বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

আদিগন্ত

যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে প্রথম হতে হলে

আবুল কাসেম হায়দার | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

পোশাক শিল্প দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত। এক সময় পাট ও পাটজাত দ্রব্য ছিল আমাদের রপ্তানির মূল উৎস। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পোশাক শিল্পের পর সেই স্থান দখল করেছে দেশের জনশক্তি রপ্তানি খাত। রপ্তানিতে এগিয়ে এসেছে বস্ত্রখাতের বিভিন্ন উপখাত, পাট ও পাটজাত পণ্য, বৈদ্যুতিকপণ্য, প্লাস্টিক পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রভৃতি।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এখানে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি আয় ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। তবে পরিমাণে বাড়লেও পোশাকের দামও কমছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আগের তুলনায় আরও একটু শক্ত হয়েছে। বেড়েছে বাজার অংশ। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৭২ কোটি বর্গমিটার সমপরিমাণ কাপড়ে ৫০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় ২০১৪ সালের প্রথম নয় মাসের ৪৪৮ কোটি ডলারের রপ্তানির চেয়ে ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। গত দুই বছরের মধ্যে বাজারটিতে এটিই সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা) পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।
অটেক্সার হিসাব বলছে, গত ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বরে প্রতি বর্গমিটার সমপরিমাণ কাপড়ে তৈরি করার ক্ষেত্রে এক ইউনিট পোশাকের দাম ছিল প্রায় ৩ ডলার। বিদায়ী বছরের একই সময়ে এই মূল্য কমে ২ ডলার ৯০ সেন্টে দাঁড়ায়। তার মানে, এক বছরের ব্যবধানে পোশাকের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে পোশাকের মূল্য হ্রাসের হার ছিল ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের শেষ চার মাসেই মূল্য কমছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ।
পোশাকের এই মূল্য হ্রাস নিয়ে পোশাকশিল্পে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে দুই ধরনের মতামত পাওয়া গেছে। তবে উভয় পক্ষই বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারেও পোশাকের মূল্য কিছুটা কমে গেছে। একদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে পোশাকের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় মালিকেরা কিছুটা চাপের মধ্যে আছেন। গত এক বছরে তুলার দাম অনেক কমেছে। সে জন্য বিদেশি ক্রেতারাও পোশাকের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। তবে দেশে মজুরি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে গেছে। সেই হিসেবে কারখানামালিকেরা একটু সমস্যার মধ্যেই আছেন।
অন্যদিকে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে একটু টানাপোড়েন চলছে। ভোক্তারা পোশাকের জন্য বেশি অর্থ খরচ করতে চাইছে না। সে জন্য ব্র্যান্ডগুলো ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়াচ্ছে না, কিন্তু উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগের চেয়ে প্রতি পোশাকে ১৫-২০ সেন্ট কম দিচ্ছে। অবশ্য ক্রয়াদেশের পরিমাণ বেশি হওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। পোশাকের মূল্য কমেছে সত্য। তবে যারা ক্রেতার সঙ্গে ভালো দর-কষাকষি করতে পারছেন, তাদের সমস্যা হচ্ছে না।
এদিকে অর্থের পাশাপাশি পরিমাণের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। গত বছরের প্রথম ১১ মাসে বাংলাদেশ থেকে ১৭২ কোটি ৫৭ লাখ বর্গমিটারের সমপরিমাণ পোশাক রপ্তানি হয়। এটি তার আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি হওয়া ১৪৮ কোটি বর্গমিটারের চেয়ে ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি। এই প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ দশ রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত বছরের প্রথম ১১ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২ হাজার ৫১৯ কোটি বর্গমিটার সমপরিমাণ কাপড়ের ৭ হাজার ৮৯৬ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে। তাদের পোশাক আমদানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ শতাংশ। এদিকে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষস্থানটি চীনের দখলেই আছে। গত বছরের প্রথম ১১ মাসে দেশটি ২ হাজার ৮৪০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের বাজারের ৩৫ দশমিক ৮৬ শতাংশই চীনের দখলে। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভিয়েতনাম। আলোচ্য সময়ে দেশটি রপ্তানি করেছে ৯৭৯ কোটি ডলারের পোশাক। তাদের প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৪ শতাংশ এবং বাজার হিস্যা ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। অনেক দিন ধরেই তৃতীয় বাংলাদেশ।
অটেক্সার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ছয় রপ্তানিকারকদের মধ্যে পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ বর্তমানে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। অন্যদিকে পরিমাণের হিসাবে এ বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা বেড়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ। আর অর্থের হিসাবে ৬ দশমিক ৩০ শতাংশ। ফলে বাংলাদেশের অবস্থান আগের চেয়ে কিছুটা শক্ত হয়েছে।
তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান বৃদ্ধির উপায় : ১. আমরা মার্কিন মুল্লুকে জিএসপি নিয়ে বেশ অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছি। দীর্ঘ দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার নানা ইস্যুতে জিএসপি সুবিধা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদিও পোশাক শিল্পের জন্য জিএসপি কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি। কিন্তু ইমেজ সংকট তৈরি করেছে। অন্যান্য রপ্তানি পণ্য জিএসপি সুবিধা না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে সুবিধা পাচ্ছে না। বিষয়টি একেবারেই রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সুবিবেচনায় নিতে হবে। সরকার রাজনৈতিকভাবে জিএসপি ইস্যু দ্রুত সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।
২. আমরা এখনও তৈরি পোশাক শিল্পের একেবারেই প্রাথমিক, কমমূল্যের পোশাক রপ্তানি করছি। সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করছি। কিন্তু ভ্যালুঅ্যাডেড তৈরি পোশাক রপ্তানি করার উদ্যোগ আমাদের দেশের শিল্প উদ্যোক্তাদের নিতে হবে। আমাদের ব্যাক ওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে অতি মূল্যবান পোশাক তৈরির কারখানা স্থাপন করা দরকার। এখনও আমাদের দেশের রপ্তানিকারকরা শুধু সস্তা মূল্যের পোশাক প্রস্তুত করে রপ্তানি করছেন। আজকের বিশ্বে উন্নত দেশসমূহের মানুষ অতি মূল্যমানের পোশাক পরিধান করে। ওই সকল পোশাক তৈরির জন্য অধিক মূলধন সম্পন্ন কারখানা তৈরি করতে হবে। দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে ২০ কোটি ডলারের একটি বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল গঠন করা হবে। তৈরি পোশাক শিল্পখাত এই ক্ষেত্রে কম সুদে ঋণ নিয়ে পরিবেশ বান্ধব কারখানা স্থাপন করতে পারবে। এই ক্ষেত্রে আমি বলবো, সরকারের পক্ষে থেকে পরিবেশবান্ধব কেন, নতুন নতুন পণ্যের উৎপাদনমুখী কারখানা তৈরি শর্তে এই ঋণ সুবিধা দেয়া উচিত। তৈরি পোশাকের এখনও শত শত পণ্য আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে না। ওই সকল অধিক মূল্যের ও মানের পোশাক তৈরিতে কম সুদে ঋণ ব্যবস্থা থাকা দরকার। কারণ ওই সকল শিল্প স্থাপনে অধিক বিনিয়োগ করতে হবে। সুদ কম হলে বিনিয়োগ সহজ হবে। বিনিয়োগকারীগণ উৎসাহিত হবেন। তখন মার্কিন মুল্লুকে আমাদের অধিক তৈরি পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
৩. তৈরি পোশাক শিল্পে চ্যালেঞ্জ এক এক করে মোকাবেলা করে আমাদের দেশের শিল্প মালিকগণ এখন টিকে থাকার অফুরন্ত চেষ্টা চালিয়ে সফল। এই সফলতার ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। এক সময় তৈরি পোশাক শিল্পে চ্যালেঞ্জ আসলো কোটা প্রথা চালু করে। তখন আমাদের দেশের উদ্যোক্তাগণ কোটা প্রথাকে মোকাবেলা করে এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে গেল। কোটা তথা আমাদেরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এরপর এলো চাইল্ড লেবার ইস্যু। চাইল্ড লেবার ইস্যুকে আমরা সফলভাবে মোকাবেলা করে চাইল্ড লেবার মুক্ত পোশাক রপ্তানিতে সক্ষম হয়েছি। বিগত কয়েক বছর ধরে এসেছে কমপ্লায়েন্স ইস্যু। এই কমপ্লায়েন্স ইস্যু চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে আমরা মাথা উঁচু করে রপ্তানিতে পূর্বের স্থান দখল রাখতে সক্ষম হয়েছি। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানির স্থান দ্বিতীয়। একটি ধাপ অতিক্রম করতে পারলে আমরা পৌঁছে যাবে প্রথম রপ্তানিকারক হিসাবে। এই জন্য সরকারকে নীতিগত, আর্থিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার হাতকে অনেক বেশি মজবুত করতে হবে।
৪. ব্যাংকের সুদের হারকে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। সারা বিশ্বে সুদের হার ৩ থেকে ৪ শতাংশ। আর আমাদের দেশে এখনও ব্যাংক আর্থিক খাতের ঋণের সুদ ১০ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত চলেছে। এই হার অত্যন্ত বেশি। এই হার কমিয়ে আনতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, বিশ্বের বাজারে আমাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে হলে ব্যাংকের সুদে হার একক সংখ্যায় নামিয়ে আনতে হবে।
৫. সকল কিছুর ঊর্ধ্বে দেশে আইন শৃঙ্খলা-পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে। আইনের সুশাসন কায়েম করতে হব। সকলের জন্য আইনকে সমানভাবে কার্যকর করতে হবে। বিশ্বের ক্রেতা জগতে ‘আমাদের দেশের আইনের সুবিচার হচ্ছে’ সেই বার্তা দিতে হবে। তখনই ক্রেতাগণ আমাদের দেশের প্রতি আগ্রহ বাড়াবে।
৬. দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অতি জরুরি। বিগত কয়েক মাস ধরে বিরোধী রাজনৈতিক দলের তেমন কোন কর্মসূচি নেই। তবে মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক প্রশান্তিও নেই। ভিতরে ভিতরে রাজনৈতিক তুষের আগুন এখনও বিরাজমান। এই অবস্থার অবসানের জন্য প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, সকলদলের অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন। সরকারকে এই বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে তৈরি পোশাক সহ সকল ধরনের রপ্তানি শিল্পে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় অবস্থান থেকে প্রথম অবস্থানে আসতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
লেখক : সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন