গত বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সরকারের ১৩৩টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি করপোরেশনের সাধারণ ওয়ার্ডের নিয়মিত এবং উপনির্বাচন ছিল। এসব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক সংঘর্ষ, গুলি, জাল ভোট, কেন্দ্র দখল করে সিল মারার মতো ঘটনা ঘটে। এতে ১ জন নিহত এবং ২২ জন আহত হয়েছেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, এখন নির্বাচন মানেই সংঘর্ষ এবং কেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দেয়া, ভোট ছাড়া নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ভোট কেন্দ্র দখল, অবাধে সিল মারা, মারামারি, হানাহানি, আহত-নিহত হওয়া নির্বাচনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের এহেন পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখলে বোঝার উপায় থাকে না, দেশে কোনো নির্বাচন কমিশন রয়েছে এবং তার সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার সক্ষমতা আছে। বলা যায়, নির্বাচন কমিশন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালের বিতর্কিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা নির্বাচনসহ যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার অধিকাংশেই সংঘাত, সংঘর্ষ, জাল ভোট, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী কর্তৃক কেন্দ্র দখল করে অবাধে সিল মারা, প্রতিপক্ষের প্রার্থী-সমর্থকদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয়াসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই যা ঘটেনি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন যে রক্তক্ষয়ী রূপ লাভ করেছিল, তা সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেখা যায়নি। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে কোনো নির্বাচন মানেই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দাপট ও সন্ত্রাসীমূলক দৃশ্যপটের আবির্ভাব। বৃহস্পতিবারের নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদেরকে প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন করে কেন্দ্রে অবস্থানের চিত্র পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এসব চিত্র দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভোট ব্যালটে নয়, বুলেটেই যেন নির্বাচন হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ ধরনের নির্বাচন করার কোনো অর্থ হয় না। যে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ন্যূনতম সুযোগ থাকে না বরং সংঘর্ষ, হানাহানি ও আহত-নিহত হওয়ার শঙ্কা থাকে ও বাস্তবে তা ঘটে এবং নির্বাচন কমিশন ও স্থানীয় প্রশাসন তা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয় সে নির্বাচন না করাই ভাল। বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় আগেভাগেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করে দেয়া উত্তম। এতে অন্তত মানুষের জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি হবে না। বর্তমানে যে কোনো নির্বাচনের ঘোষণা দিলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তারা ধরেই নেয়, নির্বাচন মানেই সংঘাত-সংঘর্ষ এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের দাপট, অস্ত্রের মহড়া ও প্রতিপক্ষকে নির্বাচনছাড়া করা। তাদের ভোটাধিকার বলে কিছু থাকবে না এবং নির্বাচনের আগেই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করা হবে। মাঝে মাঝে দুয়েকটি নির্বাচন সুষ্ঠু দেখিয়ে বলা হয় সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। যদিও এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ইচ্ছার চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটে। বাংলাদেশে এ সময়ে নির্বাচন যে শুধু নামমাত্র হয় এবং তা প্রহসনে পরিণত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতাই গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ১৩৩টি স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিভাত হয়েছে। অতীতের মতো এই অল্প সংখ্যক নির্বাচনও যে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নিরঙ্কুশ প্রভাব ছিল, নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে।
জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না এবং ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে না, তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের মেরুদন্ডহীনতা ও অমার্জনীয় ব্যর্থতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। অথচ আমরা দেখেছি বার কাউন্সিল নির্বাচনসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের নির্বাচনগুলো অত্যন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব নির্বাচন থেকেও নির্বাচন কমিশন কোনো ধরনের শিক্ষা নেয় বলে প্রতীয়মাণ হয় না। প্রতিষ্ঠানটি প্রতি পদে পদে তার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এ বছরটি নির্বাচনের বছর। সিটি করপোরেশনের নির্বাচনসহ ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন হবে। তার প্রাক্কালে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের যে দাপট ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়েছে, তাতে আসন্ন নির্বাচনগুলো কতটা সুষ্ঠু হবে, তা নিয়ে এখন থেকেই সংশয় কাজ করা স্বাভাবিক। বিগত স্থানীয় ও অন্যান্য নির্বাচনগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। তারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাস, ব্যালট পেপার ছিনতাই, অবাধে সিলমারার মতো মারাত্মক অপরাধ প্রতিহত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো এর প্রতিবাদে প্রতিপক্ষ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এলে তাদের ওপরই হামলা ও গুলি ছুড়তে দেখা গেছে। নির্বাচন কমিশন এবং স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অন্যায্য কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেয়ার মধ্য দিয়ে এটাই পরিস্কার হচ্ছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনোভাবেই আন্তরিক নয়। তাদের এই আচরণ যদি পরিবর্তন না করা হয়, তবে আগামী নির্বাচনগুলো কেমন হবে, তা বিশদ ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ রাখে না। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সৃষ্ট পরিস্থিতির ব্যাখ্যা-বিবরণ ও তার অবস্থান জনগণের সামনে স্পষ্ট করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন