সরকার আদম আলী, নরসিংদী থেকে : তেঁতো স্বাদের সব্জী উচ্ছে। আঞ্চলিক ভাষায় কেউ বলে উইছতা, কেউ বলে উছতা, কেউ বলে উদিয়া, আবার কেউ বলে করলা। আসলে উচ্ছে ও করলা স্বাদে, গন্ধে ও গুণে একই ধরনের সব্জী হলেও, লম্বা জাতের উচ্ছেকে বলা হয় করলা। তেঁতো সব্জী হিসেবে উচ্ছে ছিল এক সময় ফেলনা সব্জী। গ্রামের গরীব ও বয়স্ক লোকেরা ছাড়া এই উচ্ছে কেউ খেতো না। এই তেঁতো স্বাদের উচ্ছে এখন ভিআইপিদের ভিআইভি (ভেরি ইম্পরটেন্ট ভেজিটেবল) সব্জীতে পরিণত হয়েছে। পরিণত হয়েছে বাজারের সেরা সব্জীতে। ১ কেজি উচ্ছে এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা দরে। শীতের প্রথমভাগ থেকে যেই চড়া দামে উচ্ছে বিক্রি হয়েছে, এখনো ঠিক সেই চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য শাক-সব্জীর দাম উঠানামা করলেও উচ্ছের দাম কিছুতেই কমছে না। মাঝখানে বেশ কয়েক দিন ৮০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছিল। এখন আবার ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এরপরও উচ্ছের চাহিদায় কোন কমতি নেই। দেশের ডায়বেটিকস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার পর উচ্ছের কদরও বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। মানুষ সচেতন হয়ে গেছে উচ্ছের গুণাগুণ সম্পর্কে। উচ্চ ঔষুধী গুণাগুণের কারণে উচ্ছে এখন প্রথম কাতারের সব্জীতে পরিণত হয়েছে। বাজার থেকে উচ্ছে কিনে না এমন ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। ধনিক শ্রেণী লোকেরা এক কেজি উচ্ছে চড়া দামে কিনে নিলেও দাম অস্বাভাবিক বেশী বলে স্¦ল্প আয়ের মানুষ কিনছে ১০০ গ্রাম বা ২৫০ গ্রাম উচ্ছে। আর মওকা বুঝে ফড়িয়ারা যখন তখনই উচ্ছের দাম বাড়িয়ে মনোপলি ব্যবসা করছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নরসিংদীর চরাঞ্চলের কমবেশী ২শ হেক্টর জমিতে দেশী জাতের উচ্ছে চাষাবাদ করা হয়। স্বাদে একটু বেশী তেঁতো হলেও ভালো ফ্লেভারের কারণে এই দেশী জাতের উচ্ছের চাহিদাই বেশী। ফলন বেশী হলে এক কেজি দেশী জাতের উচ্ছে বিক্রি হয় ৫ থেকে ১০ টাকা কেজি। আর ফলন কম হলে সাধারণত এক কেজি উচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। নরসিংদীতে উৎপাদিত এই দেশী জাতের উচ্ছের চাহিদা রয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে। যার কারণে বেশীরভাগ উচ্ছেই চলে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। নরসিংদীর উচ্ছের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে রাজধানী ঢাকা ও নরসিংদীর একটি সব্জী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। প্রতিবছর আড়তদাররা উচ্ছে চাষীদেরকে এক ধরনের দাদন দেয়। চাষীরা তাদের উৎপাদিত উচ্ছে নির্ধারিত আড়ত বা সব্জী ব্যবসায়ীদর দোকানে বিক্রি করে। সেখান থেকে বস্তা ভরে মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা নিয়ে যায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে। নরসিংদীর সাধারণ ব্যবসায়ীরা ফড়িযাদের কাছ থেকে উচ্ছে কিনতে পারে না। যার ফলে নরসিংদীর স্থানীয় বাজারগুলোতে উচ্ছে আমদানী হয় কম। আর এই সুযোগেই সব্জী ব্যবসায়ীরা চড়া দামে উচ্ছে বিক্রি করে। উচ্ছে তেঁতো হলেও একটি সুস্বাদু সব্জী। গ্রামের লোকেরা উচ্ছে সিদ্ধ করে আলুর সাথে হাত কচলানো ভর্তা বানিয়ে খায়। উচ্ছে ও আলু একত্রে তেলে ভাজা খাওয়া হয়। উচ্ছের সাথে চিংড়ি মাছের একটি রাসায়নিক সম্পর্ক রয়েছে। যার ফলে অনেকে উচ্ছের পলা (স্লাইস) কেটে চিংড়ি মাছ দিয়ে ভূনা করে খায়। দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী একবার শিবপুরে মান্নান ভূঁইয়া মেহমান হিসেবে বেড়াতে এসে শিবপুর ডাক বাংলোয় বসে এক প্লেট উচ্ছে ভূনার সাথে স্বল্প পরিমাণ ভাত মিশিয়ে খুব আয়েশ করে খেয়েছিলেন। তখন তিনি উপস্থিত সাংবাদিকসহ সকলকে বেশী বেশী উচ্ছে খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এমনিভাবে ডাক্তারদের উচ্ছে খাওয়ার পরামর্শের কারণে উচ্ছের চাহিদা বেড়ে যায়। অনেকে একটি উচ্ছে দ্বিখন্ডিত করে শিং মাছসহ বিভিন্ন জিয়ল মাছ দিয়ে ঝোল রান্না করে খায়। ধনীরা বড় মাছ দিয়েও ঝোল রান্না করে খেয়ে থাকে। ঔষুধী গুণের জন্য অনেকে উচ্ছে ছেঁচে কাঁচা রস গিলে খায়। এতে নাকি পেটের কৃমি নষ্ট হয়। অনেক ডায়বেটিকস রোগী প্রতিদিন সকাল বেলা উচ্ছের রস খায়। আজকাল শুনা যায় ডায়বেটিকস রোগীরা উচ্ছের বাহ্যিক ব্যবহার শুরু করেছে। তারা উচ্ছের এক কেজি রস করে দুই কেজি পানি মিশিয়ে প্রতিদিন পা ভিজিয়ে রাখে। এতে নাকি ডায়বেটিকস নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়া মেয়েরা মুখের ব্রন দূর করার জন্য উচ্ছে কেটে কাটা অংশ দিয়ে মুখে ঘষাঘষি করে। উচ্ছের পাতা বেটে মুখে মেহেদীর মতো লাগিয়ে রাখলে নাকি ব্রন, মেসতা ডার্ক সার্কেল, দূরীভূত হয়। বহুমুখী গুণাগুণের কারণে এক সময়ের ফেলনা সব্জী উচ্ছে এখন ভিআইপিদের ভিআইভি (ভেরি ইম্পরটেন্ট ভেজিটেবল) সব্জীতে পরিণত হয়েছে। উচ্ছের বহুবিধ ব্যবহারের কারণে চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ বেশী। আর এই চাহিদার সুযোগ নিয়েই মনোপলি ব্যবসা করছে মধ্যস্বত্বভোগী মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন