়ে আন্দোলনে ব্যর্থতা দলটিকে অনেকখানি পিছিয়ে দিয়েছে, অনেক কঠিন মূল্যও দিতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তারপরও বেগম জিয়ার কথায় সমঝোতা ও শান্তির আবহটি সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এমনিতেও তিনি উগ্রভাষিণী নন। তাঁর বক্তব্যে সবসময়ই শালীনতা পরিলক্ষিত হয়। সরকার দলের নেতা-নেত্রীদের কারো কারো বক্তব্যে রুচিবোধ ও সৌজন্যের যে প্রচ- ঘাটতি দেখা যায় তাদের তুলনায় তিনি যথেষ্টই সংযতবাক। এবার তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন তা কোনো পর্যায়েই অগ্রহণযোগ্য হওয়ার মতো নয়। কিন্তু সরকার পূর্ণ শক্তি রাখে তাঁর বক্তব্যের প্রতি গুরুত্ব না দেয়ার। কারণ আন্দোলন করে দাবি আদায়ের ব্যাপারে বিএনপির ব্যর্থতার ইতিহাস সরকারের চোখের সামনে রয়েছে। কে না জানে, বিএনপি তাদের ভাষায় সে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে একটি নতুন নির্বাচন আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কৌশল প্রণয়ন করতে পারেনি।
বিএনপির কাউন্সিল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার খবর প্রকাশ করেছে একটি দৈনিক। এতে দেখা যায়, জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছেন, ‘ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা আছে। মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, সেটি স্থানীয় নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সব স্তরেই। খালেদা জিয়া মানুষের সেসব দাবি পূরণের অঙ্গীকার করেছেন। এই বক্তব্যকে মানুষ স্বাগত জানাবে। কারণ, এগুলো মানুষের মনের কথা।
উল্টো কথা বলেছেন যোগাযোগমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিএনপির ইতিহাস ইতিবাচক রাজনীতির পরিচয় বহন করে না। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা ও প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে খালেদা জিয়া যে অঙ্গীকার করেছেন সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দলটি সংলাপ ও নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে ভুলের চোরাবালিতে আটকে গেছে, সেখান থেকে আগে বের হোক। তারপর অন্য স্বপ্ন দেখুক। তিনি বলেন, দলটির রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের আভাস দেখি না।
সরকারের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন খালেদা জিয়ার বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, তিনি সবক্ষেত্রে কেবল দলীয়করণই করেননি, মাগুরা ও মিরপুরের উপ নির্বাচন করে নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই ধ্বংস করে দেন। আর ২০০১ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তিনি সুনীতি ও সুশাসন বিদায় করে হাওয়া ভবনে দুর্নীতির ঠিকানা গড়ে তোলেন। খালেদা জিয়া জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ বিষয়ে কিছু না বলায় তিনি তার সমালোচনা করেন।
ওবায়দুল কাদের ও রাশেদ খান মেননের বক্তব্যে খালেদা জিয়া বিরোধী অভিন্ন অবস্থানের ঐক্যটি সহজেই চোখে পড়ে। বহুল প্রচলিত ধারণা যে, আওয়ামী লীগ ও শরিক দলের নেতারা বেগম জিয়ার কোনো কাজ বা বক্তব্য সম্পর্কে দলীয় অবস্থানের বাইরে ইতিবাচক কিছু ভাবতে পারেন না। তারা মনে করেন যে, ক্ষমতার আশ্রয়ে থেকে তারা যে রাজনীতি করেন সেটাই সঠিক, তাদের চিন্তাভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি অভ্রান্ত। রাজনীতিতে বিএনপি নেতারা তাদের কাছে শিশুপ্রতীম। তাই বিএনপির কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয় সে বিষয়ে তারা প্রায়ই জ্ঞানদান করেন। তবে তারা সচেতন যে, পুলিশি প্রতিরক্ষা বলয়ের বাইরে একটি পৃথিবী আছে যে পৃথিবীতে মানুষের মাথার উপরে খোলা আকাশ ও পায়ের নিচে মাটি। সেই মুক্ত পৃথিবীর মানুষের রায় অন্যরকম হতে পারে। তাই তার সুযোগ তারা দিতে চান না। পাশাপাশি ক্ষমতার দর্প থেকে যতদিন পারা যায়, বিএনপিকে জ্ঞান দিতে চান তারা। যাহোক, তাদের তুলনায় জি এম কাদের বেগম খালেদা জিয়া প্রাসঙ্গিক তার বক্তব্যে নিজের অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিচ্ছন্ন মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন, যা কিনা আগামী দিনের রাজনীতির জন্য অপরিহার্য।
রাজনীতি পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে যে সবকিছুর পরেও তিনি নির্বাচন, রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তিনি আন্দোলনের পরিবর্তে সংলাপ- সমঝোতার কথা বলেছেন।’
জানা যায়, এ কাউন্সিল ইতিহাসের সর্বাধিক সংখ্যক মামলা এবং হামলা, গ্রেফতার, রিমান্ডে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত বিএনপি অনুসারীদের চাঙ্গা করেছে বলে ঢাকার বাইরের অধিকাংশ বিএনপি নেতার বিশ^াস। তারা মনে করেন, এ মুহূূর্তে এর জরুরি প্রয়োজন ছিল। কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যদিও তাদের মধ্যে হতাশা রয়ে গেছে তারপরও এ কাউন্সিল দলকে উজ্জীবনী শক্তি যোগাবে।
তাদের এ মনোভাব ইতিবাচক। আর তা বিএনপির আগামীর রাজনীতিতে কতটা গতি সঞ্চার করে তাই এখন দেখার বিষয়।
য় লেখক : সাংবাদিক
h_mahmudbd@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন