ঝর্ণার মৃদু চঞ্চল চরণ প্রান্তরে নূপুর বাজিয়ে অনুস্টুপ ছন্দে যে সময় কাটতো তা যেন আজ প্রকৃতির মত প্রশান্ত। হরিণীর সে চঞ্চলতা আজ নেই। ফুল ঝরে গেছে উন্মুক্ত সবুজ চত্বরে। দূর্বাদলের মৃদু শিহরণ আজ বিদায় নিয়েছে। গিরিলালিত জীবন স্পন্দের শিশির বিন্দু শুকিয়ে গেছে করালোগ্রাসী সূর্যোদায়ের নিষ্ঠুর সামাজিকতার কঠিন বিষবাষ্পে; হারিয়ে গেছে হেমন্তের ঝরা ফসলের মত আমার সোনালী দিন।
ঠিক যেন শৈল চূড়ায় বরফের আলো ঠিকরায়ে পড়েছে, কিন্তু বরফ এখনো গললো না, আমি জানিÑ সে ছিল অকলংক শুভ্র, সে কি নিবিড় পবিত্র। সাড়া দেয়া বিজয়ের পর বিসর্জনের সানাইয়ের সুরের মাঝে শুনতে পাই আজও সেই মধুর ডাক; লবী তুমি কোথায়?
এ কি হলো?! এমন তো কথা ছিল না! এতগুলো প্রাণ অকালে কেনই বা কেড়ে নিলো হায়েনার কালো থাবা। এই অপূরণীয় ক্ষতির মাসুল কি সম্ভব? কাকে করবো এ প্রশ্ন? কে ছিল এই লোমহর্ষ কাহিনীর নেপথ্যে? কি ছিল তার স্বার্থ? কিসের উপর চালিয়ে দিলো বুলডোজার? স্তব্ধ করে দিলো জীবনের গতি। ভাবছেন বলবো ‘প্রশ্ন করুণ বিবেককে’। জানি বিবেকের বিকৃত লাশ এখন নর্দামার ভিতর। সেদিন ছিল ২৫ ফেব্রæয়ারী। প্রতিদিনের মত সেদিও সূর্যো উঠেছিল, দিন শেষে অস্তও গিয়েছিল প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু আমার জীবনে সুখের সূর্যটা সেদিন কালের করাল গ্রাসে অস্তমিত হয় অনন্ত কালের জন্য। এখন একমাত্রই অবলম্বন হলো স্মৃতি, সেই মধুর স্মৃতির মাঝে নিজেকে সান্ত¦না দেই :
‘পৃথিবীটা সুন্দর ছিলো
তুমি ছিলে বলে
আজও আছে সুন্দর
সেই পৃথিবী
অনুভবে তুমি আছো বলে’
জীবনের নিয়মে হচ্ছে সকাল। কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙছে সবার। দখিনা জানালাও খুলছে সবাই। হিমেল স্নিগ্ধ বাতাসও বইছে ঘরে। কল্পনার রঙে রাঙাচ্ছে সবার জীবন। দীর্ঘ সুখময় ক্লান্তি শেষে ঘুমোচ্ছে সবাই। আর আমার অন্তদাহনে জ্বলছে বুক, বইছে খরাময়ী বিষবাস্পভরা দুষিত বাতাস, আর নয়ন গড়ানো জলে ভিজে যাচ্ছে বালিশ। সেই সাথে চিন্তা-ক্লান্তি শেষে লম্বা দির্ঘশ্বাস!!
কিন্তু কেন? কি ছিল আমাদের অপরাধ? সততার তো কোন ঘাটতি ছিল না। শপথ অনুযায়ী ছিল কর্ম তঃপরতা। অন্যয়ের সাথে ছিল না কোন আপস। তবে কি এইটাই ছিল অপরাধ?
মাঝে মাঝে মনে হয় কবর থেকে টেনে হেঁচড়ে বের করে চিৎকার করে বলি: আর একদিনের জন্য জেগে ধরো অস্ত্র, নির্দেশ দাও তোমার প্লাটুনকে, সবার মুখোশ দাও খুলে, করোনা তাদের কোনো ক্ষমা। এসব ভেবে ক্লান্ত হয়ে যাই। আর অস্থিরতায় এপাশ ওপাশ করি।
জানি, সারাজীবন কলম চালিয়ে আমার লেখা হবে না শেষ। জানাতেও পারবো না কাকে লিখবো। লিখে আর জানিয়েও কোন লাভ হবে না কারও। পূরণ হবে না সে ক্ষতি। এ বিষবাষ্পপূর্ণ সমাজ শুধু বø্যাকহোলের মত কেড়ে নিতেই জানে, জানে না কিছু দিতে। যারা করেছে আমার এ হাল, তাদের বলছি : আজ যদি জানতে ভালো লাগার মানুষকে এভাবে কেড়ে নিলে সে কি যন্ত্রণা হয়, তাহলে করতে না এমন তান্ডবলীলা। ডানাভাঙা পাখির মত এতগুলো পরিবারকে করতে না সর্বশান্ত, এ যে কি কষ্ট! প্রতিটি নিঃশ্বাসেই শুধু হতাশা, হাহাকার...
ইলাহী তোমাকেই লিখছি :
‘জানি না তো শুনছো কি ওপারে বসে
আমার এ বেদনার ডাক
তোমায় পেয়েও যদি সব হারাতাম
মিছে যত থাক পড়ে থাক’
লেখক : শহীদ কর্ণেল কুদরত এলাহী রহমান শফিকের স্ত্রী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন