জালাল উদ্দিন ওমর
প্রতি বছরের মতো এবারের শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই তিস্তার বুকে ধু-ধু বালুচর জেগে ওঠেছে। তিস্তায় প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় কৃষকেরা কৃষি কাজ করতে পারছেন না। ফলে কৃষক, কৃষি এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি সবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে তিস্তা পাড়ের মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং আর্থ-সামাজিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হাজার হাজার কৃষক এবং জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। বছরের পর বছর ধরে তিস্তার এই জীবনচিত্র চলে আসছে। কিন্তু মনে হয় এর কোন সমাধান নেই। এ সঙ্কট থেকে কবে মুক্তি পাব, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের নেতারা বরাবরই আশাবাদ ব্যক্ত করলেও সেই চুক্তি এখনো সম্পন্ন হয়নি। দ্রুত সময়ে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদনের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে একাধিকবার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এমনকি চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সেচ প্রকল্পে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় পানি দেওয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের এই অনুরোধে ভারত সাড়া দিয়েছেÑএমন কোনো নজির আমাদের কাছে নেই। ফলে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিও সম্পাদন হয়নি এবং বাংলাদেশও প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। এ অবস্থায় বাংলাদেশ কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। তাই ভারতের প্রতি অনুরোধ, আপনারা তিস্তায় একটু পানি দিন। বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার অনুযায়ী পানি দিন আর আমাদের অব্যাহত ক্ষতির হাত থেকে একটু বাঁচান।
তিস্তা হচ্ছে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া অভিন্ন ৫৪টি নদীর একটি। এটি ৩৬৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। তন্মধ্যে ভারতে ২৪৯ কিলোমিটার আর বাংলাদেশে ১১৭ কিলোমিটার। তিস্তা নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশ এবং ভারতে বিরাট সেচ প্রকল্প গড়ে ওঠেছে। তিস্তার পানি দিয়ে উভয় দেশে ১৯ লাখ ৬৩ হাজার হেক্টর জমিকে কৃষি প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। তন্মধ্যে ভারতে কৃষি প্রকল্পের পরিমাণ ১২ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর জমি আর বাংলাদেশে ৭ লাখ ৪৯ হাজার হেক্টর। কিন্তু তিস্তার পানি দিয়ে ভারতের কৃষি প্রকল্পে ঠিকমত ফসল উৎপাদন হলেও পানির অভাবে বাংলাদেশের কৃষি প্রকল্পে ঠিকমত ফসল উৎপাদন করা যাচ্ছে না। ভারত কর্তৃক পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় তিস্তা নদীতে ব্যারেজ নির্মাণ করার পর থেকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি কমে যায়। ২০১৬ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি মাসে তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে প্রাপ্ত পানির পরিমাণ গজলডোবা ব্যারেজ নির্মাণের আগে ১৯৭৩-১৯৮৫ সময়কালের প্রাপ্ত পানির এক-তৃতীয়াংশ মাত্র। ডালিয়া পয়েন্টে ১৯৭৩-১৯৮৫ সময়কালে গড়ে জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন, দ্বিতীয় ১০ দিন এবং তৃতীয় ১০ দিনে পানির প্রবাহ ছিল যথাক্রমে ৭০১০, ৬০১০ এবং ৫৬৬৮ কিউসেক। আর ২০১৬ সালের জানুয়ারির প্রথম ১০ দিন, দ্বিতীয় ১০ দিন এবং তৃতীয় ১০ দিনে ডালিয়া পয়েন্টে গড় পানি প্রবাহ যথাক্রমে ২৩৮৪, ১৭৬০, এবং ১১৯০ কিউসেক। সুতরাং ব্যবধানটা সহজেই অনুমেয়। ভারত কর্তৃক পানি প্রত্যাহার করায় নভেম্বরের শুরু থেকেই তিস্তায় পানি কমতে থাকে। আর এটা এপ্রিল পর্যন্ত চলে। অর্থাৎ আবার বর্ষা শুরুর আগ পর্যন্ত পুরো শুষ্ক মৌসুমেই তিস্তায় পানি থাকে না। এ কারণে বাংলাদেশ কখনই তার সেচ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি এবং প্রত্যাশিত ফসল উৎপাদন করতে পারেনি। ২০১৩ সাল পর্যন্ত মাত্র ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ২০১৪ সালেও ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ করা হয়েছিল। কিন্তু তিস্তায় পানি না থাকায় সেই ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদন করা যায়নি এবং কৃষকেরা ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। ২০১৫ সালে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ২০ হাজার হেক্টর জমিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় আনা হলেও মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এই অবস্থার কারণে ২০১৬ সালে মাত্র ৮ হাজার হেক্টর জমিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। এভাবে পানি না থাকায় শুধু কৃষকেরা একর প্রতি লোকসান দিচ্ছেন আট হাজার টাকা। আর সেচ প্রকল্পের আওতায় আনা সাড়ে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে কৃষিকাজ করতে না পারার কারণে লোকসান হচ্ছে ১৪৮২ কোটি টাকা। পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার মৎস্য সম্পদ হারাচ্ছে। হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিস্তা ব্যারেজ কোনো কাজে আসছে না। সেচ প্রকল্পের জন্য হাজার হাজার একর কৃষিজমিতে যে ক্যানেল করা হয়েছে তাও পরিত্যক্ত। তিস্তায় পানি না থাকায় এর সংলগ্ন বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়ে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যায়। এভাবে ভারত কর্তৃক তিস্তার পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ কত তা হিসাবের বাইরে।
বাংলাদেশের তিনদিকেই ভারত। ভারত দীর্ঘদিন থেকেই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট চাচ্ছে, চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহার করতে চাচ্ছে, যার মূল উদ্দেশ্য সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যে সহজে মালামাল পরিবহন করা। কিন্তু ভারত যেটা চাচ্ছে সেটা কোনো ট্রানজিট নয় বরং করিডোর। কারণ এ ক্ষেত্রে ভারত থেকে যাত্রা শুরু হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আবার ভারতে ঢুকবে। ভারতকে করিডোর দিতে, বন্দর ব্যবহার করতে দিতে বর্তমান সরকার সম্মত। ভারতীয় পণ্য পরিবহনের স্বার্থে তিতাস নদীর বুকে বিশাল একটি রাস্তাও আমরা তৈরি করেছিলাম এবং সেই রাস্তা দিয়ে ভারত তার প্রয়োজনীয় মালামাল পরিবহন করেছিল। ভারতের চাহিদা অনুসারে আসামের উলফা নেতাদের গ্রেপ্তার করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি। ভারত ফারাক্কায় বাঁধ দেয়ায় আমরা পানির কষ্টে আছি। এক কালের প্রমত্তা পদ্মা এখন মৃত নদী। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার বুকে জেগে ওঠে ধু-ধু বালুচর। পানির অভাবে পদ্মা নদীর শাখা-প্রশাখাও শুকিয়ে যায়। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রয়োজনীয় পানি না পাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পুরো রাজশাহী অঞ্চলে কৃষি কাজ ব্যাহত হয়। প্রয়োজনীয় পানির অভাবে বরেন্দ্র সেচ প্রকল্প ঠিক মতো কাজ করছে না। আর এতে বাংলাদেশের ক্ষতি হাজারো কোটি টাকা। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সাথে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হলেও, চুক্তি অনুযায়ী ভারত কোনো বছরই পানি দেয়নি। এভাবে ফারাক্কা বাঁধ আজ বাংলাদেশের জন্য এক মহা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তিস্তার পানিও দিচ্ছে না, চুক্তিও করছে না। আবার নির্মাণ করছে টিপাইমুখ বাঁধ। ভারত বাস্তবায়ন করছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। সীমান্তে বিএসএফ প্রায়ই এদেশের নিরীহ মানুষদের হত্যা করছে। ভারতের প্রতিটি টিভি চ্যানেল বাংলাদেশের আকাশে উন্মুুক্ত হলেও, বাংলাদেশের একটি টিভি চ্যানেলও ভারতের আকাশে উন্মুুক্ত নয়। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে।
ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এগুলোর ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এসব নদীর পানির ওপর ভারতের মতো বাংলাদেশেরও আইনসঙ্গত এবং ন্যায্য অধিকার রয়েছে। তাই ভারতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলেই ভারত কিন্তু তার প্রয়োজন অনুসারে এবং ইচ্ছামতো নদীর পানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটা অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ বণ্টনের জন্য আন্তর্জাতিক যে আইন-কানুন এবং নিয়ম-নীতি রয়েছে তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিক অনেক নীতিমালা রয়েছে। তার দুটি এখানে উল্লেখ করছি। হেলসিংকি রুল ১৯৬৬-এ বলা হয়েছে- অভিন্ন নদী বয়ে চলা প্রতিটি দেশকে নদীর পানি এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে, যাতে তা অন্য কোনো দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিঘিœত না করে। এবং তা ক্ষতিগ্রস্ত দেশে কী ক্ষতি বয়ে আনবে তা বিবেচনায় আনতে হবে। ১৯৯৭ সালের ২১ মে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ইউএন কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সর্বোচ্চ টেকসই ব্যবহার ও উপকারের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে পানিপ্রবাহ পর্যাপ্ত সংরক্ষণ নিশ্চিত করে অভিন্ন নদীপ্রবাহের দেশগুলো ন্যায্য ও যৌক্তিক উপায়ে পানি ব্যবহার করবে। এতে আরো বলা হয়েছে, পানি প্রবাহের দেশগুলো আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ ব্যবহার, উন্নয়ন ও সংরক্ষণের কাজে ন্যায্য ও যৌক্তিকতারভিত্তিতে অংশ নেবে। অথচ ভারত সরকার ইচ্ছামতো অভিন্ন নদীর পানিকে ব্যবহার করছে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীগুলোর সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশন রয়েছে। কিন্তু এই নদী কমিশন ঠিক মতো বৈঠকে বসে না। ২০১০ সালের পর আর কোনো বৈঠক হয়নি। কিন্তু এতে তো ভারতের কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, ক্ষতি যা হওয়ার তা বাংলাদেশেরই হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই ভালো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের দহরম-মহরম শুরু হয়ে যায়। বাংলাদেশে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সফর যেমন বেড়ে যায়, তেমনি ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সফরও তেমনি বেড়ে যায়। শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের দৌড়ঝাঁপ এবং বন্ধুত্বের কথামালা। আরো শুরু হয় বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে সাহায্য এবং সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি। এই সম্পর্ক উন্নয়ন, বন্ধুত্ব এবং সাহায্য সহযোগিতার যে সেতুবন্ধন বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে চলছে তার আওতায় তিস্তায় পানি দেওয়ার জন্য আমি ভারত সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। তিস্তার পানি আমাদের প্রতি ভারতের দয়া বা অনুগ্রহ নয়, বরং তিস্তার পানি হচ্ছে আমাদের আইনগত এবং ন্যায্য অধিকার। কারণ এটা ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন একটি নদী। আমরা ভারতের সব চাওয়া পূর্ণ করে চলছি কিন্তু ভারত আমাদের পাওনা দিচ্ছে না। এটা নিশ্চয়ই সুসম্পর্কের চিত্র নয়। সম্পর্কে সবসময় ব্যালেন্স করতে হয়। মনে রাখা দরকার একতরফা কোনো সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকে না। এক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় অধীনতা যা নিয়ে আসে পরাধীনতা। অসম বন্ধুত্ব কখনো কখনো মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে। আর সেই বিপদ অনেক সময় অস্তিত্বই ধ্বংস করে। এটা সবার বেলায় প্রযোজ্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এবং স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতার জন্য আমরা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এই কৃতজ্ঞতার জন্য আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। প্রত্যেক মানুষকে যেমন তার ন্যায্য অধিকার দিতে হবে, ঠিক তেমনি প্রত্যেক প্রতিবেশীকেও তার ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। এতেই সবার জন্য কল্যাণ নিহিত। আর বাংলাদেশের মানুষ ভারতের কাছ থেকে সবসময় ভালো কিছুই আশা করে। আশা করি ভারত সরকার বিষয়টি অনুধাবন করবেন।
য় লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
ড়সধৎথপঃম১২৩@ুধযড়ড়.পড়স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন