শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

নাব্য হারাচ্ছে কুমিল্লার নদ-নদী

গোমতীর শাখা নদীগুলো এখন সঙ্কীর্ণ খাল

মুন্সী কামাল আতাতুর্ক মিসেল চান্দিনা থেকে | প্রকাশের সময় : ২২ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

কুমিল্লার গোমতী ও শাখা নদীগুলোতে নাব্য সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এসব নদ-নদী এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। নদীগুলোর কোনটিতে রয়েছে হাঁটু পানি আবার কোনটিতে জেগে উঠেছে বিস্তীর্ণ বালুচর। নদীর বুকে চলছে চাষাবাদও। ফলে দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে সেচকার্য। পাশাপাশি এসব নদ-নদীতে চলছে দখলের প্রতিযোগিতা।
মরে যাচ্ছে কুমিল্লার নদী। উৎমুখে গতিরোধ, দখল করে স্থাপনা নির্মাণ, অবৈধ বনায়ন, অপরিকল্পিত ব্রিজ, মাটি কাটাও বালু উত্তোলন চলছে কোন নিয়ম ছাড়াই। এদিকে যেমন নদী দখল হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে পানির গতিপথ বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। বিপদজনক হয়ে পড়ছে নদীর বাঁধ। বহুস্থানে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বন্যার অশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।
জানা যায়, এক সময় দেশের অন্যতম মৎস্য আহোরণের ভান্ডার ছিল এ গোমতী। গোমতীকে ঘিরে নদীপথে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের পাশাপাশি গোমতী তীরের জেলে ছাড়াও স্বল্প আয় সম্পন্ন লোকজন নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত, তাদের অধিকাংশ এখন অন্য পেশায় নিয়োজিত, কেউবা বেকার। সুদীর্ঘকাল ধরে গোমতী খনন না করায় শুধু বর্ষাকালে ২/৩ সপ্তাহ পানি প্রবাহ বেশি থাকলেও বছরের অধিকাংশ সময়ই পানি প্রবাহ কম থাকে। কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলিক বিভাগের তথ্যানুয়ায়ী, জানুয়ারি মাসে গোমতীতে ‘ওয়াটার রিডিং’ স্কেলে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন পানি প্রবাহের হার ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৩৪ মি.মি. এবং ৭ দশমিক ০৫ মি.মি.। অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে পাউবো গোমতী খনন না করলেও ফি-বছর গোমতী বাঁধ মেরামতের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। বাঁধ রক্ষা ও তদারকিতে তাদের ভ‚মিকা নিয়েও এখন জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
গোমতীর প্রায় ৭০ কি.মি. প্রবাহ পথে জেলা সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবিদ্বার, মুরাদনগর, তিতাস এবং দাউদকান্দি উপজেলার একাংশ এলাকায় গোমতী থেকে পানি উত্তোলনের মাধ্যমে ইরি-বোরোসহ বিভিন্ন সেচ কাজে পানি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গোমতী বাঁধে ইনলেক্ট স্ট্রাকচারের মাধ্যমে পানি উভয় তীরের জমিতে নিয়ে কম খরচে সেচ দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে নদীর ভারতের অংশে কয়েকটি স্থানে সেচ প্রকল্পে অধিক পানি ব্যবহারের কারণে পানি প্রবাহ হ্রাস পেয়ে নদীগুলো নাব্য সঙ্কটে পড়েছে। অধিকাংশ স্থানেই এখন হাঁটু পানি, জেগে উঠেছে অসংখ্য বালু চর। নদীতে অতিরিক্ত পাইপ ফেলেও সেচ কাজে পানি উত্তোলন করতে গিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন মেশিন মালিকরা। কুমিল্লায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য বেশ ক’টি নদী ও খাল। এখানে প্রধান নদী গোমতী। ডাকাতিয়া ও কাঁকড়ী নামে আরো দু’টি রয়েছে। ডাকাতিয়া একটি, অন্যটি পুরাতন। খাল গুলো হচ্ছে, গঙ্গাইজুড়ী, ঘুংঘুর ও সোনাইছড়ি। গভীর নলকূপের পাশপাশি নদী খালের পানি দিয়ে একসময় এ জেলায় সেচ কাজ চলতো। ডঃ আখতার হামিদ খানের উদ্যোগে সোনাইছড়ি খাল এবং প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে কাটা কোদালিয়া খাল দক্ষিণ কুমিল্লার কৃষিতে বিপ্লব এনেছিল। এর বাইরে নাম না জানা অনেকে খালের পানি সেচ কার্যে ব্যবহার হতো। আজ এগুলোর কোন কোনটি মৃতপ্রায়, কোনটি বা হারিয়ে গেছে অব্যবস্থাপনার কারণে। এছাড়া নদীও খালের দু’পাড়ে বসতি গড়ে উঠায় ও যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় নদী কেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দাউদকান্দির মেঘনা নদীর কুমিল্লা অঙ্ক শুকিয়ে যাওয়ার এবং অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠায় সম্ভবনাময় এই অঙ্কটির ব্যবসা-বাণিজ্যও দিন দিন কমে যাচ্ছে।
জেলার প্রধান নদী গোমতী। এদেশের প্রবেশ মুখে উজানোর অংশে ভারত সরকার পাম্প হউজ নির্মাণের মাধ্যমে শুঙ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধার সেচ সুবিধার জন্যে ত্রিপুরার পাহাড়ি অঞ্চলে পানি সরিয়ে নেয়। এতে নদীর পানি প্রবাহ একেবারেই কমে যায়। চলতি বছর যে কারণে নদীটি প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। ফলে গোমতী অববাহিকায় সেচ কার্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। গোমতী, ডাকাতিয়া, কাঁকড়ী নদীর উপর সরকার বেশ ক’টি ব্রিজ নির্মাণ করেছে। ব্রিজ নির্মাণে সড়ক ও জনপথ বিভাগ দায়িত্ব পালন করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডেও মতামত নেয়া হয়নি। নদী বিষয়ে অনভিজ্ঞতার কারণে নদীর স্বাভাবিক গতিপথে তারা বাধার সৃষ্টি করে। এতে পলি জমে নদীর নাব্য নষ্ট হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন প্রকৌশলী জানান, জেলার তিনটি নদীর যে প্রশস্থতা তাতে কোন গার্ডার ছাড়াই ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব হতো। এতে পানি প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হতো না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতামত নিয়ে ব্রিজ নির্মাণ করলে নদীতে পলি জমত না। বেইলী সেতুর পিলার অপরিকল্পিত ভাবে নির্মাণ করায় সেখানে নদীর নাব্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। এর বাইরে তিনি আরো বলেন, পালপাড়া বেইলী ব্রিজটি দৈর্ঘ্য কমাতে নদী ভরাট করা হয়। এদিকে চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার এলাকায় কাঁকড়ী নদীর উপর ঢাকা-চট্রগ্রাম সড়কের ব্রিজটিও নদীকে ছোট করে নির্মাণ করা হয়। ফলে পানির প্রবল চাপে ব্রিজটি ভেঙে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডেও মতামত না নিয়ে কাজ করলে ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা বাঁধ হুমকীর সম্মুখীন হতে পারে।
গোমতী বাঁধের ভিতরে বনায়ন চলছে অপরিকল্পিতভাবে। গোমতী ছাড়াও কাঁকড়ী, ডাকাতিয়া অববাহিকায়ও অনেক ফলদ ও বনজ বৃক্ষ রোপন করে বাগান সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্ষাকালে পানির প্রবল স্রোত এ সকল গাছপালায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে চাপ সৃষ্টি করে। এতে বাঁধ ভাঙ্গার উপক্রম হয়। কুমিল্লা সদর উপজেলার চাঁনপুর ও ছত্রখীলে বেশ ক’টি বাগান রয়েছে। সেখানের গাছগুলো বেশ বড় বড়। বর্ষাকালে পানি প্রবাহ বেড়ে গেলে এ সকল বাগান বাধার সৃষ্টি করে। গোমতীর বহু জায়গাই দখল হয়েছে। পাউবি কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে বহুবার দখলদারদের নোটিশও করা হয়েছে কিন্তু প্রভাবশালীদের উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে দায়ী করেন নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবি সূত্র। সূত্র মতে গোমতীর ৩০ দশমিক৩ কিলেমিটার অংশে জেলার ব্রাক্ষণপাড়ার মনোহরপুর এলাকায় এ রকম বেশ ক’টি বাড়ি রয়েছে। এছাড়া কুমিল্লার গোমতী অংশের দু’তীরে ৩ শতাধিক, নতুন ডাকাতিয়ায় ৫০টিরও বেশি এবং কাঁকড়ী নদীতে ৬০ টিরও বেশী অবৈধ স্থপনা রয়েছে। অর্থাৎ নদীগুলোর অবৈধ স্থাপনা রয়েছে ৪০০টিরও বেশী। আস্তে আস্তে গাছপালা, মাটির ঘর, আধা-পাকা ঘর ও সর্বশেষ পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। নদী দখল করে বাড়ি, গতিপথে প্রতিবন্ধতা, অবৈধ উপায়ে মাটি কাটা, বালু উত্তোলণ ইত্যাদির মাধ্যমে নদী গুলোর দুরাবস্থার বিষয়ে ভূমি আইন অ্যাডভোকেট আনোয়ার সাহেব বলেন, নদী তীর দখল, মাটি কাটা, বাগান সৃজনের নামে জায়গা দখল, বালু উত্তোলন, বাঁধের উপর দিয়ে যানবাহন চলাচল প্রভৃতি বিষয়গুলো পৃথক পৃথক বিভাগ বা মন্ত্রণালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় বলে সমন্বয়হীনতার কারণে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যেহেতু নদীগুলো নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেহেতু নদী সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াদী নৌ-মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলে সমন্বয়হীনতা হত না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যাও থাকতনা। তারা এককভাবে উদ্যোগ নিলেই দখল, অবৈধভাবে মাটি কাটা, বালু উত্তোলন ইত্যাদি প্রতিরোধ সম্ভব হত। আইনী জটিলতায় পড়ার সম্ভবনা কম থাকত।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Md. Emdadul Haque Badsha ২২ মার্চ, ২০১৮, ৪:৫৬ এএম says : 0
নদীর নাব্য হারাচ্ছে কথাটি সঠিক নয়। শুদ্ধ হবে নদীর নাব্যতা হারাচ্ছে। ইনকিলাবের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনশীল পত্রিকা বার বার একই ভুল রিপোর্ট করে দেখে কষ্ট পাই। নাব্য অর্থ Navigable আর -Navigable হলে তো নদীর সমস্যা থাকেনা । নাব্যতা হচ্ছে Navigability তাই আঃ ভুলটি আর না লেখলে ভাল হয়।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন