১৯৪০ সালের মার্চ মাসের ২৩ তারিখ, তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের অন্যতম মহানগরী লাহোরে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল : অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সম্মেলনে তৎকালীন বাংলার অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। ওই প্রস্তাব মোতাবেক তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হতো বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বর্তমান বাংলাদেশ মিলিতভাবে ১৯৪০ সালে ভৌগোলিক ও প্রশাসনিকভাবে যেমন ছিল, সেই বঙ্গপ্রদেশ নিয়ে। দ্বিতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র হতো বর্তমানের পাকিস্তান নামক দেশটি। তৃতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র হতো বাকি ভারতের অমুসলিম অংশটি নিয়ে। চতুর্থ বা পঞ্চম বা এ রূপ আরো স্বাধীন রাষ্ট্র সৃষ্টির যৌক্তিকতা ও অবকাশ ওই প্রস্তাবে ছিল। ২৩ মার্চ ১৯৪০ তারিখে এই প্রস্তাবটি অত্যন্ত উষ্ণভাবে ও জোরালোভাবে সমর্থিত হয়ে পাস হয়েছিল। এই প্রস্তাবটি ইতিহাসে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে খ্যাত। আজকের (২০১৮) পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী লাহোর মহানগরীতে ‘মিনার-এ পাকিস্তান’ নামক একটি বিরাট স্মৃতিস্তম্ভ আছে ওই জায়গাতেই, পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হওয়ার ঐতিহ্যস্বরূপ। এ পাকিস্তান প্রস্তাব বাস্তবায়ন হওয়ার পথে যখন ছিল, তখন তৎকালীন মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে এবং তৎকালীন মুসলিম নেতৃত্বের অভ্যন্তরে ষড়যন্ত্র রচিত হয়। ওই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৪৬ সালে তৎকালীন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উদ্যোগে, মুসলিম লীগের সভায়, পাকিস্তান প্রস্তাবটি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত পাকিস্তান প্রস্তাব মোতাবেক, তৎকালীন (অর্থাৎ ১৯৪৬ সালের) ব্রিটিশ-ভারতের পূর্ব অংশে অবস্থিত বঙ্গপ্রদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এবং তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের পশ্চিম অংশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশগুলো মিলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে যার নাম পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়; যার পূর্ব অংশ ছিল পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান। ২৩ বছরের মাথায় সেই পূর্ব পাকিস্তান, রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয়, স্বাধীন বাংলাদেশে।
স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গুরুত্বপূর্ণ তারিখগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করে রাখছি। পয়লা মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রতিশ্রæতি ভঙ্গের প্রথম পদক্ষেপ নেন; তিনি নবনির্বাচিত সদস্যসংবলিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন; ১৯৭১ সালের মার্চের ৩ তারিখ ছিল সেই অধিবেশনের তারিখ। ২ মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে, তৎকালীন ছাত্রনেতা আ স ম আব্দুর রবের হাত দিয়ে, এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। ৩ মার্চ একই কলাভবনের সামনে তৎকালীন ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজের কণ্ঠ দিয়ে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ৭ মার্চ ছিল অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ভাষণের দিন; তৎকালীন ঢাকা মহানগরের রমনা রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাখ লাখ মানুষের সামনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণটি এখন ইউনেস্কোর সময়োপযোগী সৌজন্যে বিশ্ব মেমোরির ও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল ওই মুহূর্তের প্রেক্ষাপটে বাঙালি জাতির জন্য দিকনির্দেশনা। সেই দিকনির্দেশনার ভিত্তিতেই পরবর্তী দিনগুলো অতিবাহিত হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে। আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়নে, ওই দিন তথা ১৯৭১-এর ৭ মার্চ তারিখে প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা না থাকলেও, স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য সব ধরনের উপাত্ত ও ইন্ধন উপস্থিত ছিল। ১৯ মার্চ ১৯৭১-এর কথা বলি। তখনকার আমলে জায়গাটি প্রসিদ্ধ ছিল জয়দেবপুর নামে; এটি ছিল একটি থানা সদর দপ্তর এবং ইতিহাসখ্যাত ভাওয়াল রাজাদের রাজধানী বা আবাসস্থল। সেই আবাসস্থলের নাম ছিল জয়দেবপুর রাজবাড়ী। বর্তমানে সেখানে গাজীপুর জেলার সদর দফতর অবস্থিত। ওই ১৯ মার্চ তারিখে, ভাওয়াল রাজাদের রাজবাড়ীতে অবস্থানকারী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট স্থানীয় বেসামরিক জনগণকে নিয়ে পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তখন আমি ছিলাম ওই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কনিষ্ঠতম অফিসার এবং বিদ্রোহীদের একজন।
২৫ মার্চের দিনের শেষে রাত্রি ছিল বাংলার ইতিহাসের কালরাত্রি, নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের রাত। ২৫ মার্চ দিনের শেষে পাকিস্তানিদের হামলার মুখে সমগ্র দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ হয়েছিল; প্রথম বিদ্রোহটি ছিল চট্টগ্রামে তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক বিদ্রোহ হলো চট্টগ্রাম মহানগরের ষোলোশহরে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ওই রেজিমেন্ট কর্তৃক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা। একই ২৬ মার্চ তারিখে, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল-গাজীপুর থেকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে; কুমিল্লা-মৌলভীবাজার-ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। ২৬ মার্চ কাপ্তাই-চট্টগ্রাম-চুয়াডাঙ্গা ইত্যাদি এলাকা থেকে তৎকালীন ইপিআর-এর বাঙালিরা বিদ্রোহ করে। ২৬ মার্চ হলো মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিন তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিন। ২৭ মার্চ তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগরের অদূরে অবস্থিত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা; তিনি প্রথমে নিজের নামে ঘোষণা করেন এবং কয়েক ঘণ্টা পরেই বঙ্গবন্ধুর নামে আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন; এ ঘোষণাটিই পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে শুনেছিল। তৎকালীন রংপুর জেলার সৈয়দপুর সেনানিবাসে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন পাকিস্তানি লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ফলে তারা বিদ্রোহ করার সময় প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তৎকালীন যশোর সেনানিবাসে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক একজন বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল হলেও সিদ্ধান্তহীনতা বা যেকোনো কারণে তিনি বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে পারেননি; ফলে দুই দিন বিলম্বে ২৯ মার্চ তারিখে তৎকালীন ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে, এ ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করে এবং পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে যুদ্ধ করতে করতেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস দুইটি পরিষ্কার স্বচ্ছ পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্ব হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাত্রি থেকে নিয়ে পেছনের দিকে বা অতীতের দিকে পাঁচ বছর বা সাত বছর বা উনিশ বছর বা ২৩ বছর ধরে ব্যাপ্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস দ্বিতীয় পর্বের শুরু হচ্ছে ২৬ মার্চ থেকে এবং শেষ হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে। প্রথম পর্বের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন রাজনৈতিক দলগুলো, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, ব্যাপকভাবে জনসমর্থিত ভূমিকা পালনকারী রাজনৈতিক দল ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। দ্বিতীয় পর্বের নেতৃত্ব দুই ভাগে বিভক্ত। দ্বিতীয় পর্ব তথা ২৬ মার্চ ১৯৭১ পরবর্তী নেতৃত্বের একটা অংশ হলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দ্বিতীয় অংশ হলো মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে সামরিক নেতৃত্ব। দ্বিতীয় পর্বের তথা ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে পরবর্তী নয় মাস রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করেছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বা ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে মুজিবনগর বা কলকাতাকেন্দ্রিক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। দ্বিতীয় পর্বের তথা ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে পরবর্তী ৯ মাস রণাঙ্গনের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন, প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী এবং চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করেন সেক্টর ও ফোর্স কমান্ডাররা, সাবসেক্টর কমান্ডাররা, ব্যাটালিয়ন কমান্ডাররা, কোম্পানি কমান্ডাররা, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রæপ কমান্ডাররা, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের জেলা কমান্ডাররা, গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের থানা কমান্ডাররা ইত্যাদি।
স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস কোনোমতেই ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে নয় বরং আরো বহু বছর আগে থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস শুরু; এই কথা অতীতেও বহু কলামে বা আমার লেখা বইয়ে লিখেছি। আজ তার ব্যাখ্যায় যাবো না। যুদ্ধকালীন সময়েও, রণাঙ্গনে যেমন মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন, তেমনই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরাও রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের পেছনে সহায়কশক্তি ছিলেন। বিগত ৪৬ বছরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পরিচয়ধারী ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। কিন্তু রণাঙ্গনের যোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়নি। একটি দুঃখজনক অনুধাবন বা মূল্যায়ন উপস্থাপন করছি। ৪৬ বছরের ক্রমাগত ও অব্যাহত চেষ্টার ফলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাসটিকে গৌণ ও প্রান্তিকরণ (ইংরেজি পরিভাষায় মার্জিনালাইজড) করে ফেলা হয়েছে। এই প্রান্তিকরণ বা মার্জিনালাইজেশন প্রক্রিয়া ১৯৭২-এর শুরুতেই আরম্ভ হয়েছিল। পরবর্তী অনুচ্ছেদে যৎকিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা আছে।
সেই সময় বঙ্গবন্ধু সরকারের সামনে দুইটা রাজনৈতিক চয়েজ বা অপশন ছিল। একটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সব দলের মানুষকে নিয়ে একটি সর্বদলীয় সরকার গঠন করে বাংলাদেশ শাসন করা। আরেকটি চয়েজ ছিল যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে সেহেতু শুধু আওয়ামী লীগকে দিয়ে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ শাসন করা। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় অপশন তথা আওয়ামী লীগের পক্ষেই সিদ্ধান্ত নেন। ফলে জাসদের জন্ম হয়; যদিও জাসদের জন্মের এটাই একমাত্র কারণ নয়। ১৯৭২ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু সরকার আহŸান জানিয়েছিল রণাঙ্গনের সব মুক্তিযোদ্ধা বা অন্য সব মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের আগে তার যেই পেশা ছিল সে যেন ওই পেশাতেই ফিরে যায়। উদাহরণস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধের আগেরকার মৎস্যজীবীরা, মুক্তিযুদ্ধের আগের স্কুল শিক্ষকেরা, মুক্তিযুদ্ধের আগেরকার মুদি দোকানদাররা, মুক্তিযুদ্ধের আগেরকার কৃষক-শ্রমিক-ছাত্ররা সবাই নিজ নিজ পেশায় ফেরত গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেরকার পুলিশরা পুলিশে ফেরত গেলেন, ইপিআর ইপিআরে (নতুন নামে বিডিআর, বর্তমান নাম বিজিবি) ফেরত গেলেন, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক বাহিনীতে ফেরত গেলেন, সিএসপি বা ইপিসিএস বা পাকিস্তান আমলের অন্যান্য আমলা-ক্যাডারের কর্মকর্তা নতুন দেশ (বাংলাদেশের) ক্যাডারগুলোতে ফেরত গেলেন বা প্রশাসনে যুক্ত হলেন। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তথা বাংলাদেশের মাটিতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছেন এমন মুক্তিযোদ্ধাগণের মধ্যে, যুদ্ধ পূর্বকালের রাজনৈতিক কর্মী তুলনামূলকভাবে কমই ছিলেন; বেশির ভাগ রাজনৈতিক কর্মীই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ছিলেন অথবা বিএলএফের সদস্য ছিলেন। বিএলএফ মানে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স; যার জনপ্রিয় নাম ছিল মুজিব বাহিনী। ওই বাহিনীর সদস্যরা অবশ্যই ছাত্রলীগ-যুবলীগের পরীক্ষিত কর্মী ছিলেন। সেই বাহিনীটি ১৯৭১-এর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। বিএলএফ নামক বাহিনীর জন্ম, গঠন, লালন-পালন, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সব কিছুই ছিল ভারত সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। ১৯৭১ সালে ওই বাহিনীর প্রধান ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আপন ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি। অতএব ১৯৭২ সালের শুরুতে, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সাড়া দিয়ে, সব মুক্তিযোদ্ধা সাবেক রাজনৈতিক কর্মী, তাদের সাবেক পেশা তথা রাজনীতিতেই ফেরত গেলেন। অতএব ১৯৭২ সালের শুরু থেকেই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ শাসন করার জন্য পাওয়া গেল সাবেক রাজনৈতিক কর্মীদের এবং সাবেক আমলাদের যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। যেসব মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশের শাসনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারলেন, তারা ছিলেন বিএলএফ। তাদের সাথে যুক্ত হলেন কিছুসংখ্যক নব্যরাজনৈতিক কর্মী, যারা কোনো প্রকারেই মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হতে পারেননি এবং যুক্ত হলেন হাজার হাজার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কর্মকর্তারা যারা ৯ মাস যেকোনো কারণেই হোক যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সারমর্ম: রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের শাসনপদ্ধতি বা প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারেননি; ১৯৭২-এর শুরু থেকেই তাদের স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারির মতো অবস্থানে বসানো হলো। তাদের চোখের সামনেই হয় বাংলাদেশ উন্নতি করছিল অথবা বাংলাদেশ স্থবির হয়েছিল অথবা বাংলাদেশের অবনতি হচ্ছিল। সন্তান জন্ম দেয়ার পর সন্তানের ভালো-মন্দ এবং লালন-পালনে সন্তানের মা-বাবারা যতটুকু আবেগের চেতনায় ও দায়িত্বের চেতনায় সক্রিয় থাকেন, ততটুকু বেতনভুক নার্স থাকতে পারেন না; এটাই স্বাভাবিক। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের সেই আমলের বেদনা, সেই আমলের কোনো পর্যায়েই উপযুক্তভাবে মূল্যায়িত হয়নি। এই অবমূল্যায়নের খেসারত বাংলাদেশ অনেক দিয়েছে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের বয়সের প্রবীণত্বে এসে একান্ত কামনা আর যেন খেসারত দিতে না হয়।
রাম ও অযোধ্যা বাংলাদেশের সাহিত্যে ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে সুপরিচিত শব্দ ও নাম। ইতিহাসের বা অতীতের কোনো কিছুর সাথে বর্তমানের বিচ্যুতি বা পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে অনেক সময় বাংলা ভাষায় প্রচলিত প্রবাদ ব্যবহার করা হয়। যথা: সেই রামও নেই, সেই অযোধ্যাও নেই। রাম ও অযোধ্যার কাহিনী বা ইতিহাস হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্রগ্রন্থে (নাম : রামায়ণ) আছে। ২০১৮ সালে এসে রামের মতো পিতৃভক্ত ও ভ্রাতৃপ্রিয় এবং প্রজাঅনুরাগী শাসক যেমন পাওয়া যাবে না, তেমনই অযোধ্যার মতো শান্তি ও স্থিতিশীল নগরীও পাওয়া যাবে না। এটা ১৯৭২ না, তখনকার রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা এর সংখ্যাও আর অত নেই, ওই আমলের মতো সচেতনতাও আর নেই। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত ইতিহাস কেন পুনরাবৃত্তি করলাম? পুনরাবৃত্তি করার উদ্দেশ্য- এই কলামের তরুণ পাঠকরা যেন বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্নপর্যায়ের, বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাস বা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট কিঞ্চিৎ হলেও অনুধাবন করতে পারেন। যেহেতু আজকের তরুণ পাঠকেরাই, তরুণ রাজনৈতিক কর্মীরাই, যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তনের অনুঘটক হতে বাধ্য। যেই পুনরাবৃত্তি আমি করলাম, যেই বিচ্যুতিগুলোর কথা ওপরে তুলে ধরলাম, সেগুলো যদি অনুসরণ করি, ছাপার লাইনগুলোর মাঝখানে শূন্যস্থানের কথাগুলো যদি অনুমান করি, তাহলে, বর্তমান নিয়ে চিন্তা ও পরিষ্কার মূল্যায়ন করা সহজ হবে। সংক্ষিপ্ত কলামে কোনোমতেই পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন