বাংলাদেশি শ্রমশক্তি রফতানীর বৃহত্তম বাজার হিসেবে সউদী আরবের শ্রমবাজার আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যে জিসিসি ভুক্ত অন্যদেশগুলোও সউদী নীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আকামা ও ভিসা জটিলতাসহ যে নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল তা না থাকলে বৈদেশিক রেমিটেন্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি আরো অনেক উপরে থাকতো। দীর্ঘ প্রচেষ্টা ও প্রতীক্ষার পর বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য সউদী শ্রম বাজারের দুয়ার পুনরায় উন্মুক্ত হলেও তা যথাযথভাবে কাজে লাগানোর পর্যাপ্ত ও উদ্যোগ বা গাইডলাইন দেখা যাচ্ছেনা। বিশেষত: জিটুজি ব্যবস্থাপনায় স্বল্প ব্যয়ে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগে যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল তার বাস্তব প্রতিফলন একেবারেই অনুপস্থিত। সউদী আরব ও মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারেও একই অবস্থা বিরাজমান রয়েছে। যে সব বিষয়কে কেন্দ্র করে ইতিপূর্বে সউদী শ্রমবাজারে আমাদের শ্রমিকদের জন্য অচলাবস্থা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছিল শর্ত সাপেক্ষে তা উত্তরণে দুই দেশের সরকার একটি সমঝোতায় পৌছাতে সক্ষম হলেও শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণের মধ্য দিয়ে বৃহত্তম শ্রমবাজারকে আবারো ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষত: স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভ’য়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর শ্রমিকদের নানা ধরনের সংক্রামক ও ভাইরাল রোগ ধরার পড়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। এর ফলে বাংলাদেশে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, একইভাবে শ্রমিক প্রেরণে সংশ্লিষ্ট দফতরে তদারকি ব্যবস্থা নিয়েও সউদী আরবসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরী হচ্ছে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে এক ধরনের বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হওয়ায় এমনিতেই আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান খুব সীমিত হয়ে পড়েছে। বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চাপ বেড়ে চলেছে। এহেন বাস্তবতায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রেমিটেন্স প্রবাহ অব্যাহত রাখাই এই মুহুর্তে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। প্রায় এক দশকের ঘোষিত-অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা শেষে বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজার যখন আবারো সম্ভাবনাময় ও সরগরম হয়ে উঠেছে তখন একশ্রেনীর অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সির দু’নম্বরী কর্মকান্ডের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে নতুন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদেশগামি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। বিশেষত: মধ্যপ্রাচ্যের জন্য (গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল অ্যাপ্রæভড মেডিকেল সেন্টার্স অ্যাসোসিয়েশন) গামকা নামে পরিচিত মেডিকেল সেন্টারগুলো থেকে সার্টিফিকেট নিতে হয়। গামকা মেডিকেল সেন্টারগুলো থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট লাভের ক্ষেত্রে নানা ধরনের হয়রানি, সিন্ডিকেটেড ঘুষবাণিজ্য ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। সম্ভবত: এসব কারণেই একশ্রেণীর রিক্রুটিং এজেন্সি গামকার বদলে অননুমোদিত মেডিকেল সেন্টার বা ভ’য়া ফিটনেস সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে শ্রমিকদের বিদেশে পাঠাচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ক’টনৈতিক উদ্যোগে সউদী শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত হওয়ার পর গত বছর সর্বোচ্চ সংখ্যক, সাড়ে ৫ লক্ষাধিক শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে সউদী আরব গেছেন। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, এসব শ্রমিকের বিশাল অংশই গামকার মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই সউদী আরব গেছেন। যথাযথ পরীক্ষা ও অনুমোদিত ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়াই লাখ লাখ শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার পর এদের মধ্যে হাজার হাজার শ্রমিকের নানাবিধ স্বাস্থ্য জটিলতা ধরা পড়ছে।
অতীতে যে সব বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশি শ্রমিকরা সউদী আরবসহ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে অনাকাঙ্খিত নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়েছিল সে সব বিষয় পুরোপুরি একপাক্ষিক ছিলনা। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগ ও নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের শ্রমিকদেরকেই। এখন যে গামকার সার্টিফিকেটহীন ব্যক্তিদের ভিসা ইস্যু করা হচ্ছে তাতে যেমন একশ্রেণীর রিক্রুটিং এজেন্সির হাত রয়েছে, তেমনি সউদী দূতাবাস ও বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের একশ্রেনীর কর্মকর্তার গাফিলতি ও যোগসাজশেরও অভিযোগ রয়েছে। সন্দেহ নেই, ঘুষ-দুর্নীতি বাংলাদেশে অন্যতম সামাজিক-প্রশাসনিক সমস্যা। কিন্তু সউদী আরবেও যে অর্থনৈতিক খাতে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে তা সাম্প্রতিক সময়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সউদি আরবে, আরব আমিরাতে বা মালয়েশিয়ায় যাই ঘটুক, আমাদের শ্রমবাজার তথা বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ ও সম্ভাবনা অক্ষুন্ন রাখতে বৈদেশিক শ্রমবাজার সংক্রান্ত প্রতিটি ধাপ ও খাতকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও গতিশীল রাখতে হবে। অননুমোদিত মেডিকেল সেন্টারের ভুয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট নিয়ে বিদেশগামি শ্রমিকদের দূরারোগ্য, সংক্রামক ব্যাধি ধরা পড়লে সউদী বা জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে আবারো নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা বিদেশে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা ও অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। কোন একটি দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সম্পর্কে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হলে তার প্রভাব অন্যান্য দেশেও পড়বে। এতে অর্থনীতির প্রধান খাত জনশক্তি রফতানী ভয়াবহ সংকটে পড়তে পারে। কোন দুর্নীতিবাজ রিক্রুটিং এজেন্ট বা দূতাবাসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে নতুন কোন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হওয়ার আগেই এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। গামকার অবকাঠামো ও জনশক্তি কাজে লাগানোর উদ্যোগের পাশাপাশি সব ধরনের দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দূর করার বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, জনশক্তি অধিদফতর, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন