ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ নামের একটি আইনের খসড়া গত সোমবার মন্ত্রীসভায় অনুমোদন লাভ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভা বৈঠকে এই অনুমোদন দেয়া হয়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারা নিয়ে বহু আলোচনা সমালোচনা, গণমাধ্যম কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। আদালত এই আইনকে সংবিধানের সাথে সাংর্ঘষিক বলে মত দিয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটেই সরকার আইন রহিত বা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল। সাতান্ন ধারা বাতিলের খবরে গণমাধ্যমকর্মী ও নাগরিক সমাজে এক ধরণের স্বস্তি দেখা গেলেও এখন শোনা যাচ্ছে, সাতান্ন ধারার বদলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে যে নতুন আইন আসছে তা’ সাতান্ন ধারার চেয়েও ভয়ঙ্কর। মূলত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সাতান্ন ধারায় বর্ণিত অপরাধ ও শাস্তির বিধান পূর্নবিন্যাস করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ তে যে সব ধারা সংযোজিত হয়েছে বিশ্লেষকরা তাকে নতুন বোতলে পুরনো মাদকের সাথে তুলনা করেছেন। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা তুলে দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় যে সব অপরাধ ও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে তার সাথে পুরনো আইনের তেমন কোন পার্থক্য নেই। বিশেষত: ৩২ ধারায় সংযোজিত আইনটি গণমাধ্যম কর্মীদের মধ্যে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য এই আইন ভয়ঙ্কর রূপে গণ্য হতে পারে। এই ধারায় বর্ণিত অপরাধ ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হিসেবে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ কোন সরকারী, আধা সরকারী বা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কোন কিছু রেকর্ড করলে তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে। এ ধরনের জন্য ১৪ বছরের জেল ও ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
তথ্য ও যেগিাযোগ প্রযুক্তি আইনটি প্রথম ২০০৬ সালে সন্নিবেশিত হয়। সংসদে পাস ও সন্নিবেশিত হওয়ার সময় আইনটি এমন বিতর্কিত বা বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য এতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেনি। আইনটি পাস হওয়ার পর প্রথম দফায় ২০০৯সালে, দ্বিতীয় দফায় ২০১৩ সালে সংশোধন, সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর কারাদন্ড এবং ৫৭ ধারার অপরাধকে জামিন অযোগ্য করার মাধ্যমে একে একটি নির্বতনমূলক আইনে পরিনত করা হয়। সাতান্ন ধারায় বলা হয়েছে, ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোন তথ্য যদি নৈতিক স্খলন বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ করে, এতে যদি কারো মানহানী ঘটে, রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, তা এ ধারায় বর্ণিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যার শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদন্ড এবং অনধিক ১ কোটি টাকা জরিমানা। তবে আইনের ৮৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরল বিশ্বাসে করা’ কাজের কারণে কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা আশঙ্কা দেখা দিলে সে জন্য সরকারী কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা বা আইনী ব্যবস্থা নেয়া যাবেনা। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য কঠোর ও জামিন অযোগ্য শাস্তির বিধান রাখা হলেও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বিশেষ বিবেচনার সুযোগ রাখা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সাতান্ন ধারার অপব্যবহারে আশঙ্কা সামনে রেখে গণমাধ্যম কর্মী ও নাগরিক সমাজের কঠোর প্রতিবাদ সমালোচনার মুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারী কর্তৃপক্ষের তরফে আইনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের আশ্বাস ও নির্দেশনা দেয়া হলেও অল্পদিনের মধ্যেই এই আইনে হয়রানির শিকার হন অসংখ্য মানুষ। গত বছরের প্রথম ৬ মাসে আইসিটি আইনে ৩৯১টি মামলা হয়, বেশীরভাগ মামলায় সবচেয়ে হয়রাণিমূলক ও জামিন অযোগ্য ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। সাংবাদিক, গণমাধ্যম কর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী ও পেশার মানুষ এই আইনে দায়ের করা মামলায় হয়রানির শিকার হন। শুরুতেই এটি একটি কালো আইন হিসেবে গণ্য হওয়ায় দেশের সাংবাদিক সমাজ, সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের মালিক, দেশের প্রায় সব সাংবাদিক ইউনিয়নসহ দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাা এই ধারার বিরোধিতা করেছিল। একটি কালো আইনের বিরুদ্ধে সবপক্ষের এমন ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া সরকারের পক্ষ থেকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিলনা। তবে সাতান্ন ধারা বাতিল করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় যে বিধান সংযুক্ত হয়েছে তা নি:সন্দেহে একটি কালো আইন। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এ ধরনের আইনের বিধান সমর্থনযোগ্য নয়। যেখানে দেশের সরকারী, আধা সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশীরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী আপাদমস্তক অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ কেউ ইতিমধ্যে সমাজে চিহ্নিত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বিষয়াদিতে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা দোহাই দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর ডিজিটাল আইনের খড়গ চাপিয়ে দেয়ার নতুন বিধান কাম্য নয়। মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের মতে, ‘আগে যেমন অপব্যবহার হওয়ার সুযোগ ছিল, তা রয়েই গেছে। রাষ্ট্র বাক স্বাধীনতার পক্ষে কোনো পরিষ্কার অবস্থান নেয়নি।’ কোনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর এমন নগ্ন হ্স্তক্ষেপ মেনে নেয়া যায়না। তথ্য প্রযুুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা বাতিলে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিবে এই প্রত্যাশা আমাদের।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন