বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী আদায়ের নজির খুব বেশি নেই। সভা-সমাবেশ, মানববন্দন কিংবা অবস্থান ধর্মঘট করে সরকারের কাছ থেকে দাবী আদায় করা গেছে, এমন দৃষ্টান্ত দেখা যায়নি। বরং দাবী-দাওয়া আদায়ের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বরবারই ব্যবহৃত হয়েছে হরতাল, ভাঙচুর বা অবরোধের মতো সংহিংস আন্দোলন। এ ধরনের আন্দোলন না হলে সরকারের টনক নড়ে না। তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমেও যে দাবী আদায় করা যায়, তার বড় নজির স্থাপিত হয়েছে গত ৮ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। বলা যায়, সরকার বাধ্য হয়েছে শিক্ষার্থীদের দাবী মেনে নিতে। এ আন্দোলন এতটাই সুশৃঙ্খল ছিল যে, কেবলমাত্র রাস্তা-ঘাটে যানজট সৃষ্টি ছাড়া কোনো ধরনের যানবাহন ভাঙচুর বা সহিংসতা ছিল না। অবশ্য ভিসির বাড়িতে কে বা কারা হামলার মাধ্যমে আন্দোলনটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। আন্দোলনের শুরুর দিকে পুলিশের গুলি ও টিয়ারশেল এবং আন্দোলনকারীদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের হামলার মতো ঘটনা ঘটেছিল, যাতে আন্দোলনকারীদের কোনো ধরনের ভূমিকা ছিল না। যদিও পরবর্তীতে এসব কোনো কিছুই আন্দোলনকারীদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। প্রশ্ন হচ্ছে, এ আন্দোলন সফল হওয়ার কারণ কি? বাস্তবতা হচ্ছে, আন্দোলনের যদি ন্যায্যতা থাকে এবং এর মূল চালিকাশক্তি যদি তরুণরা হয় ও এতে সাধারণ মানুষের সমর্থন থাকে, তবে সরকার যত শক্তিশালী বা যত নিপীড়ক ও কঠোর হোক না কেন, তার বুক কেঁপে ওঠে। শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন তাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ কিছুদিন আগেও শিক্ষক-কর্মচারিসহ বিভিন্ন পেশাজীবীরা যখন প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিয়ে দিনের পর দিন আমরণ অনশনসহ অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিল, তখন কিন্তু সরকারকে এতটুকু বিচলিত মনে হয়নি। বরং সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে অনেকটা ধমকের সুরে বলা হয়েছিল, নির্বাচনের শেষের বছরে এসে চাপ দিয়ে দাবী আদায় করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, আন্দোলনকারীরা সরকারের কাছ থেকে দাবী পূরণের একটু আশ্বাসের বাণী শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। সরকারও মৌখিক আশ্বাস দেয় এবং এতেই তুষ্ট হয়ে আন্দোলনকারীরা রণেভঙ্গ দেয়। দাবী কবে পূরণ হবে, কীভাবে পূরণ হবে, তা অনিশ্চিতই রয়ে গেছে। এর বিপরীতে কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের দাবী পূরণে সরকার এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। আন্দোলনকারীদের এক অংশ তা মেনে নিলেও আরেক অংশ মানেনি। যারা মানেনি তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। যারা মেনেছিল তারাও বুঝতে পারে, সরকারের এ সময় বেঁধে দেয়ার অর্থ সময়ক্ষেপণ ও আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়া ছাড়া কিছুই নয়। বিষয়টি বুঝতে পেরে পুনরায় তারা এক হয়ে আন্দোলন শুরু করে। স্যাবোটাজের মতো ঘটনা উপেক্ষা করে এবং সরকারি দলের কিছু নেতা ও সমর্থক বুদ্ধিজীবী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটিয়েও শিক্ষার্থীদের অভিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সরকার দ্রæততম সময়ের মধ্যেই তাদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। যদিও এর মধ্যে সরকারের কৌশল ও রাজনীতি রয়েছে বলে ইতোমধ্যে কথা উঠেছে। সে যাই হোক, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কাছে যে সরকার পরাভূত হয়ে দাবী মানতে বাধ্য হয়েছে, এটাই বাস্তবতা।
দুই.
বলা হয়ে থাকে, বর্তমান সরকারের যে চরিত্র তাতে আন্দোলন করে দাবী আদায় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে বিগত পাঁচ বছরের শাসনকালে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ পেশাজীবী কোনো সংগঠন তাদের দাবী আদায় করতে পেরেছে, এমন একটি উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর কারণ হচ্ছে, বিরোধী পক্ষের দাবী যত যৌক্তিক হোক না কেন সরকার তা শুনতে রাজী নয়। সরকার মনে করে, তার ইচ্ছা এবং মতামতের ভিত্তিতেই দেশ চলবে, মাঠের বিরোধী দল তো বটেই অন্য কারো কথা শোনার দরকার নেই। বিরোধী মত-পথের দাবী যতই যৌক্তিক হোক, তার তোয়াক্কা করার সময় সরকারের নেই এবং তা দমনে যা যা করার দরকার তাই করা হবে এবং হচ্ছে। এমনকি নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো নীতি অবলম্বন করতেও সরকারের মধ্যে কোনো দ্বিধা কাজ করে না। এমন কঠোর মনোভাবের কারণে সরকারকে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অবশ্য এ নিয়ে সরকারের মধ্যে তেমন কোনো বিচলন নেই। বরং মনে মনে যেন খুশিই। বলা বাহুল্য, সরকারবিরেধী যে কোনো ন্যায্য আন্দোলন যখন ব্যর্থ হয় বা সরকার দমিয়ে ফেলতে পারে তখন সে কতটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে বা ওঠতে পারে এবং আন্দোলনকারীদের পরিণতি কতটা নাজুক হয়, তা আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে করার দাবীতে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট যখন আন্দোলন করে, তাতে তারা সফল তো হয়ইনি, উল্টো সরকার তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাÐের অভিযোগ এনে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে দমন শুরু করে। বলা হয়ে থাকে, এই আন্দোলন বিএনপি যতটা না করেছিল, তার চেয়ে বেশি করেছিল সরকারের বিভিন্ন লোকজন। আন্দোলনে স্যাবোটাজ করে তা ভয়ংকর রূপ দিয়েছিল। অর্থাৎ সরকার নিজের নাক কেটে বিরোধী দলের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছিল। বিরোধী দলের সেই আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সরকারের ক্ষমতা কয় প্রকার ও কি কি এবং সরকার কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তা বিএনপিকে দেখাতে কসুর করেনি। দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর এমন অত্যাচার ও পীড়ন চলিয়ে দেয়া হয়েছে যে আজ পর্যন্ত তারা দৌড়ের ওপর রয়েছে। দলের সভা-সমাবেশ দূরে থাক, শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি মানববন্ধন পর্যন্ত করতে দেয়া হয়নি, এখনও দেয়া হচ্ছে না। ৫ জানুয়ারির আন্দোলনকে উসিলা ধরে বিএনপির কর্মসূচি সহিংস হবে এমন আগাম ধারণা করে সরকার সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছে। বিএনপি যতই বলুক সে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চায়, সরকার ঐ এক উসিলায় তা মানতে রাজী নয়। তবে মাঝে মাঝে বিএনপির জনপ্রিয়তা ও তার সক্ষমতা দেখতে অন টেস্ট হিসেবে সভা-সমাবেশ করার অনুমিত দেয়। এসব সভা-সমাবেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতি দেখে পরবর্তীতে সরকার গোয়েন্দা রিপোর্টের অজুহাতে অনুমতি দেয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীতে বিএনপিকে বড় ধরনের কোনো সমাবেশই করতে দেয়া হচ্ছে না। গত ৮ ফেব্রæয়ারি দলটির চেয়াপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মামলার রায় নিয়ে সরকার বেশ একটা ফাঁদ পেতেছিল বলে পর্যবেক্ষরা মনে করেন। সরকার ধরেই নিয়েছিল খালেদা জিয়ার সাজা হলে বিএনপি ৫ জানুয়ারির মতো ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলবে। এ সুযোগে সেই পুরনো কৌশল অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাÐের প্রয়োগ ঘটিয়ে দলটিকে নতুন করে দমন-পীড়ন ও বদনাম দেয়া যাবে, সরকারের মধ্যে এমন একটা মনোভাব ছিল। তবে বিএনপি সরকারের ধারণা অনুযায়ী বড় ধরনের কোনো আন্দোলন না করায় এই কৌশল ভেস্তে যায়। বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগে বারবার তার নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দিয়ে যান। তার নির্দেশ মেনে দলটি মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর অভিযান, লিফলেট বিতরণের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা শুরু করে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিতেও ব্যাপক মানুষের উপস্থিতি সরকারের টনক নড়ায়। এক ধরনের নার্ভাসনেসও তার ভেতর কাজ করে। ফলে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও সরকার বাধা প্রদান শুরু করে। একই সঙ্গে বিএনপির আন্দোলন করার সক্ষমতা নেই, নিঃশেষ হয়ে গেছে, মুরোদ নেই ইত্যাদি নানা ধরনের উস্কানিমূলক বক্তব্য দিতে থাকে। সরকারের পক্ষে কিছু পত্র-পত্রিকা এবং গণমাধ্যমও বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং এখনও করছে। তাদের আচার-আচরণ এবং কথাবার্তায় এমন ভাব পরিলক্ষিত হয়, বিএনপির চেয়ারপারসন কারাগারে অথচ তার জন্য দলটির নেতাকর্মীরা কিছু করছে না! এ কেমন কথা! অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থক গোষ্ঠীর শত উস্কানি সত্তে¡ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে ঠান্ডা মাথায় বাধার মুখেও চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবীতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। বলা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেনি। কঠোর আন্দোলনের জন্য দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্য থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে তাকিদ দিলেও তারা ধৈর্যসহকারে তাদের কর্মসূচি পালনের নীতিতে অটল আছেন। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দলটি টাইমিং বা উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছে। যেমনটি হয়েছে কোটাবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোটাবিরোধীরা যদি বছর দুয়েক আগে এমন আন্দোলন করত, তবে তা সাফল্যের মুখ দেখত না। সরকার যে করেই হোক তা দমিয়ে ফেলত। তারা এবার সফল হয়েছে সময়ের কারণে। সরকার উপলব্ধি করেছে, মেয়াদের শেষ দিকে এসে যদি শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন চলমান থাকে, তবে তা ঠেকানো যাবে না। তাই বাধ্য হয়েই তাদের দাবী মেনে নিয়েছে। তদ্রæপ বিএনপিও যদি উপযুক্ত সময়ে এ ধরনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে পারে, তবে সরকারের পক্ষে তাদের দাবীও উপেক্ষা করা সম্ভব হবে না।
তিন.
সাধারণত ক্ষমতাসীন দলের মেয়াদের শেষ বছরে নানা জটিলতা দেখা দেয়। বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের আন্দোলন দান বেঁধে ওঠে। সরকারও এ সময় অনেকটা ব্যাকফুটে থাকে। এর কারণ হচ্ছে, তাকে ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা তার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের বিষয়টি দেশে-বিদেশে খুব বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে এ দাবীতে আন্দোলনে করছে। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংবিধান সংশোধন করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করার পক্ষে অনড় অবস্থানে রয়েছে। বারবারই বলছে, কিছুতেই সংবিধানের বাইরে সে যাবে না। পাশাপাশি বিএনপি ও তার জোট যাতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারে এ জন্য সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তার রাজনৈতিক কর্মসূচি স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালনের ক্ষেত্রে প্রতি পদে পদে বাধা দিচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। মামলায় জর্জরিত অসংখ্য নেতাকর্মীকে কোর্টে হাজির হতে হচ্ছে। বলা যায়, বিএনপিকে বছরের পর বছর ধরে কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে। সরকারের এই কঠোর মনোভাবের মধ্যে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সে বিরোধী দলের রাজনীতি করার সুযোগ দিতে চায় না। বিরোধী রাজনীতি নির্মূলে একদিকে সংসদে নামমাত্র বিরোধী দল রেখেছে, অন্যদিকে মাঠের বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্নকরণ নীতি অবলম্বন করে চলেছে। শুধু বিরোধী দল নির্মূলই নয়, সরকারের কর্মকাÐের যাতে সমালোচনা ও ভিন্নমত পোষণ করতে না পারে নাগরিক সমাজকে ও গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। বলা যায়, সরকার বিরোধী দল ও মতকে একপ্রকার অবরুদ্ধ করে রেখেছে। যেমনটি দেখা গিয়েছিল তিউনিসিয়ায়। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বেন আলী প্রায় ২৩ বছর ধরে বিরোধী রাজনীতি, মত, পথ, বাক স্বাধীনতা স্তব্ধ করে রেখেছিল। তার স্বেচ্ছাচারিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষের যেমন প্রতিবাদ করার সুযোগ ছিল না। যারাই প্রতিবাদ করত তাদের কঠোরভাবে দমন করত। পাশাপাশি দেশটির বেকারত্ব, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিপীড়ন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে অতি সাধারণ মানুষও তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পেত না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে বেন আলীর দুঃশাসন থেকে তিউনিশিয়ার জনগণ মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। এমনই এক দুঃসময়ে ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ছোট্ট একটি ঘটনা থেকে বেন আলীর পতনের সূচনা হয়। প্রাদেশিক শহর সিডি বউজিদ-এ মোহাম্মদ বউআজিজ নামে এক সবজি বিক্রেতা প্রতিদিনের মতো সকালে তার ভ্যানগাড়ি নিয়ে রাস্তায় বের হন। এমন সময় এক মহিলা পুলিশ তাকে আটকায়। বউআজিজ বরাবরের মতো তার এক দিনের আয় দশ দিনার জরিমানা দিতে চেষ্টা করেন। এতে ঐ পুলিশের মন ভরেনি। তিনি তাকে থাপ্পড় মারেন এবং ভ্যানগাড়িটি জব্দ করে নিয়ে যান। বউআজিজ অভিযোগ নিয়ে মিউনিসিপ্যাল হেডকোয়ার্টারে যান এবং তার ভ্যানগাড়িটি ফেরত চান। সেখান থেকে তিনি কোনো প্রতিকার পাননি। পরে ক্ষুদ্ধ ও অপমানিত বউআজিজ পেট্রল নিয়ে মিউনিসিপ্যাল হেডকোয়ার্টারে গিয়ে নিজের গায়ে ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুসে ওঠে এবং প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। ফেসবুক-ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বউআজিজের ছবি ছড়িয়ে পড়ে। সব পেশার মানুষ এর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীরা তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস, গুলি, লাঠিচার্জ শুরু করলে আন্দোলন সহিংস রূপ লাভ করে। সরকার আন্দোলনের এসব খবর মিডিয়াতে প্রচার সীমিত করে। শহরটিতে মিনি কারফিউ জারি করে। এতেও আন্দোলন থামেনি বরং তা রাজধানী তিউনিসসহ অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘ দিনের পুষে রাখা ক্ষোভ নিয়ে ছাত্র, শ্রমিক, আইনজীবীসহ সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আন্দোলনে নেমে পড়ে। বেকারত্ব, দুর্নীতি, অত্যাচার-নির্যাতন এবং বেন আলীর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তারা প্রবল আন্দোলন গড়ে তোলে। ২৮ ডিসেম্বর বেন আলী এক টেলিভিশন ভাষণে আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এতেও আন্দোলনকারীরা দমে যায়নি। তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে যেতে থাকে। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি বেন আলী সরকার ভেঙ্গে দিয়ে জরুরী অবস্থা জারি করেন এবং আন্দোলনের মাধ্যমে সরে যাওয়া থেকে বাঁচাতে ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দেন। তার এ ঘোষণাতেও কাজ হয়নি। আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত ঐ দিনই বেন আলী দেশ থেকে পালিয়ে সউদী আরবে আশ্রয় নেন। তিউনিসিয়ার গণমানুষের আন্দোলন সফল হয় এবং জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা এক স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। অথচ এর সূচনা হয়েছিল এক সবজি বিক্রেতার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ঘটনার সূত্রপাত সামান্য হলেও এর সাথে জড়িয়ে পড়ে গণতন্ত্রকামী মানুষের দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ ও বঞ্চনা। বাংলাদেশেও স্বৈরশাসক হিসেবে পরিচিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন এভাবেই ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে হয়েছিল। এসব উদাহরণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, স্বৈরাচার যে ফরমেটেই থাকুক না কেন, একসময় তাকে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও বিক্ষোভের অনলে পুড়তে হয়। কারণ সে নিজেকে রক্ষা ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এমনসব অনিয়ম ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে যা সাধারণ মানুষকে বিক্ষুদ্ধ করে তুলে। তাৎক্ষণিকভাবে এর প্রতিবাদ ও প্রতিকারের পথ সরকার বন্ধ করতে পারলেও কোনো না কোনো সময় তার প্রকাশ ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গ থেকে ভয়াবহ দাবানলের সৃষ্টি হয়। যেমনটি দেখা গিয়েছে কোটাবিরোধী আন্দোলনে। সরকার যদিও এ আন্দোলন ভয়াবহ রূপ লাভ করার আগেই থামিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, তারপরও এর রেশ যে পুরোপুরি কেটে গেছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ ইতোমধ্যে আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর আন্দোলনকারীদের তিন যুগ্ম আহŸায়ককে পুলিশের গোয়েন্দা বাহিনী কর্তৃক তুলে নেয়ার ঘটনা আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এ প্রতিক্রিয়া থেমে যাবে নাকি তাদের বিক্ষুদ্ধ করে তুলবে, তা এখনই বলা যাবে না।
চার.
এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার সংকট চলছে। দুটোই সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দুর্নীতি, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক অস্থিরতা, বিচারবর্হিভূত হত্যাকান্ড বৃদ্ধি, খুন, গুম, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার অসীম ব্যবহারসহ নানা নেতিবাচক দিকের প্রকাশ ঘটছে। সরকার যতই উন্নয়নের কথা বলুক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদের এসব নেতিবাচক দিকের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে তা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য বলে কিছু নেই। এমন একটি অপসংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটেছে যে, দেশে কেবল ক্ষমতাসীনরাই দাপিয়ে বেড়াবে আর অন্যরা তা মেনে নেবে। এ ধরনের প্রবণতা স্বৈরশাসনকেই প্রতিষ্ঠিত করে। সরকার মনে করছে, তার বিরোধী মতকে মেরে-কেটে দমিয়ে কেবল উন্নয়ন করলেই জনগণ খুশি থাকবে। এ ধারণা যে ভুল তা সবদলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দিলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। সংসদের বাইরের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি ও তার জোট এ কথাগুলোই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে। সরকার তা কিছুতেই আমলে নিচ্ছে না। তবে সরকারের এ আমলে না নেয়া থেকে বোঝা যায়, সরকার হয়তো নিজেও জানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে হেরে যাবে, এ ভয়েই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ভয় পায় এবং তার নিজের অধীন ছাড়া নির্বাচন করতে রাজী নয়। যদি সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে এবং বিএনপি এ নির্বাচনে না যায়, তবে এটা নিশ্চিত আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হবে না। কারণ বিএনপি নিশ্চিতভাবেই নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করবে। আর বিনপির সে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হবে না সংঘাতপূর্ণ হবে, তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না।
darpan.journalist@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন