এম মাফতুন আহম্মেদ
এই সোনার বাংলার মজলুম মানুষ একদিন সোনালি স্বপ্ন দেখেছিল। তারা চেয়েছিল সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিমুক্ত, শোষণমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে। যে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যিকার আইনের শাসন; প্রকৃত গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার। তারা বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল সাম্য, শান্তি আর মুক্তির একরাশ বাণী। বাংলার মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিল যে, স্বাধীন দেশে থাকবে না বিশেষ শ্রেণির অবাধ ভোগবিলাসের সুবিধা। সমাজে মানুষের বাঁচার অধিকারকে সম্মান দেয়া হবে। সেখানে থাকবে না আকাশচুম্বী ভোগসম্ভারের ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব কোথায় হারিয়ে গেল? কোথায় আজ এক পরশ শান্তি, কোথায় গেল গণতন্ত্র, সাম্য আর অধিকার?
সব আশা ভেস্তে গেল। যা হওয়ার তাই হলো। শাসক পরিবর্তন হয়েছে, নীতির পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য! জাতির মন-মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। হ্যাঁ পরিবর্তন যে হয়নি তা নয়, যেখানে পাকিস্তান আমলে শিল্পপতি ছিল ২২ পরিবার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে এক প্রশ্নোত্তরে বলেছেন, স্বাধীন দেশে ১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ জন হয়েছে শিল্পপতি পরিবার। এরা এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। আবার স্বাধীনতার নামে একটি মহল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ঘুষ-দুর্নীতিকে লালন করছে। বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে। পশ্চাদপদতা তাদের গ্রাস করে ফেলেছে। সুদ-ঘুষ নানা দুর্নীতি আমাদের সব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। আজকে যে অফিসে যান না কেন শুধু ঘুষের ছড়াছড়ি।
আগেও ছিল ঘুষ। তবে শুনলে আঁতকে উঠত অনেক মানুষ। অনেকে নাউজুবিল্লাহ বলতেন। আর এখন! ঘুষ ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ রূপ পেয়েছে। এ নিয়ে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঘরে-বাইরে ‘কমিশন বাণিজ্য’। ‘কমিশন’ ইংরেজি শব্দ। বাংলায় অর্থ করলে আসে অন্যায় কাজ সম্পাদন করা। এক কথায় দালালি বাবদ প্রাপ্য অর্থকে বোঝানো হয়েছে। হালে যুক্ত হয়েছে কমিশন বাণিজ্যের সঙ্গে নতুন করে ‘রেট বাণিজ্য’। ‘রেট’ ইংরেজি শব্দ। বাংলায় অর্থ করলে আসে নির্দিষ্ট মূল্য, পরিমাণ, হার প্রভৃতি শব্দ। সুদ-ঘুষের কোনো রেট নেই। নির্ধারিত কোনো হার বা পরিমাপ নেই। যার কাছ থেকে যে যা ফন্দি-ফিকির করে নিতে পারে।
পেশাগত জীবনে তৃণমূল পর্যায়ে নানা অফিসে ঘুরেছি। কাছে থেকে দেখা তৃণমূলের কয়েকটি অফিসের ঘুষের রেট এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। দেখেছি ফরেস্ট অফিসে নির্বিবাদে বন উজাড়ে এক এক খাতে ছিল ঘুষের ভিন্ন ভিন্ন রেট। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমির দলিল রেজিস্ট্রির নামে কাজ বুঝে ঘুষের রেট। ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসে ঠা-া মাথায় ঘুষের রকমফের রেট, শিক্ষা অফিসের রেট, মেডিকেলে ভর্তি হতে, এক এক কলেজে এক এক রেট, কোচিং বাণিজ্যে ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন রেট। প্রশাসন, কাস্টমস বা বিভিন্ন সার্ভিস খাতে ঘুষ লেনদেন এখন ওপেন সিক্রেট। পুলিশি বাণিজ্য নিয়ে আজকে পত্র-পত্রিকায় এন্তার অভিযোগ উঠেছে। অথচ এক সময় থানা পুলিশের ঘুষের কোনো রেট ছিল না। সত্যিকারে তখন পুলিশ ছিল আইনের রক্ষক। মন চাইলে পুলিশকে কেউ সন্তুষ্ট করতেন। এ ব্যাপারে ছিল না তাদের কোনো পীড়াপীড়ি। ছিল না কোনো জোরজবরদস্তি আচরণ। আর এখন! একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পুলিশের বিরুদ্ধে ৫৬ খাতে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ প্রকাশ পেয়েছে।’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)
আজকাল ঘুষ সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পেয়েছে। এখন ঘুষের নানা শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটেছে। অফিস-আদালতে নানা নামে শিকড় গেড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো ঘুষের বিকল্প রেট বাণিজ্য কী? দেখুন ঘুষকে কেন্দ্র করে এবার রেট বাণিজ্যের অবৈধ রকমফের কিছু খতিয়ান।
একবার আদালত আঙ্গিনায় এক পেশকারের ঘুষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পেশকার মুখ ফসকে বলে ফেললেন এখানকার রেটের থেকে জেলা সদর আদালতের রেট অনেক বেশি। আমি উৎসুক হলাম। প্রশ্ন করলাম, রেট আবার কী? তিনি বললেন, কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক কিছু টাকা। তার মানে রকমফের কাজ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ঘুষের তালিকাবদ্ধ অবৈধ টাকা। নি¤œ আদালতে একটি মামলা ফাইলিং রেট, নোটিশ জারি রেট, ওয়ারেন্ট তামিল রেট, নকল সরবরাহ রেট, বিভিন্ন খাতের নানা রেট। তবে সবই অলিখিত।
পুলিশ নিয়ে যতকথা। তাদের ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ে যত আলোচনা। অথচ এই থানা পুলিশ ছিল একদিন সত্যিকারের জনগণের মানবাধিকার রক্ষক। ছিল না টাকাকড়ি নিয়ে তাদের কোনো চাহিদা। আর এখন! সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে ৫৬ খাতে ঘুষ নেবার অভিযোগ উঠেছে। এক এক মামলার এজাহার বাবদ রেট, চার্জশিট বাবদ রেট, মামলার ফাইনাল বাবদ রেট, চার্জশিটে বা এজাহারে নাম জড়িয়ে দেয়ার রেট, বিরোধী নেতা-কর্মীদের হয়রানি মামলায় জড়িয়ে দেয়ার রেট, তৈল খরচের রেট, মামলা তদন্তের নামে রেট, জিডি বাবদ, ভয়ভীতির হাত থেকে বাঁচার রেট, ক্রসফায়ারের হাত থেকে রক্ষার রেট, সাক্ষীর রেট আরও অজানা পাতায় পাতায় কত রেট। পুলিশের এসব রেটের কারণে মানবাধিকার ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। ন্যায়বিচার থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি জনগণ ক্রমশ আস্থা হারিয়ে ফেলছে।
একটি জমির রেজিস্ট্রি বাবদ ঘুষের রেট ভিন্ন ভিন্ন রকম। রেজিস্ট্রি অফিসের নিয়ন্ত্রণে তৈরি হয়েছে মোহরা সমিতি। অনেকে বলেন গলাকাটা সমিতি। শুনেছি প্রত্যেক সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষের একটি রেটের লিখিত ফর্দ করা আছে। সেটা কোনো দফতরে নয়, সংশ্লিষ্ট মোহরারদের কাছে সংরক্ষিত থাকে। একজন মোহরার একটি দলিল পেলে ঘুষের রেটের কোনো শেষ নেই। সমিতির নামে হরিলুট করেন। একটি দলিল পেলে সবাই মিলে ভাগা খান। তৃণমূল পর্যায়ে ঘুষের এই রেট বাণিজ্য বহু পূর্বে থেকে চলে আসছে। ভূমি রেজিস্ট্রির নামে জনগণকে বেকায়দায় ফেলে ঘুষের একরাশ ফর্দ করে জনগণকে সর্বস্বান্ত করে আসছে।
প্রকৌশলী অফিসে কাজের বিনিময়ে বিল করে দেয়ার নামে রেট। বড়-ছোট সাহেবের নামে রেট, অফিস সহকারীদের নামে রেট, ফিল্ড ইঞ্জিনিয়ারদের নামে রেট, বড় কাজ পাইয়ে দেয়ার নামে রেট, সিন্ডিকেটের নামে রেট, দুই নম্বর কাজের বিনিময়ে বিল করে দেয়ার নামে রেট। আরও অনেক খাতের রেট। এখানে রেট বাণিজ্য খুব একটা ওপেন সিক্রেট নয়। সর্বসাধারণের সঙ্গে এ অফিসের তেমন একটা সম্পৃক্ততা না থাকায় শুধু ঠিকাদারদের নিয়ে চলে ঘুষ বাণিজ্য, রেট বাণিজ্য। তবে বড় সাহেবদের কলমের মাথার ওপর চলে নীরবে এই রেট বাণিজ্য।
সুন্দরবন ধ্বংসে বন বিভাগের দুর্নীতি নজিরবিহীন। গোলপাতা কাটা মৌসুমে ঘুষের রেট, গোরানসহ নানা প্রজাতির কাঠের ঘুষের রেট, মাছ আরোহণের ঘুষের রেট, সুন্দরবনে প্রবেশের রেট, বেআইনি গাছ ও গোলপাতা কাটার রেট, হরিণ শিকারের রেট, মধু আরোহণের রেট। আরও আছে প্রকারভেদে অবৈধ নানা বাণিজ্যের রেট। এসব নজিরবিহীন দুর্নীতির কারণে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রাকৃতিক বৃক্ষ সম্পদের ওপর বেঁচে আছে উপকূলীয় জনপদের কোটি কোটি জনগণ। অথচ এই বিভাগের অপ্রতিরোধ্য ঘুষের রেটের কারণে জনগণের আজ নাভিশ্বাস উঠেছে। সুন্দরবন ধ্বংস হতে চলেছে।
শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন প্রাপ্তি, এমপিওভুক্তিকরণ, শিক্ষকের পেনশন তোলা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে ঘুষের কোনো বিকল্প নেই। এ অফিসে এক সময় ঘুষ বাণিজ্য, রেট বাণিজ্য ছিল এক অকল্পনীয় ব্যাপার। নিয়োগ বাণিজ্যে কোনো রেট নেই। কারণ এখানে সরকারি দলের রাঘববোয়াল বা প্রশাসনের একটি অংশের এত ভিড় যে, একজন শিক্ষক নিয়োগে এখন লাখ টাকা নয় নেপথ্যে চলে লাখ লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্য। বদলি বাণিজ্যে রেট। একাধিক নিয়মকে অনিয়ম করতে রয়েছে নানা রেট। সাধারণ শিক্ষকরা প্রকৃত অর্থে বোবা। তাদের প্রতিবাদ করার কিছু নেই। কলমের মারপ্যাঁচে তারা অসহায়।
হিসাবরক্ষণ অফিসে রয়েছে অপ্রতিরোধ্য ঘুষ বাণিজ্য। ঘুষের অনেক খাত। এসব খাতের একটি রেট আছে। রেট অনুযায়ী ঘুষের টাকা দিলে সব হজম। রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য করতে এদের কোন বাধা নেই। জনগণ তাদের কাছে এক প্রকার অসহায়, জিম্মি।
বিদ্যুৎ অফিসেও ঘুষের টাকা জমা দিতে হয়। এ টাকা রেট অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন টেবিলে চলে যায়। অর্থাৎ একটি কাজ সম্পাদন করতে গেলে অনেক খাতে টাকা দেয়া লাগে। সে জন্য একবারে সব টাকা নেয়া হয়। এখানে ঘুষের নানা খাত রয়েছে। প্রত্যেক খাতে রেট রয়েছে। মিটার রেট, সংযোগ রেট, সংযোগ স্থানান্তিত রেট, ট্রান্সফরমার লোড বৃদ্ধির রেট, তদন্ত প্রতিবেদনের নামে রেট, লাইন সংযোগের নামে রেট। আরও অসংখ্য খাতের রেট। এখানে বড় ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে আতি-পাতি সবাই রেট অনুযায়ী ঘুষের টাকার ভাগ পেয়ে থাকে।
যারা কমিশন বাণিজ্য, ঘুষ বাণিজ্য, রেট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত তারা সমাজের দুর্জন। তারা এক কথায় ঘুষখোর, সুদখোর। তারা দেশের শত্রু, জাতির শত্রু। এক কথায় ঘৃণিত। এই ঘুষ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য, রেট বাণিজ্য, সুদ বাণিজ্য আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর প্রতিবন্ধক’। আমলাতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দুর্নীতির রাশ টেনে ধরতে পারলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ নয়, ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যেত। অথচ এই লাগামহীন দুর্নীতি আমাদের অগ্রগতি এবং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ম্লান করছে। ঘুষ-দুর্নীতি, নানা অনিয়মকে আজ ‘না’ বলতে হবে।
য় লেখক : আইনজীবী ও খুলনা থেকে প্রকাশিত আজাদ বার্তা’র সম্পাদক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন