বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব যে অপরিসীম, এ নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠেনি কখনও। বলতে গেলে সাতচল্লিশের পাটিশন-সৃষ্ট পাকিস্তানের পূর্ববাঞ্চল যে আজ বাংলাদেশ নামের স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে, তার মূলেই রয়েছে ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। দেড় হাজার মাইলের অধিক ব্যবধানে অবস্থিত ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দুটি স্বতন্ত্র ভূখÐ নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে প্রায় নেই বললেই চলে। সে নিরিখে দেড় হাজার মাইলের অধিক দূরে অবস্থিত দুটি ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন ভূখÐকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র (পাকিস্তান) যে প্রায় আড়াই দশক টিকে ছিল এটাই ইতিহাসের এক আশ্চর্যজনক ঘটনা।
এই অত্যাশ্চর্য ঐতিহাসিক ঘটনা সম্ভবপর হয়েছিল তদানীনন্তন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ববঙ্গের জনগণের গভীর গণতান্ত্রিক চেতনা কারণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকালেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ ছিল পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পূর্বাপুরি কায়েম হলে তাদের সকল ন্যায্য অধিকার লাভের পথে যে আর কোন বাধা থাকতো না, সে বিষয়ে জনগণ ছিলেন নিশ্চিত। কিন্তুু পাকিস্তানের রাষ্ট্রব্যবস্থায় গোড়া থেকেই সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের অত্যধিক প্রভাব থাকায় আমাদের জনগণের এ স্বপ্ন কোন দিনই সফল হয়নি। সফল যে হয়নি তার প্রথম প্রমাণ ছিল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন।
১৯৪৭ সালে পৌনে দু’শ বছর বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী পরাধীনতার শৃংখলের হাত থেকে মুক্ত হয়ে উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামের দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, একথা সবাই জানেন। ভারতের রাষ্ট্রভাষা যে হিন্দী হবে এ বিষয়ে সে দেশের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব পূর্বাহ্নেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে সম্পর্কে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আনে এ প্রশ্নে তর্ক বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা চলাকালেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়ে যায়। সে সময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে বিশিষ্ট ভাষাতত্ত¡বিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার প্রতিবাদ করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার স্বপক্ষে বহু তথ্য ও তুলে ধরেন।
সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল পাকিস্তানের সমগ্র জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ বাস করতেন তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ পূর্ববঙ্গে এবং তাদের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। সে নিরিখে মেজরিটি জনসংখ্যার মাতৃভাষা হিসাবে বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবীও তোলা যেতো। কিন্তু তা না করে মেজরিটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে উর্দুর সাথে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়। এর একটি বিশেষ কারণও ছিল সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ বাংলা ভাষাভাষী হলেও নতুন রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষীদের অতিরিক্ত প্রভাব থাকায় তারা রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই উর্দুকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে একটা গোপন প্রয়াস চালাতে শুরু করেন। এটা বোঝা যায় নতুন রাষ্ট্রের পোস্ট কার্ড, এনভেলপ, মানি অর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহার দেখে।
এই পটভূমিতে পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন সংস্কৃতিকর্মীদের প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন শুরু হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্পদিন পরেই ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু” শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশের মাধ্যমে। এই পুস্তিকায় তিনজন লেখকের রচনা স্থান পায়। এই তিন লেখক ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেম, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন এবং খ্যাতনামা সাংবাদিক-সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমদ। এদের মধ্যে অধ্যাপক আবুল কাসেমের রচনায় নি¤েœাক্তভাবে ভাষা আন্দোলনের মূল দাবী সমূহ তুলে ধরা হয় : (এক) পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালতের ভাষা হবে বাংলা, (দুই) পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা (তিন) পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু।
শুধু ভাষা আন্দোলনের দাবী তুলে ধরেই অধ্যাপক আবুল কাসেম বসে থাকেননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভাষা আন্দোলনে তাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র শিক্ষদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন।
ভাষা আন্দোলনকে শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল হক ভুঁইয়াকে কনভেনর করে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ইতোমধ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী পাকিস্তান আন্দোলনের ছাত্রকর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নামের একটি ছাত্র সংস্থা। এই সংস্থা জন্মলগ্ন থেকেই তমদ্দুন মজলিস-সূচিত ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাদের একাত্মতা প্রকাশ করে। এ সময় তমদ্দন মজলিস ও ছাত্রলীগের যুগপৎ সদস্য শামসুল আলমকে কনভেনর করে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। প্রায় একই সময়ে পাকিস্তান গণপরিষদের কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বাংলা ভাষায় বক্তৃতাদানের দাবী জানালে সে দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের হরতাল পালনের আহŸান জানায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
১১ মার্চের সে হরতাল সম্পূর্ণ সাফল্য মÐিত হয়। সে হরতালে রেল কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সমর্থন থাকায় সেদিন চট্টগ্রাম থেকে কোন ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতেই সক্ষম হয়নি। ঢাকার পরিস্থিতি ছিল আরও উৎসাহব্যঞ্জক। সকাল থেকে সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পিকেটিং চলাতে সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকে সেদিন সেক্রেটারিয়েটে প্রবেশ করতেই সমর্থ হয়নি। তখন সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পাকা দেয়াল ছিল না। ছিল কাঁটা তারের বেড়া। কাঁটা তারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে অনেক পিকেটারই ভেতরে ঢুকে পড়ে উপস্থিত কর্মকর্তা কর্মচারীদের অফিসে উপস্থিতির জন্য নিন্দা জানান।
সেক্রেটারিয়েটের পাশে পিকেটিং করার অপরাধে অধ্যাপক আবুল কাসেমসহ অনেকে পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হন। পিকেটিং এ অংশগ্রহণের অপরাধে শেখ মজিবুর রহমান, অলি আহাদসহ প্রমুখ অনেকে গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলনের সমর্থকদের উপর পর পুলিশের লাঠিচার্জের ও তাদের গ্রেফতারের খবর শহরে ছড়িয়ে পড়লে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষোভকারীদের আগমনে গোটা সেক্রেটারিয়েট এলাকা অল্পক্ষণের মধ্যে বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্র সৃষ্টি হয়ে পড়ে। চারদিকে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এই অরাজক পরিস্থিতি চলতে থাকে ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মার্চ পর্যন্ত।
এতে ভীত হয়ে পড়েন তদানীন্তন প্রাদেশিক প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। কারণ ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মুহম্মদ আলীর জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার কথা। তিনি ঢাকায় এসে যদি এই অরাজক পরিস্থিতি দেখতে পান, খাজা নাজিমুদ্দিন সম্পর্কে তাঁর ধারণা ভাল থাকার কথা নয়। তাই নাজিমুদ্দিন স্বত:প্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের সকল দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে তাদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত মোতাবেক গ্রেপ্তার হওয়া ভাষা সৈনিকদের মুক্তি দেয়া হলে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত হয়ে আসে।
এরপর যথাসময়ে কায়েদে আজম ঢাকা সফর আসেন। ঢাকা অবস্থানকালে তিনি রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় এবং কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে ভাষণ দান করেন। উভয় স্থানে তিনি ইংরেজীতে বক্তৃতা করেন এবং উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। উভয় স্থানে তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ হয়।
রেস কোর্সের বিশাল জনসভায় কে কোন দিক থেকে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তা তিনি টের না পেলেও কার্জন হলের সীমাবদ্ধ উপস্থিতিতে যখন তার মুখের সামনে নো-নো প্রতিবাদ ওঠে, তিনি বিস্মিত হন এবং বক্তৃতা সংক্ষেপ করে কার্জন হল ত্যাগ করেন।
পরে তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। তবে উভয় পক্ষ স্ব স্ব অবস্থানে অটল থাকায় বৈঠক ব্যর্থ হয়। তবে একটা বিষয় লক্ষ্যনীয় ছিল। তিনি ঐ বছর ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আর কোন প্রকাশ্য বক্তব্য দেননি। বিশিষ্ট সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ‘সাংবাদিকের রোজনামতা শীর্ষক গ্রন্থ সূত্রে জানা যায় মৃত্যু শয্যায় তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্ণেল এলাহি বখশের কাছে প্রায়ই তিনি এই বলে দু:খ প্রকাশ করতেন যে অন্যের কথায় বিশ্বাস করে তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বক্তব্য দিয়ে মহা ভুল করেছেন। ব্যাপারটা গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ ছিল তাঁর। ছাত্রদের সাথে বৈঠকে কালে তিনি তাদের বক্তব্যে অনেক যুক্তিলক্ষ্য করেছেন।
যদিও জিন্নাহ সাহেবের জীবিতকালে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আর তর্ক ওঠেনি, তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আবার বিতর্ক ওঠে ১৯৫২ সালে। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসাবে পালিত হতো সরকারকে একথা স্মরণ করিয়ে দিতে যে, রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন এদেশের মানুষ ভুলে যায়নি। এর মধ্যে ১৯৪৯ সালে বাংলাভাষা উর্দু হরফে লেখার একটা ষড়যন্ত্র শুরু হলে তমদ্দুন মজলিসসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবাদের মুখে সরকার পিছু টান দিতে বাধ্য হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্না সাহেবের মৃত্যু হয়, একথা আগেই বলা হয়েছে। জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রথমে গভর্নর জেনারেল করা হয়। পরবর্তীকালে আততায়ীর গুলীতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর মুত্যুর খাজা নাজিমুদ্দিনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হবার পর ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকা সফরে এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বক্তৃতাকালে বলে বসেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এর ফলে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পরিস্থিতি পুনরায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সকল দাবীদাওয়া মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তাঁর বাংলা বিরোধী এ বক্তব্যকে জনগণ তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা বলে গণ্য করে তার সমুচিৎ জবাব দানের জন্য তৈরি হন। নতুন করে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এতে নেতৃত্ব দান করেন মওলানা ভাষানী, জনাব আবুল হাশিম প্রমুখ পবীণ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আওয়ামী লীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ। ২১ ফেব্রæয়ারী বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার করার দাবীতে প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এই একুশে ফেব্রæয়ারী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে সালাম, বরকত প্রমুখ ভাষা শহীদরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেন, তার ফলে সারা বিশ্বেই এখন পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রমাণ করে এদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী। কিন্তু শাসকদের মধ্যে গণতন্ত্র বিরোধী মনোভাব প্রকট হয়ে উঠলে তারা ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢালতে এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত থাকে।
বাংলাদেশের জনগণ যে গণতন্ত্রকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়, তার প্রমাণ হিসাবে আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের অপর তিনটি মূলনীতি সরকার ভেদে একাধিকবার পরিবর্তন করা হলেও একমাত্র গণতন্ত্রের গায়ে আঁচড় কাউতে সাহস করেনি কোন সরকার।
জনগণের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র এভাবে সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করলেও দু:খের বিষয় হলো বাংলাদেশে অদ্যাবধি বাস্তবক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মত এত অধিক অবহেলার শিকার হয়নি আর কোন মূলনীতি। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সর্বাধিক অবদান থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশে গণতন্ত্র আজও যে জোরদার হয়ে উঠতে পারেনি তার চাইতে দু:খের বিষয় আর কী হতে পারে। সব চাইতে দু:খের বিষয় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এ অবমূল্যায়নের ধারা শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের আমল থেকে, যখন গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়।
পরবর্তীকালে বেশ কিছু দু:খজনক ঘটনার মধ্যদিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় কায়েম করা হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে ঐ সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম দলটির নেত্রী শেখ হাসিনা। ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত দলটির অপরাধ ছিল দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দলের প্রধান নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছিল তারা। এতে প্রমাণিত হয় নিময়তান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের চাইতে তাঁর কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়েছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী জেনারেলের শাসন। দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক ঘটনা (বিএনপি চেয়ারপাসনের কারাদÐ) দেখে আমাদের আশংকা হয় দেশের প্রাচীনতম দলের সে মনোভাবের এখনও পরিবর্তন হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন