হাইকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ তৌহিদি জনতার মনের ভাষা বুঝে রাষ্ট্রধর্মের বাতিলের পক্ষে ২৮ বছর আগের করা রিটটি অবশেষে খারিজ করে দিয়েছেন। ফলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৌহিদি জনতা এবং আলেমসমাজের ঈমানি জযবার কাছে ক্ষুদ্রসংখ্যক ইসলামবিদ্বেষী তাগুতি শক্তির অপপ্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে।
আজ যেখানে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরাই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মূল শিকার, আলেমসমাজ ও ধর্মপ্রাণ জনতা উগ্র বর্ণবাদের শিকার, সেখানে শুধুমাত্র সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিলোপসাধন করলেই যে সব ধর্মাবলম্বীর ধর্মীয় সমানাধিকার নিশ্চিত হবে-এর কোনো গ্যারান্টি নেই। ভাবনার বিষয় হলো, দেশে এত সমস্যা থাকতে হঠাৎ করে কেন রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ২৮ বছরের পুরনো একটি রিট পুনরুজ্জীবিত হলো? ঠিক এই সময়েই বা কেনÑযখন চারিদিকে গুমোট রাজনৈতিক শূন্যতা ও ক্ষমতার বৈধতার প্রশ্ন প্রকট হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী সরকার সবার অংশগ্রহণমূলক একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের জন্য প্রচ্ছন্নভাবে আন্তর্জাতিক চাপে রয়েছে এবং যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে দেশি-বিদেশি চক্রের সমন্বয়ে নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে জনগণের কষ্টার্জিত শত শত মিলিয়ন ডলার লোপাট হচ্ছে? একটা ঘটনাকে আরেকটি ঘটনা দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা আমরা তো একের পর এক দেখে আসছি। হঠাৎ আদালতে রিট এবং হঠাৎ হাইকোর্টে শুনানির তারিখ নির্ধারণÑএসবই খুব দ্রুত ঘটছিল। যাই হোক, রাষ্ট্রধর্ম ইস্যুটি সামনে আসায় একদিকে ভালোই হয়েছে। আজ বা কাল এ বিষয়ে একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দরকার ছিল। হাইকোর্ট কর্তৃক রিটটি খারিজের পর আমরা মুসলমানরা এখন বলতেই পারি যে, ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আছে এবং থাকবে’।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রেখে ২০১১ সালের ২৫ জুন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্তৃক পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। প্রতিস্থাপিত ২ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম; তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে।’ এখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের অবস্থান অবশ্যই একটি গণতান্ত্রিক অধিকার, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের অনুকূল। একই সাথে অন্যান্য ধর্মের প্রতিও সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদেশের ইসলামবিদ্বেষী অপশক্তি কোনোভাবেই চায় না ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ জাতীয় কিছু একটা সংবিধানে থাকুক।
এর আগে সংবিধান থেকে ‘ধাল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্যটি ছেঁটে দেওয়ার পরও তাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। এরপর তারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নির্ধারিত পাঠ্যবইগুলোকে ইসলামী ভাবধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এমনকি ইসলাম শিক্ষা বইয়ে পর্যন্ত নানা ধরনের অপব্যাখ্যাসহ শিরক করা হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একট ঐতিহ্যবাহী কওমী মাদরাসায় গভীর রাতে পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের হামলায় একজন তালেবুল ইলম মৃত্যুবরণ করে। যারা রাষ্ট্রধর্মের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে করা রিটটির পক্ষে ছিল, তারাই দেশের দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র ও শান্তিপ্রয়াসী কওমী মাদরাসাগুলোকে ‘জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র’ বলে এতদিন যারপরনাই প্রপাগান্ডা চালিয়ে আসছে। তারা রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের পক্ষে থেকে সংবিধানের ধর্মনিরেপক্ষ চরিত্রের বিশুদ্ধতা দাবি করে, অথচ আজ বাংলাদেশে বৈধতার অভাবে গণতন্ত্র যে নব্য ফ্যাসিবাদের কবলে পতিত, সে বিষয়ে তাদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। এছাড়া ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ন্যূনতম অধিকারের ব্যাপারে তারা যতটা কাতর ও তৎপর, ততটা কাতর তারা নন রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও জুলুমে নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠদের মানবাধিকারের ব্যাপারে। কার্যত এখানেই তাদের ভ-ামি ও চাতুর্য ধরা পড়ে। অন্যদিকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের চরম রাজনৈতিক বৈষম্যমূলক নীতির কারণে প্রশাসন ও আর্থ-সামাজিক স্তরে পক্ষপাতমূলক সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিকদের উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা অবাধ করে দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে ইসলাম ভাবাপন্ন নাগরিকরা অনেক ক্ষেত্রেই বঞ্চনা ও বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির শিকার।
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানে থাকলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও জানমালের রক্ষণাবেক্ষণে রাষ্ট্রের কোনো অসুবিধা নেই বলে আমরা মনে করি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের চেয়ে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান হাজারগুণে ভালো। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো তুলনামূলকভাবে অনেক নিরাপদ ও স্বস্তিতে রয়েছেন। এখানে সংখ্যালঘুদের প্রতি কোনো ধরনের বর্ণবাদ, জাতপাতের সংস্কৃতি কিংবা আর্থসামাজিক বৈষম্যের মতো অমানবিক ও নিবর্তনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি নেই, কেননা ইসলাম এখানে মহানুভবতা ও সাম্যের মহান শিক্ষা দিয়ে একটি স্থিতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে বিরাজমান। সুতরাং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকলে সংখ্যালঘুদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু। তবে অবশ্যই এক্ষেত্রে অধিকাংশ মিডিয়াকে তাদের একচক্ষু নীতি ও প্রপাগান্ডামূলক তৎপরতা পরিহার করতে হবে। সেকুলারিজম ভারতে সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিতি। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীন মৌলবাদী দল বিজেপির রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও জিঘাংসার মুখোমুখি দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো। সুতরাং এটা বলা সঙ্গত যে, এই উপমহাদেশে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ‘মুখ ও মুখোশে’র অধিক কিছু হয়ে উঠতে পারেনি। এমনকি বাংলাদেশেও এটি তথৈবচ। বরং বলা যায়, ইসলাম ও তৌহিদি জনতার ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে খেলা করার ক্ষেত্রে এটি একটি মস্ত বড় হাতিয়ার।
অন্যদিকে, উগ্র সেকুলার শাহবাগীদের মনোভাব হচ্ছে এমন যে, ‘যারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাও, তারা পাকিস্তানে চলে যাও।’ তাহলে রাষ্ট্রধর্মের পক্ষে আমরাও বলতে পারি, ‘যারা ধর্মনিরপেক্ষতা চাও, তারা ইন্ডিয়া চলে যাও’। কিন্তু তর্কটা উভয়পক্ষের দিক থেকে এতটা গোঁড়ামির পর্যায়ে থাকলে এদেশে শুধু বিভাজনই বাড়বে বৈকি। উগ্র ও গোঁড়া সেকুলারদের এখন বুঝতে হবে যে, পাকিস্তানবিদ্বেষ বা পাকবিরোধিতা এখন আর বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক বাস্তবতা কিম্বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাজনীতি নয়। একাত্তরে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানবিরোধিতার অবসান ঘটিয়েছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের(আজকের বাংলাদেশ) জনগণ। তাই বাংলাদেশ নামক একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ঘটনায় সেই তদানীন্তন ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ভৌগোলিক বাস্তবতা এখন আর বজায় নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরপরই সাবেক রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিজেই সরাসরি ভুট্টোকে বিমানবন্দরে লালগালিচায় স্বাগত জানিয়ে এদেশে পাকিস্তানবিরোধী রাজনীতির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটিয়েছিলেন বলা যায়। ফলে যৌক্তিকভাবেই সেই ঐতিহাসিক পাকিস্তানবিরোধী রাজনীতির অস্তিত্ব ও বাস্তবতা এখন আর অবশিষ্ট থাকতে পারে না। এতদসত্ত্বেও বর্তমানে আমাদের দেশের একশ্রেণির চিহ্নিত মিডিয়ায় এবং উগ্র সেকুলার ও শাহবাগপন্থীদের ভাবনাচিন্তায় উগ্রভাবে পাকিস্তানবিদ্বেষ লালিত হয়ে আসছে। এটা উগ্র রেসিজমও বটে। কিন্তু এটা প্রকৃতপক্ষে ইন্ডিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির একটি অন্যতম প্রপাগান্ডা এবং এদেশে ইন্ডিয়ার পেইড বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া ও দালালগোষ্ঠী কর্তৃক এই প্রপাগান্ডা এখনো চলমান, কারণ সেটা ইন্ডিয়ার পক্ষে সার্ভ করে। তাই ভারত সমর্থিত এদেশের ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ মাঝেমধ্যেই পাকিস্তানের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা জাহির করে ইন্ডিয়ার কাছে নিজেদের সতীত্ব প্রমাণ করতে তৎপর থাকেন। ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের রাজনীতির ইতিহাস বহু পুরোনো এবং এখনো তীব্রভাবেই বিদ্যমান। সুতরাং এদেশের উগ্র সেকুলার ও শাহবাগীরা কথায় কথায় পাকিস্তানবিরোধিতা ও পাকবিদ্বেষ জাহির করে প্রকারান্তরে ইন্ডিয়ার মুৎসুদ্দীরূপেই কাজ করে। আর এটা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অবৈধ আওয়ামী ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ভারতের বিশেষ প্রভাব ও প্রপাগান্ডা বিদ্যমান থাকাটা ইতোমধ্যেই বেশ স্বাভাবিক ও প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। এমনকি সম্প্রতি কলকাতায় বিজেপি’র সাথে আওয়ামী লীগের একটি গোপন বৈঠক হয়েছে বলে কলকাতার প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্যা টেলিগ্রাফ বিগত ২ মার্চ একটি রিপোর্ট করেছিল। টেলিগ্রাফ সূত্রে জানা যায়, বিজেপি’র জয়েন্ট ন্যাশনাল জেনারেল সেক্রেটারি লাল মাধবের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠক আয়োজনে হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন আরএসএস’র এক প্রভাবশালী নেতা মূল ভূমিকা পালন করে। এই গোপন বৈঠকটির ব্যাপারে আমাদের দেশের মেইনস্ট্রিম মিডিয়া কোনো নিউজ বা রিপোর্ট করেছে বলে আমার চোখে পড়েনি। টেলিগ্রাফের ঐ রিপোর্টে বৈঠকটিতে অংশগ্রহণকারী নাম-অনুল্লেখ্য এক আওয়ামী নেতার বক্তব্য ছিল এরকম: “During our meeting, we gave details of the situation of the minority community in Bangladesh. There were also discussions on how to develop stronger bonds between the BJP and our party,” said an Awami League leader who had attended the meeting. “I came to India after getting the necessary clearance from my party bosses,” the leader added, making it clear that the ruling party in Bangladesh did not have problems in engaging with the BJP or the RSS. Muslim-majority Bangladesh has around 2 crore Hindus.” (The Telegraph)| । সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ এখন বিজেপি’র সাথে তার সম্পর্ককে আরো মজবুত ও শক্তিশালী করতে চায়। তার মানে, চরম গোঁড়া সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী দল বিজেপি’র সাথে সম্পর্ক উষ্ণকরণে ‘ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল’ আওয়ামী লীগের এখন কোনো সমস্যা নেই। সুতরাং এই অবস্থায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বাতিল করতে পারলে দাদাবাবুরাই যে খুশি হবেন তা বলাই বাহুল্য।
আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার না করলে এবং ঈমান-আকিদার ব্যাপারে জাগতিক পরিসরে সচেতন না থাকলে কোনো জাহেলি শাসক ও শাসনব্যবস্থার পক্ষে এ বৃহত্তর মুসলিম জাতির শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যদি বিলুপ্ত করা হতো, তাহলে বলা বাহুল্য যে, রাষ্ট্রযন্ত্রে যে গোলযোগ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতো তা মোকাবিলা করার সামর্থ্য ক্ষমতাসীনদের আছে বলে মনে হয় না।
য় লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tareqislampt@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন