শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮, ১২:০০ এএম

দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় চরম মন্দা বিরাজ করছে। একদিকে তারল্য সংকট অন্যদিকে হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাফি ঋণের ভারে ভঙ্গুর অবস্থায় পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এহেন বাস্তবতায় সরকারী মালিকানাধীণ ব্যাংকগুলোকে সচল রাখতে আবারো রাষ্ট্রীয় কোষাগার মূলধনের যোগান দিতে যাচ্ছে সরকার। প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে এই মুহুর্তে মূলধনের ঘাটতি ১৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দুটি বিশেষায়িত ব্যাংকেই মূলধন ঘাটতির পরিমান দাড়িয়েছে ৮হাজার ২৮২ কোটি টাকা। ব্যাংক পরিচালনায় বিদ্যমান অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, রাজনৈতিক দলবাজি, পরিচালকদের স্বেচ্ছাচারিতা ও লুটপাটের ঘটনাগুলোকে আমলে নিয়ে বেহাত হওয়া মূলধন পুনরুদ্ধারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের বদলে জনগনের ট্যাক্সের টাকায় লুণ্ঠিত মূলধনের ঘাটতি মেটানোর সিদ্ধান্ত কতটা সঙ্গত এ প্রশ্ন উঠেছে। অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছেননা। রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোতে মূলধন সংকটের পাশাপাশি ব্যাংক বর্হিভ’ত আথিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন তহবিল সংকটে পড়েছে বলে গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়। কিছুদিন আগেও যেখানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অলস টাকার সংকটে পড়ে ঋণ ও আমানতের সুদের হার কমিয়ে দিয়েছিল, এখন সুতের হার বাড়িয়েও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলধনের ঘাটতি মেটাতে পারছেনা। এ সংকট কাটাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজিং ডিরেক্টররা বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চাইছেন।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যে বড় ধরনের অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা ও তহবিল তছরূপের বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারিতার নিগড়ে বন্দি হয়ে পড়ছে তা কোন নতুন তথ্য নয়। দু বছর আগেও অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজের ক্ষোভ ও অসন্তোষের কথা বলেছেন। খোদ অর্থমন্ত্রী যদি সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেই বসে থাকেন এ সংকটের সমাধানের উদ্যোগ বা পদক্ষেপ কে নেবে? ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকের বড় বড় আর্থিক ক্যালেঙ্কারির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সরকারীদলের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ম.খা আলমগীরের হাত দিয়ে বিশেষায়িত ফার্মাস ব্যাংক এবং অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের হাতে জনতা ব্যাংকে দেশের বৃহত্তম একক ঋণকেলেঙ্কারির তথ্য জানা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ও নিয়ম-নীতি লঙ্ঘন করে কোন বিশেষ ব্যক্তি ও বেনামী প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে জনতা ব্যাংককে বিপদগ্রস্ত করে তোলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী নিজেও আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংক শেষ করে দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যেখানে অনুদানের দুই কোটি ১০ লাখ টাকার অনিয়মের অভিযোগে মামলা দিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে জেলে পাঠানো হচ্ছে, সেখানে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের সাথে জড়িতরা বছরের পর বছর ধরে কোন জবাবদিহিতার বাইরে থাকছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এই চিত্র দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য সুখকর নয়।
দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতা, লাগামহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে গত এক দশকে দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কিভাবে কত টাকা পাচার হয়েছে তার ফিরিস্তি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। দেশি-বিদেশি নানা সংস্থার বার্ষিক রিপোর্টগুলোতেও বাংলাদেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণসহ করণীয় সম্পর্কে জোরালো তাগিদ উচ্চারিত হয়েছে। আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কথা বিভিন্ন সময়ে বলা হলেও এ সব ক্ষেত্রে সরকারের তেমন কোন কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। শেয়ারবাজার, রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকিং খাতসহ বিভিন্নভাবে লুট হওয়া টাকার একটি বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে ধরে নেয়া যায়। পাচার হয়ে যাওয়ার কারণেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মূলধন সংকটে পড়েছে। আমানতের সুদের হার বাড়িয়েও তারল্য সংকট কাটাতে পারছেনা ব্যাংকগুলো। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার চলতি অর্থবছরে বিশেষ বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে জোর দিচ্ছে। বাজেট ঘাটতি পুরনে সরকারও সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকের কাছে ঋণ নিচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের বেসরকারী বিনিয়োগ বড় ধরনের সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকের মামলা পর্যবেক্ষনে ডিজিটাল সেল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও গত ৩ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রেখে দেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থানসহ অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। সেই সাথে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকেই আরো দুর্বল ও ভঙ্গুর করে তোলতে পারে। দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চা ও সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন