ড. আব্দুল হাই তালুকদার
প্রশ্ন হলো বেগম জিয়ার ভিশন-২০৩০ কি আদৌ বাস্তবায়নযোগ্য? কেননা তার সৃজনশীল বহুমুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বহুমুখী সংস্কার আবশ্যক। সংবিধানের সংশোধন তার ওপর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নির্ভর করছে। সংবিধান সংশোধন ও সংযোজনে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব। অনেকে বলছেন, সংসদে ২/৩ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কোন দলের পক্ষে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। বেগম জিয়া এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে অবগত আছেন। সেকারণে তিনি জাতীয় ঐকমত্যের ডাক দিয়েছেন। দেশের মঙ্গলার্থে সকল রাজনৈতিক নেতা ও দল সহমত পোষণ করলে যে কোন সংস্কার সম্ভব। সেক্ষেত্রে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ গড়া খুবই সম্ভব।
গত ১৯ মার্চ, ২০১৬ বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। বেগম জিয়া ও তারেক রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান ও সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। কাউন্সিলের দিন অবশ্য একযোগে তাদের নির্বাচনকে সমর্থন দিয়েছেন কাউন্সিলররা। তারা সকলে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের উপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ করে আনন্দিত। কাউন্সিলের পরপর আমি একটি লেখায় বেগম জিয়ার মিশন ও ভিশন-২০৩০ নিয়ে কিছুটা আলোচনা করেছি। ‘দুর্নীতি দুঃশাসনের হবেই শেষ, গণতন্ত্রের বাংলাদেশ’ এই সেøাগান দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ও পার্শ্ববর্তী সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানকে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়েছিল। কাউন্সিলে বেগম জিয়া এক যুগান্তকারী ও মানবমুখী ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনা পেশ করেন। তিনি তার ভিশনের খসড়া প্রকাশ করলেও এটিকে আগামী নির্বাচনী ইশতেহারে সংযুক্ত করবেন বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন। আমরা তার পরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়নযোগ্য ও কতটা বাস্তবায়নযোগ্য নয় এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
প্রথমেই বেগম জিয়া আল্লাহ রাববুল আলামিনের দরবারে শুকরিয়া আদায় করেন ও স্বাধীনতার এই মাসে শহীদদের স্মরণ করেন ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানান। ভারতসহ স্বাধীনতাযুদ্ধে যেসব দেশ ও বন্ধু প্রতিম জনগণ সহযোগিতা ও সমর্থন দিয়েছিলেন তাদের ধন্যবাদ জানান। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় নেতাদের অবদানের কথা স্মরণ করেন। মহান স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেনানায়ক, বাংলাদেশী জাতীয়বাদ ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও আদর্শের দিশারী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। অতঃপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে যারা অত্যাচার, নির্যাতন, কারাবরণ ও আহত-নিহত হয়েছেন তিনি তাদের প্রতি সমবেদনা ও সম্মান প্রদর্শন করেন।
বিএনপি চেয়ারপার্সন ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনা এক ঘণ্টার অধিক সময় ধরে প্রকাশ করেন। লক্ষণীয় বেগম জিয়া সরকারী দলের প্রতি আক্রমণাত্মক, হিংসাত্মক ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেননি। গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদের অভাব, জবাবদিহিতা, সুশাসন ও আইনের শাসনের অভাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। নারীর সম্ভ্রম হানি, মানবাধিকার বিপন্ন, নারী ও শিশু নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া, সামাজিক অস্থিরতা, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি কর্মকা- দেখে তিনি ব্যথিত ও হতাশ। স্থিতিশীলতার বদলে অস্থিতিশীলতা, স্বেচ্ছাচার, দুর্নীতি, দুঃশাসন ও অনাচারে দেশ নিমজ্জিত। দেশ আজ সংকট কবলিত। সর্বগ্রাহী সমস্যা সংকট থেকে উত্তরণে ভবিষ্যৎ সৃজনশীল উৎপাদনমুখী কর্মপরিকল্পনা পেশ করে আলোকিত এক নতুন বাংলাদেশ উপহার দেয়ার অঙ্গীকার করেন। কাউন্সিলে তার বক্তব্য ও পরিকল্পনাকে অনেকে কৌশলী ও অবাস্তবায়নযোগ্য বলছেন। স্বল্পভাষী এই নেত্রী যা বলেন তা মিন করেন। আমি অনেকবার বলেছি, বাংলাদেশের উন্নতি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি বিএনপির মাধ্যমে সম্ভব। বেগম জিয়া ও তারেক রহমানই পারবেন মাহাথির মোহাম্মদের মত বাংলাদেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ ও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে। এটি কোন অলীক কল্পনা নয়। তার ভিশন খুবই বাস্তবায়নযোগ্য। শুধু প্রয়োজন হলো উদার, প্রাগ্রসর, মানবকেন্দ্রিক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির। বেগম জিয়া উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। তিনি মানবকল্যাণে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত যার প্রমাণ তিনি বারবার দিয়েছেন। তিনিই পারবেন বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি ও কার্যকর করতে। তিনি তার ভিশন প্রকাশের সময় সমালোচনার জবাব নিজেই দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি ভবিষ্যতমুখী ইতিবাচক রাজনীতির ধারার নেতৃত্ব দিয়েছে। এখনও বিএনপিই শুধু পারে ইতিবাচক সেই সম্মুখপ্রসারী ধারাকে এগিয়ে নিতে। এই যে ইতিবাচক ও ভবিষ্যতমুখী রাজনীতি ও পরিকল্পনার কথা আমরা বলছি এগুলো কেবল কথার কথা নয়। আমরা যা বলি তা বুঝে শুনে বলি এবং বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করি।’
বিএনপির কাউন্সিলে বেগম জিয়া ‘ভিশন-২০৩০’ নামে যে রূপকল্প ঘোষণা করেছেন তার যতই সমালোচনা করা হোক, তিনি ক্ষমতায় গেলে জনগণ নিশ্চিতভাবে তার সুফল পাবে। এতে সন্দেহ, সংশয় বা প্রতারিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। জনকল্যাণে যিনি দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ও পরিবার-পরিজন নিয়ে আরাম আয়েশের জীবন পরিত্যাগ করে এদেশে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, তার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে সংশয়ী হওয়ার সুযোগ নেই। সমৃদ্ধ ও আলোকিত বাংলাদেশ গঠনের দৃঢ় অঙ্গীকার তিনি পূরণ করবেন বলে আমাদের ষোলআনা প্রতিতী রয়েছে। ‘সুনীতি, সুশাসন ও সু-সরকার’ গঠনের প্রত্যয় আমাদের মুগ্ধ করেছে। ব্যক্তিকে দেখে নীতি-প্রণয়নের বদলে নীতির সাথে ব্যক্তিকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সাংবিধানিক সকল প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, প্রশাসন ও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা নিয়োগে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। কোন প্রকার নিয়োগ বা বদলীতে দলীয় আনুগত্যের বদলে প্রার্থীর মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সততাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়ার নীতি কার্যকর থাকবে। দলীয়করণের বিষময় ফল জাতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতির কবলে পড়ে ফোকলা হতে শুরু করেছে। নজিরবিহীন ঘটনা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ৮শ কোটি টাকা লোপাট হতে দেখে মানুষ উদ্বিগ্ন ও হতাশ। ব্যাংকিং খাত থেকে লুটপাটের সাথে সারাদেশে অনিয়ম, অনাচার, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও লুটপাটের মহোৎসব চলছে। নিরপেক্ষ নিয়োগ পদ্ধতি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার সাথে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে।
শিক্ষা সংস্কারে তার যুগান্তকারী ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসার যোগ্য। উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষায় জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় জোর দেন। বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও গবেষণার উপর গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা হবে। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট মর্যাদাবান করতে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হবে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে সংস্কার করে জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, আইটি ও ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করে মাদ্রাসা শিক্ষিতরা যাতে উৎপাদনশীল কাজ, চাকরি ও উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা নিতে পারে তার ব্যবস্থা করা। বেগম জিয়ার পরিকল্পনাটি যুগোপযোগী ও সময়ের দাবি। একই দেশে এক বিরাট অংশের ছাত্র-ছাত্রীরা হুজুর হয়ে ধর্মশিক্ষা ও মিলাদ মহফিলের সাথে যুক্ত থাকবে, আর এক অংশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে রাষ্ট্রের সকল কর্মে অবদান রাখবে এ ব্যবস্থা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ ও সেবা করার অধিকার সকলের রয়েছে। বেগম জিয়ার রূপকল্পে শিক্ষা সংস্কার করে গরীবদের জন্যও শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করার ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষা সম্প্রসারণে রাষ্ট্রীয় টিভিতে একটি পৃথক চ্যানেল সৃষ্টি করার ঘোষণা তার উদারতা, সহানুভূতি ও সহমর্মীতা প্রকাশ পেয়েছে।
বেগম জিয়া ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হ্রাস করতে চান। প্রেসিডেন্ট শুধু কবর জিয়ারত করবেন আর সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত ও অনুমোদিত পথ অনুসরণ করবেন এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কাম্য নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল স্পিরিট সংরক্ষণের জন্য তিনি সংবিধান সংশোধন করে বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ ও আইন সভার কর্মপরিধি ও ক্ষমতা নিশ্চিত করতে আগ্রহী। সুন্দরবনসহ জাতীয় ঐতিহ্য সুরক্ষা, বিদ্যৎ উৎপাদন, জ্বালানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, রেল, নৌ ও স্থলপথের উন্নয়ন, বিনিয়োগ আকর্ষণে ও বেকারত্ব হ্রাসে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ, বেকারত্ব হ্রাস করে বিপথগামী সুবাদের সঠিক পথে আনা তার সরকারের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
বাংলাদেশের সার্বিক অবক্ষয় ব্যাখ্যা করে বেগম জিয়া তা থেকে উত্তরণের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লুটপাট অবলীলায় চলছে। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত। খুন-খারাবি রক্তপাত চলছে প্রতিনিয়ত। বিদেশী নাগরিক ও বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের হত্যা করা হচ্ছে। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না। স্বাধীন সাংবাদিকতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার আজ পুরাপুরি ভূলুণ্ঠিত ও বিপন্ন। দেশ অকার্যকর রাষ্ট্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, গণতন্ত্র আনতে হবে জবাবদিহিতামূলক সরকার আনতে হবে। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমরা কি কেবলই ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করবো? আমরা কি কেবলই একপক্ষ আরেক পক্ষকে হেনস্থা ও ধ্বংস করে দিতে চাইবো? রাজনীতি তো দেশের জন্য, মানুষের জন্য। সেই দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে মানুষের উপর জবরদস্তি শাসন চালিয়ে কী লাভ? এই দূষিত রাজনীতির চক্র থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ বেগম জিয়ার সদিচ্ছা আন্তরিকতা ও মহানুভবতা ও বদান্যতা উপরোক্ত বক্তব্যে প্রতিফলিত। হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিরোধ ও প্রতিহিংয়সার দূষিত রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে জনকল্যাণমূলক ও জনগণের ক্ষমতায়নের রাজনীতি চালু করতে আগ্রহী।
সুশাসন বেগম জিয়ার আর একটি ভিশন। তিনি তার সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সুশাসন নিশ্চিত করতে চান। আইনের শাসন নিশ্চিত করে সকল নাগরিকের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার পাকাপোক্ত করতে চান। কোন ব্যক্তি দেখে নয়, অপরাধীকে অপরাধের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে। এক্ষেত্রে রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, ক্ষমতাশালী ও ক্ষমতাহীন বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য দূর করে সুশাসন নিশ্চিত করা হবে। গডফাদার সৃষ্টির সমস্ত পথ বন্ধ করে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। দলমত নির্বিশেষে নাগরিকদের কর্মকা- বিবেচনায় নিয়ে দেশ পরিচালিত হবে। বিএনপি নেতাকর্মী হলেই সাতখুন মাফ এরূপ অনৈতিক, অমানবিক নীতি পরিত্যাগ করে বিচার পাওয়ার অধিকার সকলের জন্য নিশ্চিত করা হবে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন জাতি আজ বিশৃঙ্খল, বিভক্ত, হতাশ ও দিশেহারা। তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে সর্বক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরায়ে জাতিকে নতুন পথ নির্দেশনা দেয়ার অঙ্গীকার করেন। তিনি বিশৃঙ্খল ও অধিকার হারা জাতিকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মত শৃঙ্খলা ফিরে এনে মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চান। সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ন্যায়পালের পদ ও কার্যালয় সক্রিয় করার অঙ্গীকার করেন।
বেগম জিয়া সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সংস্কৃতি স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসন, আদালত, পুলিশ, বিজিবি ও সামরিক বাহিনীসহ প্রজাতন্ত্রের সকল সেক্টরে সংস্কার করে নতুনভাবে সবকিছু গড়তে চান। গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সুশাসন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতিদমন কমিশন, পিএসসি, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন, ইউজিসি প্রভৃতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আধা-সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি, অনিয়ম ও দলীয়করণমুক্ত করা হবে। ‘রেইনবো নেশন’ তৈরি করে তিনি জনগণকে ‘ওয়ানডে ডেমোক্রেসি’র বদলে সকল সময়ে ক্ষমতাবান করতে চান। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা ও অর্থ বরাদ্দের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা হবে। জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে বেগম জিয়া ধর্ম-বর্ণ, পাহাড়ী-সমতল, নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল অঞ্চলের সকল মানুষের চিন্তা-চেতনা ও আশা আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে একটি অংশীদারিত্বমূলক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার সম্পন্ন, জনকল্যাণমূলক, সহিষ্ণু, শান্তিকামী ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে চান।
দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট সংসদ সৃষ্টি জাতীয় অগ্রগতি ও কল্যাণে সকল শ্রেণী পেশার ও সকল নৃগোষ্ঠীর মানুষকে সম্পৃক্ত করতে চান। দেশের অগ্রসর চিন্তাবিদ বুদ্ধিজীবী, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা ও অঙ্গনে কর্মরত শীর্ষস্থানীয় ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করতে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা হবে তিনি এক নতুন সন্ধি করতে চান। এই সন্ধির শর্তের মধ্যে সরকারী দল ও বিরোধীদলের মধ্যে সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। কেউ কাউকে নিঃশেষ করবে না বরং উভয়পক্ষ পরস্পরের কাছাকাছি এসে একযোগে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য কাজ করবে। সন্ধি করা হবে যাতে সরকারী দল ও বিরোধী দল পরস্পরের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রাখে। এতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন এনে গণতন্ত্রকে কার্যকর ও বিকশিত করা সম্ভব হবে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আর একটি উল্লেখযোগ্য সংশোধনী আনার অঙ্গীকার করেন। গণভোটের বিধান সংবিধানে প্রতিস্থাপন করা হবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন মৌলিক পরিবর্তন আনতে গণভোট অনুষ্ঠানের বিধান রেখে সংবিধান সংশোধন করলে জনগণ তাদের ক্ষমতা ফিরে পাবে।
তার রূপকল্পে বেগম জিয়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি সর্বগ্রহণযোগ্য পদ্ধতি উদ্ভাবনে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশ-বিদেশের মানুষের আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারলে রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান হয়ে দেশে স্থায়ী-শান্তি-শৃঙ্খলা বিরাজ করবে ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন সরকার গঠন ও বদলে জনগণের সম্মতি আবশ্যক। নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেললে সরকার বদলের বৈধ ও শান্তিপূর্ণ পথ খোলা থাকে না। সেক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ ও অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্থ হয় ও শক্তিপ্রয়োগে বিশ্বাসী, উগ্রবাদী ও চরমপন্থী শক্তির উত্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে।
আমরা বেগম জিয়ার ভিশন-২০৩০ রূপকল্পকে অভিনন্দন ও স্বগত জানাই। তিনি দেশ, জাতি, রাজনীতিক, রাজনৈতিক কর্মী সমর্থক ও দেশের মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করতে চান। রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি শৃঙ্খলা বিরাজ করার সাথে মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষা পাবে ও দেশের উন্নতি অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো শাণিত ও টেকসই হবে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী, বলবান ও বিকশিত হবে। বেগম জিয়ার নতুন সামাজিক চুক্তি রাজনীতিক ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মীতা ও স্থায়ী বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেশ পরিচালিত হলে দেশের মান মর্যাদা বৃদ্ধির সাথে নাগরিকরা তাদের অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পাবে। বাংলাদেশের মানুষ যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবার স্বপ্ন দেখছে তা বাস্তবায়ন করতে গেলে আমাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই। পারস্পরিক অবিশ্বাস, সংশয়, সন্দেহ পরিহার করে জাতীর বৃহত্তর প্রয়োজনে রাজনীতিকদের এক টেবিলে বসতেই হবে। দেশের জ্ঞানী, গুনী সুধীসমাজকে সাথে নিয়ে সকল রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা আলোচনার টেবিলে বসলে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য সমাধান বেরিয়ে আসতে বাধ্য। আবশ্যক হলো সদিচ্ছা ও জনগণের সার্বিক কল্যাণ ভাবনা। খোলা মন ও খোলা চোখ দিয়ে সমস্যা শনাক্তকরণ করে আমরা সকল অংশীকে অনতিবিলম্বে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানাচ্ছি। বিএনপির কাউন্সিলে বেগম জিয়া যে ভিশন-২০৩০ প্রকাশ করেছেন তা জনমনে বিশাল প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছে। রাজনীতিকরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে দেশের সমস্যা-সংকট-দূরীভূত হয়ে দেশের সকল সেক্টরে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করবে।
আমরা প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর এমাজউদ্দীন আহমদের প্রত্যাশা ও আহবান উদ্ধৃত করে লেখাটির পরাসমাপ্তি ঘটাতে চাই। তিনি বলেন, “জাতীয় ঐক্যের কাঠামোয় মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা সর্বজনগ্রাহ্য। পত্র-পত্রিকার মুখ ও সাংবাদিকের চোখ কান খোলা থাকবে। গণতন্ত্র এভাবে পথ চলে। চলে সমগ্র জনসমষ্টি একসাথে। নির্বাক হয়ে নয়, বরং মুখর হয়ে। ভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর বহুবাচনিক গণতান্ত্রিক সমাজের রূপই এমন। প্রত্যেকে কথা বলবে। প্রত্যেকের থাকবে সুপারিশ করার অধিকার। প্রত্যেকের থাকবে বিরোধিতার অধিকারও। রাজনীতি সচেতন জনসমষ্টির কাছে সমাজের এই রূপ সুস্পষ্ট হলে সমাজে জন্ম লাভ করবে সহনশীলতা, আপোষকামী মনোভাব এবং সবাইকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আকাক্সক্ষা। শত দল ও হাজারো পথের ঊর্ধ্বে উঠে সবাই শিখবে পথ চলতে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিরোধিতার সংকৃত হবে ঐক্য মিলনের সুর। রাজনৈতিক সৃষ্টির মান হবে উন্নত। গণতন্ত্র হবে স্থিতিশীল” (সূত্র : নয়া দিগন্ত ২০ মার্চ ২০১৬)। বাংলাদেশে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার নতুন রাজনীতি চালু হতে আর দেরি নেই। যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলছে, এর অবসান হতেই হবে। আমরা অল্পদিনেই দেখতে পাবো বহুত্বের মাঝে ঐক্য। বেগম জিয়ার আকাক্সক্ষা, প্রত্যাশা ও আহবানও সেই লক্ষ্যে।
য় লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন