শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

মশা উৎপাদনের সূতিকাগার বুড়িগঙ্গা

কচুরিপানা ময়লা-আবর্জনা আর দখলের কবলে ঢাকার জলাশয়-৭

সায়ীদ আবদুল মালিক | প্রকাশের সময় : ৩০ মার্চ, ২০১৮, ১২:০০ এএম

ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নিজেই এখন প্রাণশূন্য। দিন দিন দখল আর দূষণের কবলে পড়ে এটি মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীর জায়গা দখল করে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গড়ে উঠছে স্থাপনা। দুই পাড় দিয়েই কমেছে নদীর প্রশস্ততা, নেই তার প্রাণপ্রবাহ। প্রতি মুহূর্তে নদীর ভেতর ফেলা হচ্ছে পানিদূষণকারী ময়লা-আবর্জনা ও বিভিন্ন ধরণের তরল, কঠিনসব ভয়ংকর বর্জ্য। বুড়িগঙ্গার পানিতে এখন নেই জলজ প্রাণী বা মাছের কোন অস্তিত্ব। এ নদীর পানি বহু আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গেছে। এমনকি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সুস্থ্যভাবে শ্বাস নেওয়াও নিরাপদ নয়। ময়লা-আবর্জনা আর পচা পানির দুর্গন্ধে আশপাশে টেকাই দায়। এ সমস্ত ময়লা আবর্জনা আর পচা পানিতে জন্মনিচ্ছে মশা। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বুড়িগঙ্গার এসব প্রজনন স্থলে মশা নিধনে নেই কোনো উদ্যোগ। যে কারণে বুড়িগঙ্গা এখন মশার আদর্শ প্রজননস্থলে পরিণত হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গায় প্রজনন হওয়া মশা সারা শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এ মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ এখন রাজধানীবাসী।
হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কালুনগর খালটি কামরাঙ্গীরচর ও হাজারীবাগ এলাকার ব্যবহৃত পানি ও বর্ষার পানি বুড়িগঙ্গা নদীতে যাওয়ার অন্যতম পথ। কিছুদিন আগে কিছু সংখ্যক ভূমিদস্যু খালটি অবৈধভাবে দখল করে বাড়ি ঘর তৈরি করে। এতে খালের স্বাভাবিক গতিরোধসহ অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। বর্ষা মৌসুমের পানি নদীতে না যওয়ার ফলে পুরা এলাকায় পানিবদ্ধার সৃষ্টি হয়। পরিবেশও মারাত্বকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ সংলগ্ন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কলেজের সামনে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়ে বিশাল মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
বুড়িগঙ্গার পানি ও ময়লা আবর্জন মিশেমিশে একাকার অবস্থ। ময়লা-আবর্জনা পচে পানি দুর্গন্ধময় হয়ে গেছে। পানিতে ভাসছে ময়লা-আবর্জনা আর বিভিন্ন স্থানে জড়ো করে রাখা হয়েছে ময়লার স্তূপ। এ সমস্ত ময়লায় জন্ম নেয়া মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ বুড়িগঙ্গার দুই পাশের এলাকার কোটি মানুষ। চাঁদনিঘাট এলাকার বাসিন্দা খন্দকার মমিনুল ইসলাম বলেন, বুড়িগঙ্গার পচা পানিতে জন্ম নেয়া মশার যন্ত্রণায় আমরা অস্থির। এ নদীটা যেন এখন ঢাকা শহরের মশা উৎপাদনের সুতিকাগার হয়ে গেছে। এই মশা নিধনের সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কোন উদ্যোগ আমরা এখনো দেখিনি। এনিয়ে তাদের যেন কোন মাথা ব্যথা নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. শেখ সালাহউদ্দীন ইনকিলাবকে বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় এখন মশা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। পত্র পত্রিকায় কিংবা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যেভাবে মশা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে সে রকম মশা এখন আর নেই। তিনি বলেন, আমরা অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর মশা নিধনের কার্যক্রম বড়িয়ে দিয়েছ। এবং মশার ওষুধও অন্যবারের তুলনায় বেশি সংগ্রহে রেখেছি। মশা নিধনের কাজে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সবসময় সচেষ্ট রয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবা সরেজমিন গিয়ে, রাজধানীর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ধরে সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালের সামনে গিয়েই পড়তে হয়েছে উৎকট দুর্গন্ধের মুখে। নদীর কাছাকাছি যতই যাই, দুর্গন্ধও বাড়তে থাকে। টার্মিনালের সামনে সারিবদ্ধ নৌযানের ফাঁকে নদীর পানির যতটুকু চোখে পড়ে, তা মিশমিশে কালো। টার্মিনালের পাশজুড়ে আবর্জনার স্তূপ। ঘাটে ভিড়ে থাকা নৌযানগুলো থেকে মাঝেমধ্যেই ফেলা হচ্ছে খাবারের পরিত্যক্ত মোড়ক, ফলের খোসা, বোতলসহ নানা বর্জ্য।
সদরঘাটের এই পরিচিত চিত্রের পাশাপাশি এখানকার মানুষ অভ্যস্ত নদীর এই দুর্গন্ধের সঙ্গে। ওই খানে কথায় ডিঙি নৌকার মাঝি সোহরাব হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ময়লা-আবর্জনা আর বড়িগঙ্গার পচা পানিতে জন্ম নেয়া মশার যন্ত্রণায় দিনে রাতে ২৪ ঘণ্টাই আমরা অতিষ্ঠ।
এক সময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গাকে জানতে ও দেখতে গতকাল বৃহস্পতিবার নদীটির মোহাম্মাদপুরের বছিলাঘাট থেকে সদরঘাট হয়ে পোস্তগোলা পর্যন্ত কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায়, কেবল দখল আর দূষণের চিত্র। নদীর দক্ষিণ পারের আটি, খোলামোড়া থেকে শুরু করে জিনজিরা, কালীগঞ্জ হয়ে পারগেন্ডারিয়া, হাসনাবাদ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকার বুড়িগঙ্গা দখল করে শত শত পাকা স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এভাবে দখলের পাশাপাশি আগানগর থেকে শুরু করে হাসনাবাদ পর্যন্ত একাধিক বালুমহাল দেখা গেছে। নদীর তীরে বালুমহাল হওয়ায় বাল্কহেড (বালুবাহী জাহাজ) থেকে বালু খালাস করার সময় নদী ভরাট হচ্ছে। এসব ভরাট জায়গায় পরে গড়ে উঠছে দোকানপাট, মার্কেট।
সদরঘাট পেরিয়ে পোস্তগোলা এলাকায় নদীর পাড়ে ইট রাখা হয়েছে স্তূপ করে। আর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশনের অগণিত পাইপ এসে পড়েছে বুড়িগঙ্গার বুকে। এই লাইনগুলো বেশির ভাগই নদীর আশপাশের শিল্প কারখানার। আবাসিক ঘরবাড়ির পয়োনিষ্কাশনের বোঝাও বইতে হচ্ছে বুড়িগঙ্গাকে। তবে কেবল ব্যক্তি নয়, ঢাকা ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যরে লাইন-পাইপ পড়েছে নদীর বুকে। এ ছাড়া কয়েকটি স্থানে মাটি ফেলে ব্যক্তি উদ্যোগে নদী ভরাট করা হয়েছে। নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে টংঘর। রয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও।
পচা ও দূষিত পানির বুড়িগঙ্গায় এখন আর মাছ নেই। তাই চোখে পড়েনি মাছ ধরার নৌকা। তবে ভেসে থাকতে দেখা গেছে ফুলে-ফেঁপে ওঠা মরা গরু-মহিষ আর কুকুর। সঙ্গে দুর্গন্ধময় বাতাস তো আছেই।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, বুড়িগঙ্গা দূষণের প্রধান কারণই ছিল কয়েক দশক ধরে প্রকাশ্যে দেড়শরও অধিক ট্যানারি কারখানার সব রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা। এর বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের বহু বছরের রাজপথের আন্দোলন, জনসাধারণের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, আদালতের নির্দেশ- কোনোটিকেই মালিকপক্ষ আমলে নেয়নি। চামড়া শিল্প জাতীয় রাজস্ব আয়ের একটি বড় খাত হওয়ায় সরকারগুলোও তাদের বিরুদ্ধে রাতারাতি ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
বাপার দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, বর্জ্যরে কারণেই বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষিত হচ্ছে, দখলে সংকুচিত হচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমে গেছে। বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি ধলেশ্বরী নদী থেকে। দখলের মাত্রা এতই বেশি যে, ধলেশ্বরী-বুড়িগঙ্গার সংযোগস্থল এখন খালে পরিণত হয়েছে। তাই ধলেশ্বরীর পানি ঢোকে না এই নদীতে। এদিকে তুরাগের সঙ্গে যুক্ত থাকায় বুড়িগঙ্গায় এখনো পানি আছে। তবে তুরাগেও বইছে দূষিত পানি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন