\ এক \
আরবি সপ্তম মাস রজব। এ মাসেরই ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মহানবী হযরত সা. আল্লাহ তায়ালার বিশেষ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছেন। তিনি এক বিশেষ যানে আরোহণ করে প্রথমত মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে এক হাজার মাইল ব্যবধানে অবস্থিত বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদে উপস্থিত হন। সেখান থেকে ঊর্ধ্বালোকে গমন করে ক্রমান্বয়ে প্রথম আকাশ থেকে সপ্তম আকাশ অতিক্রম করে বায়তুল মামুরে যান। সেখান হতে প্রাণিজগতের শেষসীমা নির্দেশক ‘সিদরাতুল মুনতাহা’য় পৌঁছেন। তথা হতে আরো সম্মুখে অগ্রসর হয়ে জান্নাত-জাহান্নাম প্রভৃতি আল্লাহ তায়ালার অনন্ত মহিমার অতুলনীয় নিদর্শনসমূহ অবলোকন করেন। সমীপবর্তী হন ঐশী করুণার। আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর একান্ত বাণী শ্রবণ করে দিবাগমনের পূর্বেই মর্ত্যরে মাটিতে ফিরে আসেন। একেই ইসলামী পরিভাষায় মেরাজ বলে।
মেরাজ আরবি শব্দ। এর শব্দমূল ‘উরুজ’ অর্থ উত্থান। সাধারণ অর্থে ঊর্ধ্বারোহণ বা সিঁড়ি। ইসলামি পরিভাষায় নবী করীম সা.-এর সশরীরে মক্কা মোয়াজ্জমা হতে বায়তুল মোকাদ্দাস হয়ে আরশে আজিমে দীদারে ইলাহী শেষে পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনকে মেরাজ বলে। এটি একটি অলৌকিক ঘটনার দিকেই ইঙ্গিত প্রদান করে। মেরাজ বিশ্বের ইতিহাসে শুধু ঘটনা নয়; বরং অত্যাশ্চর্য এক বিস্ময়কর ঘটনা। মহানবী সা.-এর মেরাজ হলো প্রকৃত বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ আশ্বস্তকরণের এক দীপ্ত নমুনা।
মহানবী সা. দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে গিয়ে একদিকে যখন লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার তীব্র দাহনে উৎপীড়িত হচ্ছিলেন, অন্যদিকে তার আশ্রয়দাতা আবু তালেব ও জীবনসঙ্গিনী হযরত খাদিজা রা. ইহধাম ত্যাগ করেন। আবার তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গিয়েও তায়েফবাসীর অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে বিফল মনোরথ হন। এ সময় তিনি দারুণ মর্মব্যথায় ভুগেন। এমনি সময়ে মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু হযরত মুহাম্মদ সা.কে নিজ সান্নিধ্যে ডেকে আশ্বাসবাণী দিয়ে সান্ত¡না দেন। কেননা বিপদ মুহূর্তে বন্ধুর সামান্য সাহচর্যদান দুঃখকে হালকা করে দেয়।
মেরাজ প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা.-এর জীবনের একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এটি মূলতঃ একটি মুজিযা। সকল নবীই মুজিযা প্রদর্শন করেছেন। তাতে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের হেদায়াতের নির্দেশ ঘটেছে। এসব কারণেই এই মুজিযাটি প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্র অসীম মান এবং মহাকুদরতের ফল। হযরত মুহাম্মদ সা.-এর পূর্বেকার নবী-রাসূলগণ শুধু অহীর মারফতে অবগত হয়েই আল্লাহর ক্ষমতা, তার আরশ-কুরসি বেহেস্ত-দোযখ ইত্যাদি সম্বন্ধে মানুষকে অবগত করিয়েছিলেন।
মেরাজ মানে আল্লাহর দীদার লাভ করা। এই মেরাজ দু’ভাবে হতে পারে। দৈহিক মেরাজ এবং আত্মিক মেরাজ। একটি হাদিসে নামাজকে মুমিনের মেরাজ বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো- নামাজের মাধ্যমে মুমিনগণ আত্মিকভাবে আল্লাহর দীদার পেয়ে থাকে। সরাসরি দৈহিকভাবে আল্লাহর দীদার লাভ হয় না। আমাদের আলোচ্য মেরাজটি নবীজীর দৈহিক মেরাজ নিয়ে। নামাজ ছাড়াও নবীজীর জীবনে আত্মিক মেরাজ ঘটেছে বহুবার। আত্মিক বা স্বপ্নযোগে আল্লাহর দীদারলাভের প্রসঙ্গটি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এবং আয়েশা রা. থেকে উল্লেখ আছে।
মেরাজ সম্পর্কে পবিত্র কালামামুল্লাহ্ শরীফে সূরা বনি ইসরাঈলের প্রথম আয়াতে বর্ণিত হয়েছে : পবিত্রতম ও সকল দুর্বলতামুক্ত সেই মহিমাময় আল্লাহ, যিনি স্বীয় বান্দাকে রজনীযোগে ভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায়, যার আশেপাশে দ্বীন-দুনিয়ার বহু বরকত দিয়ে রেখেছিলাম, তাকে আমার বিশেষ মহিমা ও নিদর্শনাবলি দেখাবার জন্যে; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
মেরাজ বিষয়ে ৩১ জন সাহাবীর নিকট থেকে বিশদ বিবরণ সম্বলিত ৩২টি বর্ণনা রয়েছে। এই বিশাল সংখ্যক বর্ণনার সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ : রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মহানবী সা. কাবা শরিফের ‘হাতীম’ নামক স্থানে বা অন্য বর্ণনামতে কাবার অতি সন্নিকটে অবস্থিত উম্মে হানীর রা. ঘরে শায়িত ছিলেন। এ সময় হযরত জিব্রাইল আ., হযরত মিকাইল আ. ও হযরত ইসরাফিল আ. এসে নবীকে জাগ্রত করলেন ও বক্ষ-বিদারণ করে কলব জমজমের পানিতে ধুয়ে তা’ ঈমান ও হেকমত দ্বারা পরিপূর্ণ করে যথাস্থানে প্রতিস্থাপন করে দিলেন। এ বক্ষ-বিদারণ করার সময় মহানবী সা. কোনো রকম ব্যথা অনুভব করেননি এবং কোনো রক্তপাতও হয়নি। মহানবীর বক্ষ-বিদারণের পর তার সামনে ‘বোরাক’ নামের এক আশ্চর্য স্বর্গীয় বাহন উপস্থিত করা হয়। তাতে জিন ও লাগাম লাগানো ছিলো। এ বাহনটি গাধা হতে উঁচু এবং খচ্চর হতে নিচু। তার গতি অকল্পনীয় দ্রæত। তা’ নিজ দৃষ্টির সীমানায় পদক্ষেপ করে থাকে। যেমন এক কদমে পৃথিবী থেকে প্রথম আসমান বা নিম্নতম আসমানে পৌঁছে যায়। পলকের মধ্যে এ জাতীয় ভ্রমণ কাজ সম্পন্ন হয়। এ বাহনে আরোহণ করে তিনি বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছেন। এখানে তিনি বোরাক অদূরে বেঁধে রেখে মসজিদে প্রবেশ করে দু’ রাকাত ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ নামাজ আদায় করেন। অতঃপর বিশেষ সিঁড়ি বেয়ে প্রথম আসমানে ওঠে হযরত আদম. আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এভাবে যথাক্রমে দ্বিতীয় হতে সপ্তম আসমানে হযরত ইয়াহইয়া ও ঈসা আ., হযরত ইউসুফ আ., হযরত ইদ্রিস আ., হযরত হারুন আ., হযরত মূসা আ. এবং হযরত ইব্রাহীম আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। সকলেই মহানবী সা.কে ‘মারহাবা’ বলে সম্বর্ধনা জানান।
সপ্তম আকাশে নবীজী বায়তুল মামুর দেখতে পান। এ বায়তুল মামুরে দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে এবং কেয়ামত পর্যন্ত তারা (অর্থাৎ যারা একবার প্রবেশ করে) পুনরায় প্রবেশ করার পালা আসবে না। অতঃপর নবীজী ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ বা শেষ সীমা নির্দেশক কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে পৌঁছেন। ক্রমান্বয়ে তিনি জান্নাত ও দোজখ পরিদর্শন করেন। সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে বোরাকের গতি থেমে যায়। ফেরেশতা জিব্রাঈল আ.ও আর এগুতে পারলেন না। সিদরাতুল মুনতাহার নিকটেই সবুজ রংয়ের ‘রফরফ’ নামের একটি কুদরতি পাল্কী জাতীয় যানবাহন অপেক্ষমাণ ছিলো। এতে চড়ে একাই মহানবী সা. আল্লাহ্র সান্নিধ্যে উপস্থিত হন। অতঃপর এ সময়ই উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার বিধান সাব্যস্ত হয়। ফেরৎ পথে মুসা আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে তার পরামর্শে তিনি মহান আল্লাহর দরবারে ফিরে গিয়ে তা’ কমাবার জন্য সুপারিশ করার পর দশ দশ করে কমতে কমে শেষে পাঁচ ওয়াক্ত এসে দাঁড়ায়। মহান আল্লাহ এতে সন্তুষ্ট হয়ে পাঁচ ওয়াক্তে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সওয়াবদানে ওয়াদাবদ্ধ হন। অতঃপর আসমানে যে সব নবীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিলো, মহানবী সা. তাদের সহকারে বায়তুল মুকাদ্দাসে ফিরে আসেন। তারা তাকে বিদায় সম্বর্ধনা জানাবার জন্য এখান পর্যন্ত আগমন করেন। ইতোমধ্যে নামাজের সময় হয়ে গেলে তিনি নবীদের ইমাম হয়ে নামাজ সম্পন্ন করেন। অতঃপর তিনি বোরাকে চড়েই রওয়ানা হন এবং অন্ধকার থাকতেই যথাস্থানে ফিরে আসেন।
তিনি ফিরে এসে দেখতে পান- তার অজুর পানি তখনো গড়াচ্ছে এবং বিছানা উষ্ণই ছিলো। অর্থাৎ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশাল ভ্রমণ তথা মেরাজ সফল সমাপ্ত হয়। অন্য বর্ণনায় পাওয়া যায়- মহানবী সা.-এর এই বিস্ময়কর ভ্রমণে দীর্ঘ ২৭ বছর কেটে যায়। স্ববিরোধী এ বক্তব্যের জবাবে মুহাদ্দিসীন বলেছেন, দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের আগমনে যেমন জনতা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, তার সম্মানে সব যানবাহন, মানুষের কর্মকান্ড বন্ধ থাকে- তেমনিভাবে মহানবীর সা. আগমনে তামাম ব্রহ্মান্ডের কর্মকান্ড সাময়িকভাবে বন্ধ ছিল। এখানে স্বাভাবিক প্রশ্ন হতে পারে যে, মেরাজের এমন মর্যাদাপূর্ণ সফরে দুনিয়ার সময়ের গতিকে থামানো হলো কেন? এর যৌক্তিক জবাব হলো- যদি দুনিয়ার সময়কে চালু রেখেই আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিবের ২৭ বছরের মেরাজের সফরের সময় পার করতেন, তাহলে এই সুদীর্ঘ সময়ে জাতি সম্পূর্ণভাবেই খোদাবিমুখ হয়ে যেত এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগেই ফেতনা-ফাসাদে জড়িয়ে পড়তো। কারণ, হযরত মুসা আ. মাত্র চল্লিশ দিন তুর পর্বতে সাধনা করতে গিয়ে উম্মতের কাছ থেকে দূরে থাকার সময় তার উম্মতেরা বাছুর পূজার ফেতনায় জড়িয়ে ঈমানহারা হয়ে যায়। মহানবীর দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে মুশরিকদের পক্ষে ও ইসলামের বিপক্ষে হয়তো এমন জনমত গড়ে ওঠতো, যা পরে আর কাটিয়ে ওঠা মুসলমানদের পক্ষে সহজ হতো না। এ ধরনের ঘটনা মহানবীর উম্মতের জীবনে ঘটুক, তা আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেননি বলেই তিনি দুনিয়ার সময়ের গতি বন্ধ করে দিয়েছেন।
এই মেরাজের প্রতি সকল মুসলিম তথা মানুষের বিশ্বাস আছে। তবে বিতর্ক সৃষ্টি হয় এত স্বল্প সময়ে এ ব্যাপক ভ্রমণ ও বহুবিধ ঘটনাবলির সংঘটন সংক্রান্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তি নিয়ে। কিছু দুর্বলমনা ঈমানদার ও অবিশ্বাসী অমুসলিমদের কাছে এটা রহস্য হয়ে তাদের মনকে অনেক সময় তোলপাড় করে তোলে। তবে খাঁটি ঈমানদার বিশ্বাসীদের দৃষ্টিতে অবশ্য এটা অত্যন্ত সহজ ছিলো। কেননা তারা বিশ্বাস করে- হযরত সা. জীবনে মিথ্যা বলেননি। ‘আল আমিন’ ছিলো তাঁর উপাধি। তাছাড়া সব কথাই যেখানে তার সত্য বলে প্রমাণিত, সেখানে মেরাজের ঘটনা অসত্য হবে কেন?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন